সিএএ-এনআরসি নয় ঝাড়খণ্ডে বিজেপি হেরেছে নির্বুদ্ধিতা ও আকাশচুম্বি আত্মতুষ্টির কারণে !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ঃ
পশ্চিমবঙ্গের নিকটতম প্রতিবেশি রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দলের প্রবল সিএএ-এনআরসি বিরোধিতার হাওয়ায় ঝাড়খণ্ডে বিজেপি খড়কুটোর মতো উড়ে গেছে--এই কথাটা লিখতে পারলে অন্য অনেকের মতোই আমিও দারুণ খুশি হতে পারতাম। কিন্তু লজ্জার মাথা খেয়ে সেটা লিখতে পারছি না। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল যে কটা আসনে ঝাড়খণ্ডে নিজেদের সর্বভারতীয়ত্ব প্রমাণের জন্যে লড়াইতে ছিল তার ফল নোটায় যে ভোট পড়েছে তাকেও ছুঁতে পারে নি।
ইয়েচুরি সাহেবদের অবস্থাও করুণতর। শিল্পাঞ্চল হওয়ার কারণে এক সময়ে ঝাড়খণ্ডে সিপিআই-সিপিএম তথা বামপন্থীদের একটা মিনিমাম গ্রহণযোগ্যতা ছিল--কালক্রমে তারা তাদের সেই গ্রহণযোগ্যতা এখানে হারিয়েছে। এখানকার মানুষ আর তাদের দুর্বোধ্য তত্ত্ববাণী শুনতে চায় না--পাত্তাও দেয় না। কাজেই তৃণমূল
ও বামপন্থীরা যদি দু’তিনটি আসনেও বিজেপিকে হারাতে পারত তাহলেও হয়তো মেনে নেওয়া যেতে পারত ঝাড়খণ্ডে বাংলার সিএএ-এনআরসি বিরোধিতার প্রভাব পড়েছে। বাস্তবে সেটা
হয় নি।
দেশের অন্যান্য গো-বলয়ের রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে ঝাড়খণ্ডের রাজনৈতিক চরিত্রের বেশ খানিকটা তফাৎ রয়েছে। এই রাজ্যে জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা ২৬%, তপশীলি জাতির মানুষের সংখ্যা ১২% এবং বাকি ৬২% তুলনায় অনেকটাই বেশি হলেও এ রাজ্যে ২৬% ভোট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় বলেই বিহার ভেঙে ঝাড়খণ্ড তৈরি হওয়ার পর থেকে একমাত্র অ-জনজাতি রঘুবীর দাস ছাড়া আর কোন মুখ্যমন্ত্রীকে দেখা যায় নি যিনি জনজাতি গোষ্ঠীর কেউ নন।
গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র বিশ্বাস হয়েছিল তারা ৬২% লোকের সিংহভাগের ভোটেই ক্ষমতাসীন হতে পেরেছে--এই বিশ্বাস থেকেই তারা রঘুবীর দাসকে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসিয়ে দেয়। খুব স্বাভাবিক কারণেই বিজেপি’র এই সিদ্ধান্ত ঝাড়খণ্ডের জনজাতি গোষ্ঠীর লোকজন ভালভাবে মেনে নিতে পারে নি। সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটল এবারের নির্বাচনে। এবারেও রঘুবীর দাসকে মুখ্যমন্ত্রী প্রোজেক্ট করে বিজেপি ৬২%-এর নৌকায় চেপে নদী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। রঘুবীর দাসের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা সূরজ রাই--শুধু আওয়াজ তোলাই নয় তিনি খোদ রঘুবীর দাসের বিরুদ্ধে জামশেদপুরেই নির্দলপ্রার্থী হিসেবে রঘুবীরকে হারিয়ে দিলেন !
ঝাড়খণ্ডে ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে তাদের আত্মতুষ্টি এতটাই উচ্চগ্রামে বাঁধা ছিল যে, তারা মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের নকশাল প্রভাবিত অঞ্চলে তাদের ভরাডুবির কথাটাও মনে রাখার প্রয়োজন মনে করে নি। ঝাড়খণ্ডের সেই নকশাল প্রভাবিত এলাকাতেই সিংহভাগ জনজাতি গোষ্ঠীর প্রভাব ও ভোট বেশি। জনমুক্তি মোর্চার হেমন্ত সোরেন এই এলাকাতেই বাজিমাত করেছেন। মূলতঃ এইসব এলাকা থেকেই তিনি ৩০ টি আসন দখল করেছেন। বিজেপি হারিয়েছে গতবারের জেতা ১২ টি আসন।
গতবার বিজেপি’র সঙ্গে যারা ছিল সেই জেভিএম এবং আজসু পেয়েছিল মোট ১৪ টি আসন--অর্থাৎ মোট ৫১ টি আসন দখলে নিয়ে বিজেপি জোট সরকার গঠন করেছিল এবং ঝাড়খণ্ডের ইতিহাসে রঘুবীর দাস-ই হলেন প্রথম মুখ্যমন্ত্রী যিনি পুরো ৫ বছর মুখ্যমন্ত্রীত্ব করার সুযোগ পেয়েছেন ! ফলে তাঁরও আত্মতুষ্টি তুঙ্গে উঠে গিয়েছিল। তিনি অন্য দল থেকে নিজের দলে নিয়ে এসেও কাউকে কাউকে টিকিট দিয়েছেন। তাঁর এই নির্বোধ রাজনৈতিক
চাল শেষপর্যন্ত ব্যুমেরাং হয়ে গেল !
কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, সুউচ্চ রামমন্দির নির্মাণ, তিন তালাক রদ, সিএএ-এনআরসি এগুলো বড় নির্বাচনী ইস্যু হয় নি ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনে। নকশাল প্রভাবিত এলাকায় বিজেপি মানুষের ভরসা ও বিশ্বাস অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। রঘুবীর দাসকে ফের মুখ্যমন্ত্রী প্রোজেক্ট করেছে--যা এবারে মারাত্মক ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়াও বিশেষ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে যাদব-মুসলিম ভোটের ওপর নীতিশ ও পাসোয়ানের এককভাবে লড়াই করার সিদ্ধান্তে। জেডিইউ এবং লোকজনশক্তি (৮১ টি আসনের মধ্যে ৪১ টি আসনে মুসলিম-যাদব-তপশীলি জাতির ভোট বেশি) বিজেপিকে বেশ খানিকটা বিপাকে ফেলে দিতে সক্ষম হয়েছে।
অন্যদিকে যে কংগ্রেসের ঝাড়খণ্ডে তেমন কোন প্রভাব প্রতিপত্তি বলতে গেলে কিছু নেই--সেই কংগ্রেস জেএমএম-এর হাত ধরে ঝাড়খণ্ডের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পেল খানিকটা। ঝাড়খণ্ডের বেশ বড় মাপের নেতা যশবন্ত সিনহার ভুমিকাও বিজেপিকে বেশ খানিকটা ধাক্কা দিয়েছে বৈকি ! লালুর আরজেডিও জেএমএম-কংগ্রেসের হাত ধরায় যাদব ভোটের সিংহভাগই জোটের পক্ষে চলে গেছে। ঝাড়খণ্ডের রাজনৈতিক অঙ্ক খুব পরিষ্কার--এখানে সিএএ-এনআরসি’র প্রভাব যদি সেরকম কাজ করত তাহলে আগেই বলেছি--তৃণমূল এই নির্বাচনে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক ফালতু রাজনৈতিক দলের ‘‘সম্মান’’ পেত না।
এর মধ্যেও এককভাবে ভোট শেয়ারিংয়ে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি (৩৬.২%)--অন্যদিকে জেএমএম+কংগ্রেস+আরজেডি মিলিতভাবে পেয়েছে ৩৬.৬% ভোট। বিজেপি+জেভিএম+আজসু মিলিতভাবে পেয়েছে ৪৯.৮% (৩৬.২+৬.৩+৭.৩%) ! এখন দেখতে হবে পরাজিত রঘুবীর দাস লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে হেমন্ত সোরেনকে স্মরণ করিয়ে দিতে বলেন কিনা--‘সাবধানে কথা বলবেন, আপনারা মাত্র ৩৬.৬% ভোট পেয়েছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আপনাদের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে !’ যদি বলেন তাহলে বুঝতে হবে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফ্লোর-নাম্বারের গুরুত্ব ও আবশ্যিকতা সম্পর্কে তাঁর পড়াশোনা একবারেই নেই।
কংগ্রেসের তুর্কিনাচন দেখে মনে হচ্ছে তারা বিশ্বজয় করে ফেলেছে। একবারও ভাবছে না জেএমএম তাদের দিকে হাত না বাড়ালে তাদের অওকাত ছিল না এ রাজ্যে দাঁত ফোটানোর। তারা একবারও ভাবছে না--মধ্যপ্রদেশ-রাজস্থান-ছত্তিশগড়ে বিজেপিকে হারিয়েও ১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপি সুনামি আটকাতে পারল না কেন--কাদের কামড়াকামড়ি খেয়োখেয়ির হাস্যকর রাজনৈতিক অপদার্থতার কারণে বিজেপি পর পর দু’বার কেন্দ্রে বিপুল শক্তি নিয়ে ফিরে এল ! আকাশে ঘুঁষি ছুঁড়ে আর পাগলের মতো বাতেলাবাজি করে যে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না--এটা যতক্ষণ না তাদের মাথায় ঢুকছে ততক্ষণ এইভাবে নাচাকোঁদাটা বন্ধ হবে বলে মনে হয় না !









  
  
কোন মন্তব্য নেই