Header Ads

‘অসম লেখিকা সংস্থা’-র উপদেষ্টা হরপ্ৰিয়া বারুকিয়াল বরগোহাঁইর সঙ্গে কিছুক্ষণ

তিনি চার কৃতী সন্তানের মা । তিনি ২০১৬ সালে সাহিত্য একডেমী পুরস্কার প্ৰাপ্ত হরপ্ৰিয়া বারুকিয়াল বরগোহাঁই। সাহিত্যিক যতীন্দ্ৰ কুমার বরগোহাঁইর স্ত্ৰী। বহু কষ্ট, ঘাত প্ৰতিঘাত অতিক্ৰম করে গত ৪৪ বছর ধরে প্ৰতিপালন করে আসছেন মহিলাদের সংগঠন ‘অসম লেখিকা সংস্থা’। ঘর সংসার সামলে মেয়েদের মানসিক তথা বৌদ্ধিক বিকাশের লক্ষ্যে একটি সংগঠন চালানো সহজ কথা নয়। এই সংস্থা দেখিয়ে দিয়েছে যে বৌদ্ধিক বিকাশের ক্ষেত্ৰে শুধুমাত্ৰ পুরুষই নয়, নারী সমাজও সমানভাবে দক্ষতা দেখাতে পারে। রাজ্যের আভ্যন্তরীন গ্ৰামে গঞ্জের বহু নারীকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে ‘অসম লেখিকা সংস্থা’। 

এতো ঘাত প্ৰতিঘাত সহ্য করে কিভাবে মেয়েদের একটি প্ৰতিষ্ঠানকে এতদূর এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। সেই স্মৃতিমাখা দিনগুলির কথা বললেন ‘নয়া ঠাহর’এর সহযোগী সম্পাদক রিংকি মজুমদারের সঙ্গে।


সংস্থার কাজ কৰ্ম এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছেন রাজ্যের সহস্ৰাধিক প্ৰখ্যাত এবং স্বল্প পরিচিত  লেখিকা। যারা একাধারে মা, বোন, মেয়ের পাশাপাশি সংস্থার সদস্যা এবং লড়াকু কৰ্মী। বৰ্তমানে হরপ্ৰিয়া বারুকিয়াল বরগোহাঁই ‘অসম লেখিকা সংস্থা’-র উপদেষ্টার পদে রয়েছেন।  জীবনে এমন সময়ও পেরিয়ে এসেছেন- সংস্থার কাজে সন্তান কোলে মাইক হাতে নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। সামনেই আন্তৰ্জাতিক নারী দিবস। এতো বছর পুরনো মহিলা সংগঠনটির কথা ওয়েব পোৰ্টালটির পাঠকদের কাছে তুলে ধরতেই এই প্ৰতিবেদন। 

  •   ১৯৭৬ সালে ‘ অসম লেখিকা সন্থা’ গঠন হয়। ওই বছরই মে মাসে একটি সভা হয় সেখানে কাৰ্যনিৰ্বাহী সমিতি গঠন হয়। তখন সমিতির প্ৰতিষ্ঠাপক সভানেত্ৰী দায়িত্ব নিয়েছেন সাহিত্যিক তথা সমাজসেবী শুচিব্ৰতা রায়চৌধুরী। শুধু লেখিকাদের জন্য একটা সংস্থার প্ৰয়োজন রয়েছে, এই ধারনাটি কোথা থেকে এল? 

সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার প্ৰাপ্ত হরপ্ৰিয়া বারুকিয়াল বরগোহাঁই

১৯৭৫ সালে নারী বৰ্ষ উপলক্ষে ১, ২ এবং ৩ জানুয়ারি অসমের তেজপুরে লেখিকাদের একটি সমারোহ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে নামি দামী বহু লেখিকা এসেছিলেন। লেখিকা সংস্থার প্ৰয়োজন রয়েছে এই ধারনা সেখান থেকেই আসে। প্ৰখ্যাত লেখিকা প্ৰীতি বড়ুয়া, নীলিমা দত্ত, শুচিব্ৰতা রায়চৌধুরী সমেত আরও অনেকের তৎপরতায় প্ৰথমে লেখিকা পরিষদ গঠন হয়। পরিষদের সভানেত্ৰী ছিলেন পুষ্পলতা দাস। অ্যাকটিং প্ৰেসিডেন্ট ছিলেন শুচিব্ৰতা রায়চৌধুরী। ভাইস প্ৰেসিডেন্ট ছিলেন ইন্দুপ্ৰভা বড়ুয়া, ইন্দিরা মিরি, নীলিমা দত্ত, উষা দাস, হেনা বরা। সাধারণ সম্পাদিকা ছিলেন প্ৰীতি বড়ুয়া। 

এরপর ১৯৭৬ সালে ৫ মে ‘অসম লেখিকা সন্থা’ গঠন হয়। ওই বছরই ১৬ মে সংস্থার পূৰ্ণ কাৰ্যনিৰ্বাহ সমিতি গঠন হয়। সংস্থার সংবিধান গৃহীত হয়। সে সময় সন্থার অ্যাকটিভ প্ৰতিষ্ঠাপক সভানেত্ৰীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন সাহিত্যিক তথা সমাজসেবী শুচিব্ৰতা রায়চৌধুরী।  সাধারণ সম্পাদিকা ছিলেন প্ৰীতি বড়ুয়া। ১৯৮৬ সালে গুয়াহাটিতে ভারতীয় লেখিকা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে নামী দামী লেখিকারা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার প্ৰাপ্ত ৬ জন লেখক লেখিকারা এসেছিলেন। 
এরপর ২০০৭ সালে  শংকরদেব কলাক্ষেত্ৰে উত্তরপূৰ্ব লেখিকা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উত্তরপূৰ্বের আটটি রাজ্যের লেখিকারা এসেছিলেন। অরুণাচল থেকে প্ৰখ্যাত লেখিকা মামাং ডাই এসেছিলেন। নান্নি ডাই আসতে পারেননি, তবে তিনি কবিতা লিখে শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন। মেঘালয় থেকে এসেছিলেন আলভারিন ডখার, মণিপুর থেকে এসেছিলেন শিলা রমনি সুনখাম এবং মায়া নেপ্ৰাং, নাগাল্যান্ড থেকে এসেছিলেন ড০ লিমাটুলা, সিক্কিম থেকে শান্তি ছেত্ৰী। মিজোরাম এবং ত্ৰিপুরা থেকেও লেখিকারা কবিতা এবং চিঠিতে শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন। সকলেই নিজেদের বহুমূল্য বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন। অনুষ্ঠানে  ‘উত্তরপূৰ্বের সংহতিতে নারীর ভূমিকা’শীৰ্ষক আলেচনা হয়েছিল।

 সাংবাদিক সম্মেলনে ‘অসম লেখিকা সংস্থা’র সদস্যারা

  •   লেখিকা সংগঠন এখনও পৰ্যন্ত কি কি কাজ করেছে?

মেয়েদের শুধু ঘর সংসার গোছানো, সন্তানের জন্ম দেওয়াই জীবনের একমাত্ৰ লক্ষ্য হতে পারে না। অসমের অভ্যন্তরীন প্ৰত্যন্ত অঞ্চলে মহিলাদের সঙ্গে দেখা করে লেখালেখির মাধ্যমে তাদের ভেতরের সুপ্ত প্ৰতিভার বিকাশের জন্য উৎসাহ দিয়েছেন অসম লেখিকা সংস্থার সদস্যরা। এছাড়াও রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কৰ্মশালা করেছেন সংস্থার সদস্যারা। বানান নিয়ে কৰ্মশালা করেছেন। তাছাড়া শুরু থেকেই সংস্থা শিশু সাহিত্যের বিকাশ এবং প্ৰকাশের ওপর গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। মহিলা নাট্যকার সৃষ্টি করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
১৯৮৪ সালে   প্ৰীতি বড়ুয়ার সম্পাদনায় মাসিক পত্ৰিকা ‘আকাশ’ বের হয়। যেখানে সাহিত্যিক হোমেন বরগোহাঁই লিখতেন। মহিলা নাট্যকার সৃষ্টির জন্য চারদিনের কৰ্মশালা আয়োজন করা হয়েছিল। হরপ্ৰিয়া বারুকিয়ালের কথায়- ‘‘আমাদের সংগঠনে আসতে হলে কিছু না কিছু লিখতেই হবে। একেবারে কিছুই না লিখলেও রান্নার রিসিপি হলেও লিখতে হবে। মোট কথা হাতে কলম ধরতেই হবে। রাজ্যের মেয়েদের কিভাবে মানসিকভাবে উন্নত করা যায় তার জন্য আমরা বহু চেষ্টা করেছি। সমাজে অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা সবসময়ই প্ৰতিবাদ করেছি। আমাদের একটা প্ৰতিবাদী সত্ত্বা রয়েছে।’’

  • ভারতের মতো দেশে আজ থেকে ৪০-৪৫ বছর আগে মেয়েদের বাইরে স্বাধীনভাবে চলাফেরার ক্ষেত্ৰে কত নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেইরকম সময়ে আপনাদের সংগঠন ঘরে ঘরে মেয়ে, বউদের কিছু লেখার জন্য কিভাবে উৎসাহ জুগিয়েছেন?  

অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তখন আমি ‘অসম লেখিকা সংস্থা’র সম্পাদিকা ছিলাম। গ্ৰামে গ্ৰামে পায়ে হেটে ঘুরেছি। এমন এমন সব জায়গায় গিয়েছিলাম যেখানে বাড়ির মধ্যে শৌচালয় পৰ্যন্ত ছিল না। প্ৰকৃতির ডাক এলে বহু দূরে মাঠের মাঝখানে জলাভূমির মধ্যে ঘেরাও করা বাঁশের শৌচালয় ছিল। সেখানে গিয়ে শৌচ কার্য করতে হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় বাড়ির পুরুষেরা যখন বুঝতে পারলেন যে এভাবে মেয়েদের ঘরের মধ্যে আটকে রাখা উচিত নয়। তখন তারাই মহিলাদের শৃংখল ভেঙে বেড়িয়ে আসতে সাহায্য করেছে। 

 ১৯৯৫ সালে ওদালগুরি অনুষ্ঠানে বিটিএডি এলাকায় সেখানে কেউই যায় না। নিৰ্জন এলাকা।  প্ৰতিভা শহরিয়া নামে একজন শিক্ষয়িত্ৰী বাঙালি, নেপালী, হিন্দিভাষী, বোড়ো মিলিয়ে বিভিন্ন ভাষাভাষীর ২ শতাধিক মহিলাকে একত্ৰিত করেছিলেন। এটা কি কম বড় কথা?  তখন মেয়েরা বুঝতে পারেছে যে ঘরের ভিতরে ঢুকে থাকলে হবে না। বেড়িয়ে আসতে হবে।
এইডস-এর সম্পৰ্কে সচেতনতা বাড়াতে আমরা কৰ্মশালা করেছি। স্বাস্থ্যের প্ৰতি যত্নশীল হতে সচেতনতা সভা করেছি। গ্ৰামে গ্ৰামে ঘুরেছি মেয়েদের অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোর পথে আনার জন্য। শুধু লেখাই কাজ নয়, বিভিন্ন জায়গায় কৰ্মশালা করেছি, সমাজ সেবা, সমাজে অন্যায়ের প্ৰতিবাদ করেছি।

বছর কয়েক আগে নাবালিকা বৰ্ণালি হত্যার ঘটনায় গুয়াহাটির পল্টন বাজারের নেটওয়াৰ্ক বাসস্ট্যান্ডের সামনে ঘটনার  প্ৰথম প্ৰতিবাদ করেছে লেখিকা সংস্থা এবং নারী অধিকার মঞ্চ । এই দুই সংগঠন মিলে নেটওয়াৰ্ক কাউন্টার বন্ধ করে দেয়। আমাদের ডাকা বনধের আহ্বানে পরের দিন গোটা গুয়াহাটি বনধ দিয়েছিল। ওই ঘটনায় লেখিকা সংস্থার সমৰ্থনে প্ৰায় ৫৫ টি সংগঠন একত্ৰিত হয়। তারপরই ‘নিৰ্যাতন বিরোধী ঐক্য মঞ্চ অসম’ গঠন হয়। যে কোনও ক্ষেত্ৰে সংস্থার একটি প্ৰতিবাদী সত্ত্বা আছে।
২৫ বছর হওয়ার পর ‘অসম লেখিকা সন্থা’ নাম সংশোধন করে ‘অসম লেখিকা সংস্থা’ করা হয়। সংস্থার শুধু কেন্দ্ৰীয় সমিতিই নয় রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় শাখা সমিতিও রয়েছে। গ্ৰাম গঞ্জে মহিলাদের থেকে লেখা সংগ্ৰহ করে ত্ৰৈমাসিক  পত্ৰিকা ‘অৰ্ধ আকাশ’-এ ছাপানো হয়।

  • এতোদিনের পুরনো একটি সংগঠন। অথচ এখনও পৰ্যন্ত স্থায়ী কোনও কাৰ্যালয় না থাকার নেপথ্যে কারণ কী? 

হয়তো আমাদের সমাজ এখনও মেয়েদেরকে সেকেন্ড সিটিজেন হিসেবেই দেখছে। ওপরে ওপরে দেখলে সব কিছু ঠিকঠাকই মনে হয়। মেয়েদের আরও ডিটারমাইন্ড হতে হবে। আরও সচেতন হতে হবে।  সংস্থার বিকাশের জন্য নিরন্তর চিন্তাচৰ্চা, সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করে আলোচনা করে যাচ্ছি।  প্ৰয়োজন হলে বিষয়টি নিয়ে অসমের মুখ্যমন্ত্ৰীর সঙ্গে কথা বলার চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে।

সংস্থার আৰ্থিক উন্নতির জন্য ২০০৭ সাল থেকে ‘অসম লেখিকা সংস্থা’ পেট্ৰন নিতে শুরু করে। সংস্থার সদস্যরা ভাবেন অনুষ্ঠান করার জন্য মানুষের কাছ থেকে টাকা পয়সা চাওয়ার থেকে নিজেদের মধ্যে থেকে পেট্ৰন নেওয়াই ভালো। কিন্তু শুধু মহিলা। প্ৰথম পেট্ৰন হন মৃনালিনী দেবী। এখন পৰ্যন্ত ১০০ জনের বেশি পেট্ৰন রয়েছেন। সংস্থার ভেতরের সদস্য হলে ৫ হাজার, এবং বাইরের কেউ যদি পেট্ৰন হতে চান তাহলে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। সংস্থাকে চালাতে অৰ্থের প্ৰয়োজন। আর সেই অৰ্থ জোগার করতে পরবৰ্তীকালে সংস্থার পৃষ্ঠপোষক এবং আজীবন সদস্যাও নেওয়া হয়।

  ‘অসম লেখিকা সংস্থা’র আজীবন সদস্য এবং পৃষ্ঠপোষক সম্মেলনের মুহূৰ্ত ক্যামেরাবন্দী করে রাখা হয়েছে।

ত্ৰৈমাসিক পত্ৰিকা ‘অৰ্ধ আকাশ’ ১৩ বছর হয়েছে। ২০০৭ সালে প্ৰথম প্ৰকাশ হয়। প্ৰথম দুবছর আন্তৰ্জাতিক নারী দিবসের দিন ৮ মাৰ্চ ম্যাগাজিন হিসেবে বের করা হয়েছিল।  তারপর থেকে ত্ৰৈমাসিক হিসেবে পত্ৰিকা বের হচ্ছে। সমাজের মেয়েদের বিকাশে আরও অনেক কিছু করার আছে সংস্থার।
অসম লেখিকা সংস্থা আরও উন্নতি হোক, সংস্থার হাত ধরে আরও নতুন প্ৰতিভার বিকাশ হোক, এই শুভেচ্ছা দিয়ে এদিনকার মতো আমাদের কথোপকথন শেষ হয়।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.