Header Ads

অসংযত প্রগলভতা ও অতিরিক্ত আত্মতুষ্টিতে ভেসে যাওয়ার অবকাশ থাকছে না তৃণমূলের !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ঃ

প্রথমেই সদ্য সমাপ্ত তিনটি উপনির্বাচনের ফলাফলটিকে একটু নেড়েচেড়ে দেখে নেওয়া যাক। গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে যাচ্ছেতাইভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর উপনির্বাচনে তৃণমূলও ভাবে নি কালিয়াগঞ্জে এই প্রথম জিতে তারা ইতিহাস তৈরি করতে পারবে। এই জয় কারও ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় আসে নি--এনআরসি’র আতঙ্ক তৃণমূলকে এই আসনে জয এনে দিয়েছে। কাগজে দেখলাম কালিয়াগঞ্জে কোচবিহারের তৃণমূল নেতা পার্থপ্রতিম রায়ের ক্যারিশমা নাকি রাজবংশী মহলে ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে ! 

এখানে অবশ্য এই প্রশ্ন তুলছি না--কোচবিহার-জলপাইগুড়ি লোকসভা নির্বাচনে তার ক্যারিশমা বা ম্যাজিক রাজবংশী  মহলে পাত্তা পেল না কেন--শুধু অবাক হচ্ছি উচ্ছিষ্টভোগী কিছু সাংবাদিক অর্ঘ্য রায়প্রধানের নামটা উল্লেখ না করায়। অর্ঘ্য রায়প্রধানও দিনরাত এক করে বিমুখ রাজবংশী ভোটারদের ঘরে ঘরে ঢুকে তাদের দলের পাশে টেনে আনার জন্যে কম পরিশ্রম করে নি ! আমার কাছে প্রচুর তথ্য-ছবি রয়েছে।
সে যাইহোক, কালিয়াগঞ্জ গত বিধানসভা নির্বাচনেও (২০১৬) কংগ্রেসের গড় হিসেবেই চিহ্নিত ছিল এবং সেই নির্বাচনে কংগ্রেস পেয়েছিল ৫৩.৪৬%, তৃণমূল পেয়েছিল ৩১.৩৯% এবং বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ১২.৯০% ভোট। গত লোকসভা নির্বাচনে এই ছবিটা একেবারে উল্টেপাল্টে যায়। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল পায় মাত্র ২৭.৩০%, বাম-কং মিলিতভাবে পায় মাত্র ১৬.৫০% ভোট (এককভাবে কংগ্রেস পায় ৮.১০%) এবং বিস্ময়করভাবে বিজেপি পায় ৫২.২০% ভোট ! বিজেপি’র এই উত্থান কোন ম্যাজিকে কাদের ক্যারিশমায় সম্ভব হল তা নিয়ে কিন্তু এখনও চুরচেরা বিশ্লেষণ বা কঠোর আত্মসমালোচনা করতে দেখা গেল না প্রায় কাউকেই ! 

২০১৯-এর সদ্যসমাপ্ত উপনির্বাচনে ৮.৬৬% কমে বিজেপি’র ভোট দাঁড়াল ৪৩.৫৪%-এ এবং ১৭.৩৫% ভোট বেড়ে তুণমূলের ভোট দাঁড়াল ৪৪.৬৫%-এ--চমকপ্রদ বৃদ্ধি সন্দেহ নেই, তবে গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’র বেড়ে যাওয়া ৩৯.৩০%-এর তুলনায় ঢের কম ! তৃণমূলের এই জয় বা ভোট কোন যুক্তিতেই বেড়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না যদি না এনআরসি’র হুমকি ও আতঙ্ক মানুষকে দিশেহারা করে তুলত। বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার--এনআরসি হুমকি আতঙ্ক এবং ব্যক্তিবিশেষের ক্যারিশমা ম্যাজিক সত্ত্বেও জয়ের ব্যবধান মাত্র ২৪১৪ হল কেন ! বিশেষ করে এটাও ভেবে দেখা দরকার তৃণমূলকে যেখানে ৯৭,৪২৮ জন ভোট দিযেছে সেখানে তাদের ভোট দেয় নি প্রায় ১ লক্ষ ১৪ হাজার মানুষ--এই সংখ্যাটা যে কোন পরিস্থিতিতে বদলে যেতে পারে যদি অসংযত প্রগলভতা ও অতিরিক্ত আত্মতুষ্টিতে নিজেদের পুরনো ফর্মে তৃণমূল ফিরে যাওয়ার কথা ভাবে--তখন আর কোন ক্যারিশমা বা ম্যাজিক কাজ করবে না। বার বার শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থাকে না--এটা মাথায় রাখতে না পারলে অদূরেই ওৎ পেতে বসে থাকা বিপদ ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে !
করিমপুরে তৃণমূলের সম্ভাবনা এমনিতেই ছিল--অতিরিক্ত হিসেবে এনআরসি আতঙ্ক অনেকটাই তৃণমূলকে এগিয়ে দিয়েছে। বিজেপি স্থানীয়ভাবে তাদের উপযুক্ত প্রার্থী থাকতেও জয়প্রকাশকে কলকাতা থেকে পাঠিয়ে প্রথম রাউণ্ডেই পিছিয়ে গিয়েছিল। সেখানে তাদের সংগঠনের এমনই বেহাল অবস্থা যে, তাদের প্রার্থীকে বিরোধীদের পদাঘাত থেকে বাঁচানোর জন্যেও কেউ আশেপাশে ছিল না ! জয়প্রকাশেরও বিধানসভায় ভাষণ দেওয়ার আগ্রহ এতটাই তুঙ্গে ছিল যে তিনিও ক্ষেত্রসমীক্ষা না করেই করিমপুরে ছুটে গেলেন ! দেখেশুনে মনে হচ্ছিল বঙ্গ বিজেপির সাংগঠনিক কর্তাদের কাছেও করিমপুর সম্পর্কে প্রয়োজনীয়  খবরাখবর ছিল না--আত্মবিশ্বাস ও আত্মতুষ্টি আকাশস্পর্শী থাকলে যা হয় ! তবে এখানেও কিন্তু প্রায় লক্ষাধিক মানুষ তৃণমূলের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানকে নিশ্চিত করেছে।
যে যাই ভাবুন না কেন, খড়গপুরে তৃণমূলের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জয়ের কারিগর কিন্তু শুভেন্দু অধিকারী। অনেকেই বলবেন, ব্যক্তির নয় (আমি নয় আমরা!) এ জয় ঐক্যবদ্ধ দলের জয়। এসব আনুষ্ঠানিক কথাবার্তার যে বিন্দুমাত্র বাজার দর নেই সেটা প্রমাণ করা যেতে পারে শুভেন্দুকে বসিয়ে রেখে মেদিনীপুরে একটা নির্বাচন জিতে দেখানোর মধ্য দিয়ে। জয়ের প্রধান দুটি কারণের সঙ্গে এখানেও এনআরসি আতঙ্কও ছিল--যদিও প্রধান কারণ হিসেবে নয়। তৃণমূলের পাশে শুভেন্দুর সন্দেহাতীত সাংগঠনিক দক্ষতা টীমওয়ার্ক এবং দলকে জেতানোর একমুখী জেদ এখানে প্রত্যাশিতভাবেই ক্লিক করে গেছে। দ্বিতীয় কারণ, বঙ্গ বিজেপি কর্তা দিলীপ ঘোষ। তাঁর নিরবিচ্ছিন্ন অসংলগ্ন চ্যাটাং চ্যাটাং সংলাপ যে কীভাবে দলের বিরুদ্ধে মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলছিল সেটা তিনি বা তাঁর দলের কুশীলবরা অনুভবই করতে পারেন নি। লোকসভা ভোটে বাংলায় ১৮ আসন জিতে তাঁরা এমন এক তুরীয় মেজাজে বিচরণ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যেখানে জনসংযোগ নয়--জনবিচ্ছিন্নতাকেই  তরান্বিত করে। দিলীপবাবু এসব ভেবে দেখার চেষ্টাও করেন নি। দিল্লীর কর্তাদের বোঝাবার চেষ্টা করেন নি--এনআরসির হুমকি বিজেপিকে চিরতরে প্রত্যাখ্যান করতে পারে বাংলার মানুষ। বরং তিনিও বার বার তর্জনী তুলে এনআরসি’র হুমকি দিয়ে বাজিমাতের নির্বোধ স্বপ্ন দেখায় বুঁদ হয়ে ছিলেন ! অত্যন্ত সংবেদনশীল একটা বিষয়ে মানুষকে আতঙ্কিত করার নির্বোধ উন্মত্ততায় তাদের হারাতে হল দুটি নিশ্চিত আসন--তাদের এই নির্বুদ্ধিতার চড়া মাশুল গুণতে হতে পারে আগামী পুর ও বিধানসভা নির্বাচনেও--যদি না স্বস্তিদায়ক ড্যামেজ কন্ট্রোল তারা করতে
পারেন !
কেউ কেউ (বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে জনবিচ্ছিন্নতায় ভুগতে থাকাদের একাংশ) দাবি করছেন, বিজেপির এই পরাজয়ের মূল কারণ হল--বিজেপি সরকারের আর্থিক দুর্নীতি, বিমুদ্রাকরণ,বেসরকারিকরণ, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই আর্থিক দুর্নীতি,বেসরকারিকরণ, মূল্যবৃদ্ধি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা--সময় বিশেষে সাধারণ মানুষকে এ ধরণের জাঁতাকলে পড়ে ছটফট করতেই হয়--এসব খুব নতুন কিছু নয়। বিজেপি আমলে এ প্রবণতা বেশি--কিন্তু তাদের ঠেকাবে কে?  ঠাকরে শারদ পাওয়ার মুলায়ম সিং চন্দবাবু মায়াবতী মমতা রাহূল? গত ছ’বছরে এইসব বিরোধী নেতারা নিজেদের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও দলের স্বার্থের উর্দ্ধে উঠে কেউ কারুর জন্যে এক ছটাক জমি ছাড়ার সদিচ্ছা দেখিয়েছেন? ঐক্যবদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের অর্থ এরা বোঝেন?       নৈতকতা নিয়ে রাস্তায় ঝড় তুলে কমিক ড্রামা করলেও নিজেরা কখনও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের দেখেন? নরেন্দ্র মোদী জানেন এবং বুঝে গিযেছেন কার কত দম ! তিনি তাঁর দলের স্বার্থে স্বেচ্ছাচারিতা করবেনই--স্রেফ গলাবাজি করে গালিগালাজ করে তাঁকে ঠেকানো যাবে না--যতক্ষণ না মানুষ নেতাদের মুখের দিকে না তাকিয়ে নিজেদের স্বার্থেই সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন। অতি সহিষ্ণু ভারতবাসীর যেকোন বিষয় বুঝে উঠতে যেমন প্রচুর সময় লাগে--তেমনই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতেও সময় লাগে !
তৃণমূলকেও তাই বুঝতে হবে মোদী তাদের গলির ক্রিকেট ক্যাপ্টেন নন--তাঁকে আউট করতে গেলে প্রচুর হোমওয়ার্ক করতে হবে এবং তার মধ্যে অবশ্যই মেধা থাকতে হবে--অসংযত প্রগলভতা ও অতিরিক্ত আত্মতুষ্টি দিয়ে তা হবে না !

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.