Header Ads

গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত হল বন্যপ্ৰাণী সংরক্ষণে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা সভা

অসম তথা গোটা উত্তরপূৰ্বাঞ্চল যথেষ্ট প্ৰাকৃতিক সম্পদে সম্বৃদ্ধ। কিন্তু বিশ্ব উষ্ঞায়নের ফলেই হোক কিংবা জীবশ্ৰেষ্ঠ মানুষের ধ্বংসযজ্ঞের ফলেই, দ্ৰুত পরিবৰ্তন আসছে প্ৰকৃতিতে। গত কয়েক বছরে চোখে পড়ার মতো বেড়েছে মানুষ ও বন্য জীবজন্তুর মধ্যে সংঘাত। খাবার না পেয়ে বনের হাতিরা জঙ্গল ছেড়ে চলে আসছে লোকালয়ে। খাবারের খোঁজে মানুষের বাড়ির বেডরুমে গিয়ে ঢুকে পড়ছে চিতাবাঘ। চিতা বাঘের হানায় মানুষ মরছে, আহত হচ্ছে। প্ৰতিশোধ নিতে গ্ৰামে গঞ্জে দেখা যাচ্ছে মানুষ চিতা বাঘগুলিকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে। চিতাবাঘ, হাতি মেরে সেগুলির মাংস খাচ্ছে। জঙ্গল নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে হ্ৰাস পাচ্ছে একের পর এক প্ৰজাতির বন্যপ্ৰাণী, পাখি। নষ্ট হচ্ছে পোকামাকর। যার প্ৰভাব আজকে না হোক অদূর ভবিষ্যতে ঘুরে ফিরে মানুষের ওপরই পড়বে। 


বন্যপ্ৰাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্ৰে সংবাদ মাধ্যমেরও যথেষ্ট দায়বদ্ধতা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে রবিবার গুয়াহাটিতে অসম সাহিত্য সভার রাধাগোবিন্দ বড়ুয়া প্ৰেক্ষাগৃহে একটি কৰ্মশালার আয়োজন হয়। সেখানে সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্ৰহ থেকে শুরু করে সঠিক খবরটি যাতে সহজ সরল ভাষায় পরিবেশন করা হয় তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এদিনের কৰ্মশালায় বন্যপ্ৰাণী রক্ষা- সংরক্ষণ, মানুষ এবং বন্যপ্ৰাণীর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্ৰে সংবাদ মাধ্যম কি ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে সেই সম্পৰ্কে আলোকপাত করা হয়। বেশ কয়েকজন বন্যপ্ৰাণী বিশেষজ্ঞ, পশুপ্ৰেমী সংগঠনের কৰ্মকৰ্তারা নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন।  

এদিনের আলোচনার মূল বিষয় ছিল ‘ম্যান এনিমেল কনফ্লিক্ট টু কোএক্সিস্টেন্স’। আয়োজক ‘মিডিয়া ফর ওয়াইল্ড লাইফ আসাম’। এদিনের কৰ্মশালায় কি কি আলোচনা হল তারই কিছু টুকরো ছবি ‘নয়া ঠাহর’এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল। প্ৰতিবেদনটি তৈরি করেছেন পোৰ্টালটির সহযোগী সম্পাদক রিংকি মজুমদার



ট্ৰাস্টি, ওয়াইল্ড লাইফ ট্ৰাস্ট অব ইন্ডিয়া তথা মিডিয়া ফর ওয়াল্ড লাইফ-এর মেন্টার ড০ পরিমল ভট্টাচাৰ্য বলেন- জলাভূমি হচ্ছে পরিবেশ তন্ত্ৰের প্ৰধান উপাদান। আমাদের চারপাশে জলাভূমি ক্ৰমশ কমে যাচ্ছে। জলাভূমিকে তিনি প্ৰকৃতির কিডনি (বৃক্ক) বলে সম্বোধন করেছেন। ঠেক সেইভাবে গণ্ডার রক্ষার জন্যও সচেষ্ট হতে হবে। সেইসঙ্গে বলেন- বহু বন্য জীবজন্তুর জন্য ঘাস ভাতের মতো। তাই ঘাস রক্ষা করতে পারলে পোকা-মাকড়ও বাঁচবে।


পশুপ্ৰেমী সংগঠন ‘আরণ্যক’এর প্ৰতিষ্ঠাপক ডঃ বিভব তালুকদার জানান- হাড়গিলা এমন একটি প্ৰজাতির পাখি যার সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই প্ৰজাতির পাখিটির সংরক্ষণে অসমের বিভিন্ন গ্ৰামে মানুষ নিজেদের মতো করে সহযোগিতা করছে। নিজেদের বাড়িতে উঁচু গাছে রাখছে। কোনও পাখি মরে গেলে গ্ৰামবাসীরা দুৰ্গন্ধ সহ্য করছে। তাদের জন্যই এই পাখিগুলো বেঁচে আছে।
২০০২ সালে ‘দেও হাস’ কে রাজ্য পক্ষী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই হাসের সংখ্যা প্ৰায় ৩০০র কাছাকাছি রয়েছ । এটি শুধু অসম এবং অরুণাচলপ্ৰদেশেই দেখা যায়। তিনি আরও জানান- অসমে দিন দিন বনাঞ্চল হ্ৰাস পাচ্ছে। যা বৰ্তমানে খুবই চিন্তার বিষয়। তার ওপর বন্য জীবজন্তুর অবৈধ ব্যবসা গোটা বিশ্বের অপরাধগুলির মধ্যে চার নম্বরে রয়েছে। বাঘ, গণ্ডার, হাতি, হরিণের চামড়া বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। তাই নিরীহ প্ৰাণীগুলেকে অবৈধভাবে হত্যা করে পাচার করা হয়। তবে তিনি এও বলেন - বৰ্তমানে অসমে গণ্ডার হত্যা আগের তুলনায় কমেছে। এটা একটা ইতিবাচক খবর।

তিনি বলেন- সাধারণ মানুষের কাছে যাতে সঠিক তথ্য যায় তার জন্য তাদের সংগঠনের কৰ্মকৰ্তারা সংবাদ মাধ্যমকে সবসময় সহযোগিতা করার জন্য প্ৰস্তুত। 


এদিনের অনুষ্ঠানে জৈব বৈচিত্ৰ বিশেষজ্ঞ ‘হেরিটেজ হিরো’ সম্মান প্ৰাপ্ত ড০ বিভূতি প্ৰসাদ লহকর বলেন- খাদ্য, বাসস্থানের অভাবের জন্য বন্যপ্ৰাণী এবং মানুষের মধ্যে সংঘাত বাড়ছে। বলেন- বনাঞ্চল কমে যাওয়ার ফলে বন্যপ্ৰাণীরা জনাঞ্চলে এসে ভিড় করছে। আমাদের প্ৰত্যেকের জল সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।

জয়েন্ট ডিরেক্টর ওয়াইল্ড লাইফ ট্ৰাস্ট অব ইন্ডায়া ড০ রথিন বৰ্মন বলেন হাতি এবং মানুষের সংঘাত নিয়ে। তিনি হাতিকে অবাধ্য এবং উগ্ৰ সন্তানের সঙ্গে তুলনা করে বলেন- চা বাগান কিংবা লোকালয় থেকে হাতি তাড়াতে আমরা সবসময় হাতে টৰ্চ কিংবা পটাকা-বাজি, নয়তো বা মশাল ব্যবহার করি। এই সব দেখতে দেখতে হাতিকুলও অভস্ত হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে হাতিদের মন থেকেও ভয় বলে যে একটা কিছু আছে তা চলে গেছে। ওদের মগজেও একটা জিনিস স্ট্ৰাইক করে- টৰ্চ তো মারবেই, বাজি তো ফাটাবেই। এই ব্যাপারটিকে তিনি অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও বলেন- আমরা যেমন ঝড়কে থামিয়ে রাখতে পারি না ঠিক তেমনি কোথাও যাওয়া হাতির দলকেও ঠেকাতে পারা যাবে না। ঠেকাতে গেলেই মানুষের জন্যও বিপদ, হাতির জন্যও বিপদ। হাতি দীৰ্ঘদিন ধরে একই জায়গায় থাকে না। কারণ হাতি একদিন প্ৰচুর খায়। সেখানের ঘাস বা খাদ্য শেষ হয়ে গেল তারা দল বেধে অন্য জায়গায় চলে যায়। আবার দীৰ্ঘদিন পর সেই একই জায়গায় ফিরে আসে ততদিনে সেখানে ঘাস বা হাতির খাদ্য প্ৰাকৃতিক ভাবে উৎপন্ন হয়ে যায়।

  ডব্লিউডব্লিউএফ-এর বায়োলজিস্ট তথা হস্তি বিশেষজ্ঞ হিতেন বৈশ্য - হাতি এবং মানুষের সংঘাতের বিভিন্ন কারণ সুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি জানান- অসমের কিছু কিছু অভ্যন্তর এলাকা আছে যেখানে হাতে টৰ্চ এবং বাজি নিয়ে হাতি তাড়াতে গেলে হাতি উল্টো মানুষের দিকে তেড়ে আসে। তার কারণ একটিই- হাতি তাড়াতে বারেবারে একই অস্ত্ৰ টৰ্চ আর বাজি ব্যবহার করার ফলে হাতিদেরও ভয় কমে গেছে। ওরা জেনে গেছে যে টৰ্চের পেছনে একটি মানুষ আছে, বাজির পেছনে মানুষ আছে । হাতি তেড়ে এলে মানুষ ভয়ে পালায়, এই ব্যাপারটি হস্তিকুলও মজা পেতে শুরু করেছে। তাছাড়া বিভিন্ন গ্ৰামে গঞ্জে চাষের ক্ষেতে হাতির উপদ্ৰব ঠেকাতে বৈদ্যুতিক তারের ব্যবহার করা হয়। তাতে হাতি যতটা না মরেছে তার থেকে বেশি  মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় ব্যাটারি এবং ইনভাৰ্টার দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ করা হয় তা আরও ভয়ানক। 


চিফ অব আসাম এলিফেন্ট ফাউন্ডেশন কৌশিক বড়ুয়া বলেন- আমাদের বায়োলজিক্যাল প্ৰয়োজন হচ্ছে মাটি। আমাদের চারপাশে সবুজ পরিবেশ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হাতি বাঁচবে যদি রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকে। হাতির বাঁচার জন্য প্ৰয়োজনীয় জঙ্গল এবং ওদের বেঁচে থাকার পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

এদিনের অনুষ্ঠানে জেষ্ঠ সাংবাদিক সমুদ্ৰ গুপ্ত কাশ্যপ বণ্যপ্ৰাণী সংক্ৰান্ত সংবাদ পরিবেশনের সময় সাংবাদিকদের ভূমিকা এবং সংবাদ লেখার সময় কি কি সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত সে সম্পৰ্কে পরামৰ্শ দেন।

একই বিষয় শোনা যায় জেষ্ঠ্য,সাংবাদিক প্ৰণয় বরদলৈয়ের কথাতেও। সংবাদ পরিবেশনের সময় কিছু কিছু শব্দের ব্যবহার নিয়ে অসন্তুষ্টি প্ৰকাশ করেন তিনি। যেমন- লোকালয়ে চিতাবাঘ বের হলে কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যমে হেডলাইন আসে ‘বনরজার তাণ্ডব’। যা কোনওভাবেই সঠিক নয়। তাই শব্দ চয়নের ক্ষেত্ৰে সাংবাদিকদের আরও সচেতন হওয়া উচিত বলে তিনি উল্লেখ করেন।

জেষ্ঠ্য সাংবাদিক মৃণাল তালুকদার বলেন- বন্যপ্ৰাণী রক্ষাৰ্থে সাংবাদিকদের যতখানি সহযোগিতা করা যায় তা করা উচিত। তিনি রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বনাঞ্চলের ভৌগলিক বিষয় নিয়েও আলোচনা করেন। আমাদের চারপাশে প্ৰকৃতির জল শুকিয়ে যাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে গুয়াহাটিতেও জলযুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এখন থেকেই সাধারণ মানুষকে জল নিয়ে আরও সচেতন হওটয়া উচিত বলে উল্লেখ করেন। আমাদের সকলের যতখানি সম্ভব বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে ব্যবহার করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

এদিনের কৰ্মশালায় বিভিন্ন ওয়েব পেপার, পোৰ্টাল, ম্যাগাজিন থেকে প্ৰায় ২০ জনেরও বেশি সাংবাদিকের উপস্থিতি ছিল। সাংবাদিক তথা পশুপ্ৰেমী মুবিনা আখতার, সাংবাদিক দেবযানী পাটিকর ছাড়াও আরও বহু বিশিষ্ট ব্যাক্তিবৰ্গ উপস্থিত ছিলেন। এদিনের কৰ্মশালা নতুন প্ৰজন্মকে প্ৰকৃতি এবং বন্যপ্ৰাণী সংক্ৰান্ত সংবাদ সংগ্ৰহ এবং পরিবেশের ক্ষেত্ৰে কিছুটা হলেও দিশা দেখাবে বলে মনে করা হচ্ছে। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.