বনধ্ রাজনীতির বে-আক্কেলে অঙ্ক !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ঃ
দেশের ১৮টি শ্রমিক সংগঠন বুধবার সারা দেশব্যাপী বনধ্ ডেকেছিল। এই ১৮ টি শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে তৃণমূল ও বিজেপি’র শ্রমিক সংগঠন ছিল না। বিজেপি যেখান পেরেছে যতটা পেরেছে বনধ্-এর বিরোধিতা করেছে। তৃণমূলের সমস্যা শুধু এই রাজ্য নিয়ে। কাজেই তারাও বনধ্ সমর্থন করছে না জানিয়ে একটু টুইস্ট করেছে--আমরা ইস্যুকে সমর্থন করছি কিন্তু বনধ্ নয় ! এই টুইস্টের জরুরি আবশ্যকতা ছিল। কারণ বনধ্ ছিল বিজেপি’র জনস্বার্থ বিরোধী অবস্থানের বিরুদ্ধে। বিজেপি’র বিরুদ্ধে বনধ্-এর সরাসরি বিরোধিতা করা তৃণমূলেনর পক্ষে এই মুহূর্তে সম্ভব নয়--কারণ, মানুষের কড়া নজর ছিল তৃণমূলের দিকে--সুতরাং ইস্যু’র প্রতি সমর্থন, তবে তা বনধ্-এর বিপক্ষে থেকেই ! তৃণমূলের এই হাস্যকর রাজনৈতিক টুইস্ট শুধুমাত্র তাদের অন্দরমহলেই বেজায় একটা রাজনৈতিক বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ হিসেবে সমর্থিত হবে। রাজ্যের মানুষ যা বোঝার তা বুঝে গেছে নিশ্চয়ই।
তৃণমূল এখন গভীর সমস্যায় প্রায়শঃই বিচলিত হচ্ছে। এই বিচলনের কারণেই তারা যে দলের বিরুদ্ধে অল-আউট যুদ্ধ করে (এবং এক ও একমাত্র শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে) বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় বসেছে সেই সিপিএমকেও বেকায়দায় পড়ে সমর্থন করতে হচ্ছে নানান ইস্যুতে--বিশেষ করে যাদবপুর-জেএনইউ’র ঘটনায়। কেন্দ্রে যদি বিজেপি’র বদলে ইউপিএ সরকার থাকত (সিপিএমের সমর্থনে) তাহলে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নিয়ে তৃণমূলকে তীব্র বামবিরোধী ভূমিকায় দেখা যেত--কোন সংশয় নেই এতে। আজকের বনধ্-এও তৃণমূলকে রাস্তায় নেমে সক্রিয় বিরোধিতা করতেই হত--এটাই রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। বিজেপি এখন সিপিএম-কংগ্রেসকে সরিয়েএক নম্বর শত্রুর জায়গায় উঠে এসেছে। এখন বিজেপি বিরোধিতাই তৃণমূলের এক ও একমাত্র রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। যে কোন ইস্যুতে তৃণমূল বিজেপি বিরোধিতায় একনম্বরে থাকবেই এবং যারা একদা তাদের ঘোর শত্রু ছিল তাদের বিজেপি বিরোধিতার পাশে না থাকার ঝুঁকি নিতে পারবে না।
মানুষ এই রাজনীতি বোঝে না তা নয়--খুব ভাল করেই বোঝে। কিন্তু মুশকিল ও বিপদ হয়--যখন বিজেপি বিরোধিতায় আমি পিছিয়ে পড়ছি--এই নিরাপত্তাহীনতার অস্থিরতা তৈরি হয় তখনই। বিরোধিতারও কিছু শ্রেণীগত ও চরিত্রগত পার্থক্য থাকে। সেগুলো ঠিকঠাক না বুঝে যে কোন ইস্যুতে বিজেপি বিরোধিতা আখেরে ব্যুমেরাং হয়ে উঠতে পারে--হয়ে উঠতে পারে ব্ল্যাকমেলিংয়ের যোগ্য হঠকারিতা যার চড়া মাশুল গুণতে হতে পারে। সিদ্ধান্তহীনতার নজির তৈরি হতে পারে--যেমনটা হল আজকের বনধ্ নিয়ে। গোটা রাজ্যে আজ তৃণমূলের বনধ্ সংক্রান্ত বিস্ময়কর ভূমিকা মানুষকে হতচকিত করে দিয়েছে। যারা আজ সারাদিন টিভিতে চোখ রেখেছিলেন তাদের কিছু বুঝতে অসুবিধে হয় নি। বাম-কংগ্রেস চেয়েছিল তৃণমূল প্রশাসনিক ও দলীয় তৎপরতায় বনধ্ বিরোধী ভূমিকা পালন করে প্রমাণ রাখুক তাদের বিজেপি বিরোধিতার মধ্যে সততা নেই। মালদহ সহ বিক্ষিপ্ত ভাবে যেসব ঘটনা ঘটতে দেখা গেল তাতে কিছুটা হলেও বাম-কংগ্রেসের যে মনোবাসনা অনেকটাই পূরণ হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া গেল সুমন মাষ্টারের ঘন্টাখানেক সহ বিভিন্ন দাদামণি-দিদিমণিদের টিভি-বৈঠকখানায়। রাজনৈতিক ইস্যু সমর্থন করে যে কোন যুক্তিতেই সেই ইস্যুভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মসূচীর বিরোধিতা করা যায় না--এটা বুঝলে আজ যা হল তা হত না। বাম-কংগ্রেস বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নে যে মাইলেজ পেয়ে গেল তা বলতে গেলে তৃণমূলেরই নির্বোধ দান !
বাম-কংগ্রেস উভয়েই এ রাজ্যে তীব্র রক্তশূন্যতায় ভুগছে--উভয়েরই লাল-সবুজ শরীর প্রায় সাদা হয়ে গেছে--তবু উভয় উভয়কে পাশাপাশি বেডে শুয়ে রক্ত দানের চেষ্টা করে চলেছে। যদি তাদের রঙ দেখে মানুষ ফের চিনতে পারে। এদের শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়বে কিনা তা ঈশ্বরই বলতে পারেন। তবে এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে এ রাজ্যে তৃণমূলই তাদের যেমন কোমায় পাঠিয়েছে তেমনই বিজেপিকেও এ রাজ্যে তারাই প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিকতা দিতে পেরেছে সাফল্যের সঙ্গে। এর যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে তার মূল্য বাম-কংগ্রেস মেটাবে না--তৃণমূলকেই মেটাতে হবে।
তৃণমূলের অসীম সৌভাগ্য এটাই যে এ রাজ্যে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ দলের ক্যাপটেন শ্রীমান দিণীপ ঘোষের মতো নেতা। শুধু এ রাজ্যেই নয়--বহু রাজ্যেই আরএসএস মনোনীত নেতাদের কারণেই বিজেপিকে ভীষণভাবে ভুগতে হচ্ছে এবং হবেও। সঙ্ঘ সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠন যে এক বস্তু নয় এটা বিজেপির কেষ্টবিষ্টুরা এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না বলেই রক্ষে--না হলে সব ক’টি রাজ্যই বিজেপি’র খাসতালুকে পরিণত হত। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রধান দুটি দলের একটি বিজেপি এখন বিপুল ক্ষমতায় ক্ষমতাসীন। দেশের আঞ্চলিক দলগুলোকে সুকৌশলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে বিজেপি বিরোধিতার কেন্দ্রীয় ভরটিকে একেবারে তছনছ করে দিতে পারার জন্যেই বিজেপিকে লোকসভা নির্বাচনে হারানো যাচ্ছে না। কিন্তু রাজ্যের নির্বাচনে বহুক্ষেত্রেই বিজেপি সঙ্ঘ’র বেছে দেওয়া নেতাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার কারণে বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারছে না। ফলে দিলিীপ ঘোষদের মতো নেতাদের রাজ্য সভাপতি করতে হচ্ছে--সাত বার লোকসভা নির্বাচনে গো-হারা হারলেও রাহুল সিনহাদের মতো নেতাদের রাজ্যে প্রভূত ক্ষমতাশালী করতে হয়। এই বিজেপিকে নিয়ে তাই ভয় পাওয়ার কিছু না থাকলেও মমতাকে আত্মবিশ্বাস হারাতে হয়--প্রশান্ত কিশোরের মতো কর্পোরেট মস্তিষ্কের কাছে সাহায্য চাইতে হয় ! এটই রাজ্য বিজেপির কাছে অনেকটাই নৈতিক জয় হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। যে কোন বিজেপি বিরোধী ইস্যু মানেই যে নিজেদের নীতিগত অবস্থান ভুলে যার-তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়া নয় এটা ভেবে দেখার মতো অবস্থায় নেই তৃণমূল। ফলে একের পর এক প্রচুর ভুল হয়েছে এবং হচ্ছে--যার সংশোধন হচ্ছে না। তাই এই আশঙ্কাটা কাজ করতেই পারে যে--কিছু না থাকলেও যে বিজেপি এরাজ্যে তৃণমূলের বিপুল দাপটকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে ১৮ টি আসন দখল করতে পারে সেই বিজেপি বিধানসভা নির্বাচনে শ’খানেক আসনও পাবে না--এটা কি নিশ্চয় করে বলা সম্ভব? তৃণমূল নিজেই নিজের পরিস্থিতি বেদম জটিল করে তুলেছে। এ জট প্রশান্ত কিশোরের পক্ষে ছাড়ানো সম্ভব হবে কিনা সেটাই এখন দেখার !










কোন মন্তব্য নেই