Header Ads

ক্রুশবিদ্ধ যিশু’র অজানা কথা !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ঃ

ক্রসবিদ্ধ অবস্থাতেই ‘পিতা, এদের ক্ষমা করো’ বলে প্রাণত্যাগ করলেন যিশু। দুপুর ১২টায় ক্রসে গাঁথা হয়েছিল তাঁকে, বিকেল ৩টেয় মৃত্যু। মৃত্যুর কথা শুনে রোমান শাসক পন্টিয়াস পাইলেটও বিস্মিত, ‘সে কী! এত তাড়াতাড়ি!’
ফরিসি ও ইহুদি পুরোহিতেরাও জানাল, হ্যাঁ, যিশু মারা গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর দু’পাশে যে দুই ডাকাতকে ঝোলানো হয়েছিল, তারা এখনও মরেনি। তাড়াতাড়ি মারতে ওদের পা ভেঙে দেওয়া হোক !

রোমান সেনাধ্যক্ষ তাই করল। অতঃপর যিশুর কাছে এসে দেখল, তিনি ইতিমধ্যেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। সে পাশ থেকে যিশুর বুকে একটু বর্শা দিয়ে আঘাত করল, হ্যাঁ। সত্যিই মৃত। অ্যারামাথিয়া অঞ্চলের শিষ্য জোসেফ মরদেহ নামিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের পারিবারিক কবরখানায় তাঁকে সমাহিত করতে গেল। সঙ্গে আর এক শিষ্য নিকোডেমাস। মস্তকি আর অ্যালয়ভেরা... দুই ভেষজে তৈরি প্রায় একশো পাউণ্ড ওজনের এক তৈলাক্ত মিশ্রণ নিয়ে এসেছিল।
এই বাইবেলীয় বর্ণনার ওপর ভিত্তি করেই একের পর এক প্রশ্ন তুলেছেন হোলগার। তিন ঘন্টা ক্রসবিদ্ধ হয়ে কেউ মরে না। দুই দস্যুও মরেনি। এমনকী, পন্টিয়াস পাইলেটও বিস্মিত ! তা, খ্রিস্টিয় ধর্মগুরুরা এ ব্যাপারে ক্রসবিদ্ধ হওয়ার আগের রাতের কথা তুলছেন। যে রাতে যিশুর শরীর চাবুকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল ইহুদি পুরোহিতেরা। মেল গিবসনের ‘দ্য প্যাশন অব দ্য ক্রাইস্ট’ ছবিটা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরাই মনে করতে পারবেন সেই বীভৎস অত্যাচার ! গির্জার বক্তব্য, আগের রাতে অত প্রহারেই দুর্বল ছিলেন যিশু। নিজের ক্রসটাও গোটা রাস্তা বয়ে নিয়ে যেতে পারেননি।
হোলগার অবশ্য থামছেন না। তিনি প্রাচীন রোমান আইন ঘাঁটছেন, ক্রসবিদ্ধ করার আগের রাতে অপরাধীকে ৩৯ ঘা চাবুক মারার নিয়ম ছিল। যিশুর পাশের দুই দস্যুকেও চাবুক মারা হয়েছিল, তারা তো মরল না। বলতে বলতে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ওই রোমান সেনাধ্যক্ষ দু’জনের পা ভেঙে দিল। কিন্তু যিশুর কাছে এসে সে হঠাৎ দয়াপরবশ হয়ে গেল কেন? স্রেফ বর্শা দিয়ে আঘাত, এবং তাও পাশ থেকে ! মনস্তত্ত্ব কী বলে? সে তো সামনাসামনিই আঘাত করবে। তা ছাড়া, মস্তকি আর অ্যালয়ভেরা মাখিয়ে মৃতদেহের সৎকার করতে হবে, এমন কোনও প্রথা সে আমলে ছিল না। বরং ইহুদি প্রথা ছিল, মৃতদেহ জলে ধুইয়ে কবরে রাখতে হবে। এখানে তা তো নয়ই, বরং ঠিক উল্টো। বলতে বলতেই তিনি জানিয়ে দেন, মিশর এবং গ্রিক সভ্যতার আমল থেকে এই ভেষজ মিশ্রণ একটি কাজেই ব্যবহৃত হয়েছে। ক্ষতস্থানের দ্রুত আরোগ্য !
ক্রসে পেরেকবিদ্ধ এক মানুষ। মাথায় কাঁটার মুকুট। তিন ঘন্টা ধরে, চড়া রোদে এ ভাবে থাকার পর তাঁর আরোগ্য সম্ভব? রোম সাম্রাজ্যের প্রথম যুগের ইহুদি ঐতিহাসিক ফ্লাভিয়াস জোসেফাসকে এ বার উদ্ধৃত করছেন হোলগার। ফ্লাভিয়াস জানাচ্ছেন, এক বার এক বিজয় অভিযান সেরে ফেরার পথে তিনি দেখেন, ক্রসে বেশ কিছু লোককে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সেই অসহায়দের তিন জন তাঁর পুরনো বন্ধু। সম্রাটের কাছে তিনি তখনই তাঁদের প্রাণভিক্ষা চাইলেন। রাজ-আজ্ঞায় তিন জনকে নামিয়ে শুশ্রূষা করা হল। দু’জন মারা গেলেন, কিন্তু এক জন বেঁচে রইলেন।
তা হলে? ক্রসবিদ্ধ হওয়া মানেই মৃত্যু, এমনটা নয়। আর শুধু যিশুর কাছে এসে হঠাৎ দয়াপরবশ হয়ে যাওয়া ওই সৈনিক? পুরনো দিনের ইতিহাস ঘেঁটে হোলগার জানাচ্ছেন, ওই সৈনিকের নাম লঙ্গিনাস। পরে কাপাডোকিয়া অঞ্চলের বিশপও হয়েছিলেন তিনি। ওই দয়া তা হলে আচমকা আসেনি? জোসেফাস আর নিকোডেমাস... যিশুর শেষ সঙ্গী এই দু’জন যে রীতিমত প্রভাবশালী ছিলেন, ইহুদিদের যে শক্তিশালী পুরোহিত সংগঠন যিশুকে ক্রসবিদ্ধ করা হোক বলে হইচই তুলেছিল, এঁরা দু’জন সেই সংগঠনের সদস্য ছিলেন, তা বাইবেলেই লেখা আছে। আরও লেখা আছে, দু’ জনেই গোপনে যিশুর শিষ্যত্ব স্বীকার করেছিলেন।
এই জায়গা থেকেই নতুন প্রশ্ন তুলেছেন হোলগার। তাঁর বক্তব্য, দু’ জনেই ক্রস থেকে সাত-তাড়াতাড়ি যিশুকে নামিয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে দেওয়ার ফন্দি এঁটেছিলেন। সঙ্গে নিয়েছিলেন লঙ্গিনাসকেও। সে কারণেই ওই রোমান সেনানীর হঠাৎ এত দয়া !
কিন্তু বাইবেলের সেই চিরন্তন পুনরুত্থান? তিন দিন পরে মৃত্যু থেকে উঠে এলেন যিশু, দেখা দিলেন অনুগামীদের? এ বার বাইবেল থেকেই যিশুর শিষ্যা মেরি ম্যাগদালেনের উক্তি তুলে আনছেন হোলগার। ভোরবেলায় সেই কবরখানায় গিয়ে মেরি ম্যাগদালেন দেখলেন, মৃতদেহটা আর নেই। ছুটতে ছুটতে তিনি পিটার আর জনকে গিয়ে জানালেন, ‘ওরা প্রভুকে নিয়ে গিয়েছে। জানি না, কোথায়।’ হোলগারের বক্তব্য, কী আশ্চর্য! কবর চুরি হলে কেউ কি এ ভাবে কথা বলে? কবর-চোর কোথায় যিশুর শরীর রেখেছে, সন্ত পিটারেরা সেটাও জানবেন বলে আশা করছিলেন মেরি?
হোলগারের বক্তব্য, জোসেফাস আর নিকোডেমাসরা তার আগের দিন রাতেই মেরি ম্যাগদালেন আর পিটারকে জানিয়েছিলেন তাঁদের পরিকল্পনার কথা। সব ঠিকঠাক এগিয়েছে, এখন শুধু জেরুজালেমের বাইরে ওঁকে নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা। মেরি ম্যাগদালেন সে সব জেনেই ভোরবেলা কবরখানায় পৌঁছেছিলেন, আর সে কারণেই ওই বিস্মিত উক্তি।
তা হলে? মৃত্যু থেকে খ্রিস্টের পুনরুত্থান বা ‘রেজারেকশন’? এ বার ভাষাতত্ত্বের শরণ নিয়েছেন হোলগার। প্রাচীন আরামিক ভাষায় (ওই ভাষাতেই কথা বলতেন যিশু) ‘চিজা’ নামে একটা শব্দ আছে। ওই শব্দের অনুবাদে হাজার হাজার বছর ধরে ‘পুনরুত্থান’-এর কথা বলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ‘চিজা’-র মানে একেবারেই অন্য। রোগ থেকে সেরে ওঠা।
তা হলে? ঠিক কী বলতে চাইছেন হোলগার কার্স্টেন?
হ্যাঁ, যিশুখ্রিস্টের জীবনে অজ্ঞাত দুটি পর্ব অবশ্যই আছে। প্রথমটি, তাঁর তিন বছর বয়সে। রাজা হেরদ-এর অত্যাচার থেকে বাঁচতে তিন বছরের শিশুকে নিয়ে জোসেফ আর মেরি পাড়ি দিয়েছিলেন মিশরে।
কী হল সেখানে? কেউ জানে না। তবে, এর পরই বারো বছরের যিশুকে দেখা গেল, জেরুজালেমের মন্দিরে। সেখানকার পুরোহিতেরাও তাঁর শাস্ত্রজ্ঞানে মুগ্ধ। এবং তার পরই আমরা দেখলাম তিরিশ বছরের যিশুকে। মাঝে কী হল, কেউ জানে না।
আর এখান থেকেই নানা ব্যাখ্যার উদ্ভব। ওই সময়টায় যিশু ভারতে এসেছিলেন, বারাণসী, উজ্জয়িনী এবং বহু জায়গায় শাস্ত্রশিক্ষা করেছিলেন এ রকম একটা কথা মাঝে মাঝেই শোনা যায়। কিন্তু তা কত দূর সত্যি, কেউ জানে না। উনিশ শতকের শেষাশেষি নিকোলাস নোটোভিচ নামে এক রুশ পর্যটককে লাদাখের হেমিস গোম্ফায় প্রাচীন এক তিব্বতি পুঁথি দেখানো হয়েছিল। সেখানে ছিল, ইজরায়েলে জন্মানো ইশা ছোটবেলায় বণিকদের সঙ্গে সিন্ধুদেশে আসেন। সেখানে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ও বেদ-বেদান্ত অধ্যয়ন করেন। জাতপাত ও প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি এমন ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন যে, ব্রাহ্মণেরা তাঁকে হত্যার চক্রান্ত করেন। যিশু পারস্য হয়ে স্বদেশে পালিয়ে যান। নিকোলাস সে কথা লিখতেই সারা ইউরোপ জুড়ে তোলপাড়। জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলারও রেগে কাঁই হয়ে লিখলেন, এমন হতেই পারে না। নোটোভিচ আসলে প্রতারক।
কিন্তু ফিসফিস থামল না। স্বামী বিবেকানন্দের সতীর্থ, রামকৃষ্ণ-শিষ্য স্বামী অভেদানন্দও তাঁর তিব্বত-সফরের কথা লিখতে গিয়ে জানালেন, হেমিস গোম্ফার প্রধান তাঁকেও সেই প্রাচীন পুঁথি দেখিয়েছেন। অনেকে আবার শিবভক্ত নাথ সাধুদের কথা বললেন। গোরখনাথ, পার্শ্বনাথ ইত্যাদি সাধকেরা নাথ সম্প্রদায়। তাঁদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনি, সন্ত ইশানাথ ১৪ বছরে ভারতে এসেছিলেন। তার পর দেশে ফিরে এক চক্রান্তে পড়েন। তাঁকে ক্রসবিদ্ধ করা হয়। যোগবলে বেঁচে যান তিনি, অবশেষে গুরু চেতননাথের সাহায্যে ফের ভারতে আসেন। হিমালয়ের কোলে আশ্রম স্থাপন করেন। পরিণত বয়সে সেখানেই তাঁর মৃত্যু।
এই ফিসফিসটাকেই এ বার ঐতিহাসিক তথ্যের কাঠামো দিচ্ছেন হোলগার কার্স্টেন। বলছেন, তিন বছরের যিশুকে নিয়ে জোসেফ আর মেরি যখন মিশরে আসেন, সেখানে এক লক্ষ ইহুদির বাস। এবং কয়েকশো বৌদ্ধ বিহার। আরও জানাচ্ছেন, যিশু ‘এসেন’ ধর্মগোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। বৌদ্ধদের প্রভাবে ওই সন্ন্যাসীরা বিয়ে করতেন না, ইহুদি মন্দিরে বলি এবং রক্তপাতের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। এবং সেখানেই শেষ নয়। চুরি না করা, মিথ্যে না বলা, ব্যভিচার না করা...বৌদ্ধদের যে রকম ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’, এসেন গোষ্ঠীও সে রকম আটটি পথের কথা বলত।
প্রসঙ্গত, যিশুর দীক্ষাগুরু সন্ত জন-ও ‘এসেন’। জর্ডন নদীর জল ছিটিয়ে তিনি যীশুকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। তা, হোলগার বলছেন, এ রকম কোনও ইহুদি প্রথা ছিল না। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বরং নতুন শ্রমণদের ওই ভাবে দীক্ষা দিতেন। আর, এই দীক্ষাপর্বের সময় মঠে একটি দীপ জ্বলত। গ্রিক ও রোমান ভাষার প্রাচীন খ্রিস্টিয় সাহিত্যে কিন্তু খ্রিস্টানদের আর একটি নাম ‘আলোকপ্রাপ্ত’।
এবং কাশ্মীর! হোলগার বারংবার একটা জায়গাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। কাশ্মীর। ওল্ড টেস্টামেন্টে রয়েছে, ইহুদিদের আদিপুরুষ আব্রাহাম হারান শহরে থাকতেন। এত দিন ধারণা ছিল, হারান মেসোপটেমিয়া-য়। হোলগার জানাচ্ছেন, না। শ্রীনগরের অনতিদূরে ‘হারওয়ান’ই সেই হারান। ওল্ড টেস্টামেন্টে আছে, ‘বেথ পিওর’ অঞ্চলের সামনে রাখা উপত্যকা বেয়ে মোজেস তাঁর উদ্দিষ্ট ঈশ্বরের দেশে পৌঁছে যান। হোলগার দেখাচ্ছেন, কাশ্মীরের ঝিলম নদীকে প্রাচীন ফারসি ভাষায় বলা হত বেহাত। এবং ঝিলম উপত্যকা যেখানে উলার হ্রদের সঙ্গে মিশেছে, তারই নাম ‘বেহাত পিওর।’
গত দু’ দশক ধরে বিচিত্র সব প্রমাণ উদ্ধার করেই চলেছেন হোলগার। কাশ্মীরের শিকারাগুলির বৈঠা পানপাতা বা ‘হৃদয়’চিহ্নের মতো দেখতে। শিশুর জন্মের পর মেয়েরা চল্লিশ দিনের আঁতুড় পালন করে। হোলগার বলছেন, এগুলি সবই প্রাচীন ইহুদি প্রথা। সবচেয়ে বড় কথা, ইহুদিদের মতোই প্রাচীন কাশ্মীরী কবরগুলি পূর্ব-পশ্চিমে। পরে ইসলামে ধর্মান্তরিত হলেও কাশ্মীরীরা আসলে নাকি ইহুদি সভ্যতারই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন !
এবং স্বয়ং যিশুখ্রিস্ট শিষ্যদের গোপন চেষ্টায় মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে মিশর, পারস্য হয়ে শেষ অবধি চলে এসেছিলেন এই কাশ্মীরেই। ক্রসবিদ্ধ হওয়ার ১৬ বছর পরে। মনটা বড় খারাপ করে দিয়েছেন হোলগার। তাঁর লেখা পড়ে এ বারে বড়দিন কেমন যেন পানসে। দু’ হাজার বছর পরেও বোঝা গেল না সেই ঈশ্বরপুত্রকে!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.