Header Ads

উচিত-অনুচিতের দ্বন্দ্বে মানুষের বিভ্রান্তি বাড়ছে !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

যারা ইতিমধ্যে ‘হু’-এর সঙ্গে নিয়মিত হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করেছেন তারা প্রতি মুহূর্তেই যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর, প্রয়োজনীয় আপডেট-ফীডব্যাক এবং নিজেকে বাঁচানোর জন্যে কি করণীয় জানতে পারছেন। কিন্তু দেশের বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ তা জানতে পারছেন না এবং সঠিকভাবে কিছু জানতে না পারার জন্যেই তাদের একটা বিরাট অংশ, যারা মস্তিষ্ক দিয়ে সবকিছু ভেবে দেখার জায়গায় এখনও উঠে আসতে পারেন নি, প্রকৃতপক্ষে তারাই ভীষণভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছেন সংবাদমাধ্যাম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-হোয়াটসঅ্যাপে প্রতিনিয়ত ভাসতে থাকা নানান খবরাখবর এবং মাতব্বরদের  ‘জ্ঞানগর্ভ’ বক্তিমের ধাক্কায়।


 এদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে বিদেশে পাঠরত-গবেষণারত কিছু ‘তথাকথিত’ ছাত্র-অধ্যাপক-বিজ্ঞানী এবং স্বল্পশিক্ষিত অমার্জিত উদ্ধত ‘সেলেব’ও ! তাদের মধ্যে অনেকেই করোনা ভাইরাস সঙ্গে নিয়েই বিমানবন্দরে কয়েক মিনিট থার্মল গানের সামনে দাঁড়িয়েই গটগট করে রেরিয়ে এসে জনারণ্যে মিশে গেছেন দাপটের সঙ্গেই। এদের মধ্যে অনেকেরই পিঠে প্রভাবশালীর থাবা রয়েছে। পরমানন্দে মল-রেস্টেুরেন্ট সহ ইচ্ছেমতো পাব্লিক-প্লেসে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাদের এই ‘মুক্তমনা স্বেচ্ছাচারী’ উড়ে বেড়ানোর ফলে যা ঘটার তা ইতিমধ্যেই ঘটে গিয়েছে--পরিণাম সামনে আসতে চলেছে আগামী ১৪-১৫ দিনের মধ্যেই। ‘হু’ বলছে--এই ১৪-১৫ দিনই ভারতের জন্যে বিশেষভাবে ‘অ্যালার্মিং পিরিয়ড’! এই মারাত্মক ‘অ্যালার্মিং পিরিয়ডে’ রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারের দিক থেকে কতটা কি করার আছে সেটা যখন মস্তিষ্ক দিয়ে বোঝার  চেষ্টা করছি তখনই মাথাটা পুরোপুরি ঘুরে যাচ্ছে !
১৩০ কোটি মানুষের দেশ আমাদের ভারতবর্ষ। কানাডা, ইটালি, ইরাণ, স্পেন, ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স-এর চেয়ে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি। নানান দিক থেকে এইসব দেশের পরিকাঠামো জনসংখ্যার তুলনায় খুব কম নয়--তবু তারা বিপর্যয় ঠেকাতে পারছে না। ১৩০ কোটি মানুষকে নিশ্চিত নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষমতা ট্রাম্প-পুতিনেরও নেই। আমাদের রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারেরও একেবারেই নেই--শুধুমাত্র মানুষকে সচেতন করা ছাড়া--মানুষকে কি করতে হবে তার সঠিক দিশা দেওয়া ছাড়া ! ১৩০ কোটির মধ্যে যদি খুব কম করেও ১০% মানুষ আক্রান্ত হয় তাহলে ১৩ কোটি মানুষকে টেকনিক্যালি আইসোলেট করার মতো পরিকাঠামো কোনো রাজ্যেরই নেই। প্রায় আকস্মিক ভাবেই হুড়মুড় করে ঢুকে পরা এই করোনা ভাইরাসের চরিত্র বোঝার আগেই বহু মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। যাদের শনাক্ত করা গেছে তাদের সংখ্যাটা এই মুহূর্তে  অন্যান্য আক্রান্ত দেশের তুলনায় এবং আমাদের জনসংখ্যার ঘনত্বের বিচারে অনেকটাই কম--মুত্যুর সংখ্যার দিক থেকেও। কিন্তু উদ্বেগজনক আশঙ্কাটা পুরোপুরি ঘাপটি মেরে আছে আমদানিকৃত অপরীক্ষিত আক্রান্তদের মধ্যেই।
যদি নিজের রাজ্যের কথাই ভাবি তাহলেও আশঙ্কাটা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। এখনও পুরোপুরি আন্তর্জাতিক বিমান যাতায়াত বন্ধ হয় নি। যদিও কলকাতা থেকে আন্তর্জাতিক উড়ানের সংখ্যা এখন খুবই কম--তবু করোনা ভাইরাস থাবা বসানোর সূচনা থেকেই বিলেত ফেরতদের ভাইরাস পরীক্ষায় বাধ্য করে আইসোলেশনে পাঠানো যায় নি। শুধুমাত্র তাপমাত্রা চেক করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে--দু’চারজনকে বলা হয়েছে বেলেঘাটা ঘুরে আসতে ! কিন্তু তারা ক’জন নিজেদের পরীক্ষা করালো--কতজন ভাইরাস শরীরে নিয়ে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ালো তার কোনও সুনির্দিষ্ট ডেটা নেই। দু’একদিন আগেই যাদের শরীরে ভাইরাস ঢুকেছে তাদের সঙ্গে যে কোনো সাধারণ মানুষের বাহ্যিক দিক থেকে কোনোরকম পার্থক্য থাকার কথা নয়--এমন বিলেতফেরতের সংখ্যা কত এবং তারা কিভাবে কত দিন যত্রতত্র ‘মিলাবে মিলিবে যাবে না মিলায়’ মার্কা আমোদ-প্রমোদে কাটিয়েছেন--পরীক্ষা করান নি এবং গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন তাদের সম্পর্কেও কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। কলকাতা ছাড়া দূরের জেলাগুলোতে এই ভাইরাস যদি অল্প-স্বল্পও আউটব্রেক করে তাহলে তাদের আইসোলেট করে যাবতীয় পরীক্ষা করে চিকিৎসা করার মতো স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তৈরি আছে বলে মনে হয় না। উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং শিলিগুড়ি জয়গাঁ-হাসিমারা-পানিট্যাঙ্কি সহ বাংলাদেশ সীমান্ত সংশ্লিষ্ট জেলা (কোচবিহার-দুই দিনাজপুর-মালদহ-মুর্শিদাবাদ বিশেষ করে) সম্পর্কে দুশ্চিন্তা থাকছেই আগামী ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। ইতিমধ্যেই কোচবিহারর তুফানগঞ্জ এবং বীরভূমের সিউড়ি নিয়েও মানুষের দুশ্চিন্তা বেড়েছে (সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী)।
আমাদের দেশে মানুষ কোনো কিছুতেই বিশেষ ভয় পায় না--কারণ তারা আশৈশব জেনে এসেছে ভাগ্যের হাতে নিজেদের সমর্পণ করে দেওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করার থাকে না। তবু এই পরিস্থিতিতে মানুষের পাশে নির্ভেজাল আন্তরিকতার সঙ্গে দাঁড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানেন রাজ্যের জনসংখ্যার তুলনায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও স্বাস্থ্যকর্মীর প্রাচুর্য কতটা। মানুষকে সচেতন করতে এবং যথাসম্ভব মানুষকে বিপন্মুক্ত রাখতে তিনি নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নানাভাবে অনুরোধ আহ্বান জানাচ্ছেন সর্বস্তরের মানুষকে সরকারকে সাহায্যের জন্য। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইয়ের মুহুর্তে তিনি একটিও ফালতু শব্দ উচ্চারণ করেন নি--রাজনৈতিক অঙ্ক কষেন নি। তাঁর এই ভূমিকা রাজ্যের মানুষকে যথেষ্ট আশা-ভরসা জুগিয়েছে। তিনি বহু মানুষের একত্র সমাগম ঠেকাতে রাজ্যের স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখেছেন। মিটিং-মিছিল পুর নির্বাচন স্থগিত রেখেছেন। মমতা বা মোদী কারুর পক্ষেই শুধূমাত্র সরকারি পরিকাঠামোর সাহায্যে এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে বিপন্মুক্ত করা সম্ভব নয়--তাই নিজেদের ও পরিবারের প্রাণের দায়ে মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে।
একদিনের জনতা কার্ফু’র ১৪ ঘন্টা কোটি কোটি মানুষকে ভাইরাস সংস্পর্শ থেকে নিশ্চিতভাইে মুক্ত রাখবে। কিন্তু যারা ইতিমধ্যেই আক্রান্ত তাদের ঐ একদিনের জনতাকার্ফুতে কিছু যাবে আসবে না--কিন্তু যারা লুকিয়ে আছেন তারা তো ১৪ ঘন্টা মানুষের সংস্পর্শে আসতে পারবেন না--এটাই বা কম কিসের ! যাদের না বেরুলে দেশ অচল হয়ে যাবে তাদের পাশে মানুষকে দাঁড়াতেই হবে--সরকারও অবশ্যই দাঁড়াচ্ছে। ম্যান-টু-ম্যান সংযোগের ক্ষেত্রে এখন নির্দিষ্ট দূরত্ব তৈরি করতেই হবে--কারণ ইতিমধ্যেই দেশের নানা প্রান্তে মনুষ্যদেহী বেশ কিছু প্রভাবশালী বিলেতফেরৎ জন্তু জনজীবনের স্বাভাবিক ছন্দকে গুলিয়ে দিয়ে এখনও অপরীক্ষিত অবস্থায় গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে--দ্রুত এদের শনাক্ত করে ঘাড় ধরে আইসোলেশনে  পাঠানোর কাজটা এখনই করতে হবে সরকারকে।
এই মুহূর্তে রাজনীতি নয়--ব্যক্তিগত গোষ্ঠীগত জাত-পাতগত চিন্তাভাবনার উর্দ্ধে উঠে ‘হু’ কি বলছে--সরকার কি বলছে--কি কি ব্যবস্থা নিতে বলছে তাতেই কান দেওয়ার চেষ্টা করুন। কোনোরকম প্ররোচনা গুজব আজগুবি ওষুধপত্রের জন্যে পাগল হবেন না। উচিত অনুচিত বোধটাকে এখন বন্ধক রাখার সময় নয়। বিভ্রান্ত হওয়ারও সময় এটা নয়। পরিবারের বয়স্ক প্রিয়জনদের নিরাপত্তা পুরোপুরি নির্ভর করছে আপনার ওপরেই--আপনাকেই সঠিক বিজ্ঞান ও যুক্তিসঙ্গত ব্যবস্থা নিতে হবে। ফেসবুকের কাঁঠালপাতা চোষা ব্রহ্মজ্ঞানীদের বোলচাল এবং  একেবারেই ফালতু উত্তেজনা ও প্ররোচনা তৈরি করার মতো পোস্টগুলোর দিকে না তাকানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নিজের নিরাপত্তার কথা নিজেকেই ভাবতে হবে। আগামী দু’তিন সপ্তাহ আপনাদের সম্পূর্ন নিরাপদে কাটুক--এই শুভেচ্ছা রইল সকলের জন্য !

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.