Header Ads

আদিভূতা নারায়ণী শক্তি দেবী দুর্গা !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় : এখন শরৎকাল। আকাশ ঝকঝকে নীলাভ রাগে অপূর্ব শ্রীমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। শ্বেতশুভ্র খণ্ড খণ্ড  নির্জল মেঘ সমুদ্রের ফেনার মতো অনন্ত আকাশে ভেসে যাচ্ছে। চন্দ্রমণ্ডলও নির্মল, জ্যোৎস্নাজাল রজতধারায় ধরাতল অভিষিক্ত করছে। গাছে গাছে নানারঙের ফুল, নদীতে স্বচ্ছ জল, তীরে তীরে শুভ্র কাশের ঢেউ, সকালের শীতল স্নিগ্ধ বাতাসে শেফালিকার মিষ্টি সুবাস--এ সব কিছুই মনে করিয়ে দেয় এ প্রভাত শরতের প্রভাত, এ শরৎ দুর্গোৎসবের কাল--মহোৎসবের মহা ঋতু !
বাঙালির প্রাণের উৎসব শুধু বাংলার নয়, বিশ্বের বহু দেশেও দুর্গা আরাধনার প্রমাণস্বরূপ নানান রূপে  দুর্গামূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। ভারতের নানান রাজ্যেও দুর্গা আরাধনার ইতিহাস রয়েছে। বিশেষ করে এই সময়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিমে দুর্গোৎসবের সময়ে দশাহ বা নবরাত্রির উৎসবের নামে দুর্গা আরাধনা আজও বেশ ধুমধামের সঙ্গে হয়ে থাকে। সব দেশে সব কালে সব জাতিতেই  কোন না কোন উৎসবের আধিপত্য থাকেই। দুর্ভিক্ষ, প্লাবন কিংবা বিদ্রোহ সব ছারখার করে দিলেও মানব সমাজ থেকে উৎসবের আধিপত্য  বিলুপ্ত হবার নয়। ফলে যেখানেই মানব সমাজ সেখানেই উৎসব। হিন্দুদের, বিশেষ করে বাঙালিজাতির জীবনে দুর্গোৎসব একটি মহোৎসব। 
একদা রাজা সুরথ হৃতসর্বস্ব হয়ে একাকী ভগ্নচিত্তে বনে প্রবেশ করেছেন। একজন ধর্মদর্শী মহর্ষি তাঁকে বৈরাগ্যের উপদেশ দিচ্ছেন এবং দেবী দুর্গার আরাধনায় উৎসাহিত করছেন। আর একদিকে অযোধ্যাপতি রাম যখন তাঁর স্ত্রী সীতার জন্য অতিমাত্রায় কাতর তখন জয়শ্রী লাভের জন্য বেদমন্ত্রে দেবী দুর্গার অকাল বোধন করছেন। প্রাচীন কালের এই ঘটনা মনকে অধিকার করে বলেই দুর্গোৎসব আজও মহোৎসব হিসেবে চিহ্নিত। কালে কালে বাঙালির দুর্গোৎসবে নানাবিধ উপসনা এবং নানাবিধ উপকরণ সংযোজিত হয়েছে। যে বিবর্তন-বিকাশ জড় জীবজগতের মূল নিয়ম সেই নিয়ম বলেই সেই বৈদিক কালের শক্তিরূপা অতসীবর্ণময়ী উজ্জ্বলা অনল শিখা আজ এই অধঃপতনের দুর্দিনে সর্বদেব পরিবেষ্টিতা মহা শক্তিতে চণ্ডীমণ্ডপ মণ্ডিত করছেন। বেদের সেই দীপ্ত শক্তি, উপনিষদের শব্দ-শক্তি, পুরাণের দেব-শক্তি, কাব্যের শোভা-শক্তি, তন্ত্রের মাতৃ-শক্তি, বাঙালির কন্যা-শক্তি ইত্যাদি কত কালের কতরকম শক্তি আজ ইতিহাসের মহা রাসায়নিক সংযোগে দ্রবীভূত অথচ বিবর্তনে বিকশিত হয়ে  দুর্গোৎসবের কেন্দ্রীভূতা মহাশক্তিরূপে  বিরাজ করছেন। ধন-শক্তি, জ্ঞান-শক্তি, গণ-শক্তি, রণ-শক্তি, পাশব-শক্তি, দানব-শক্তি, বৃক্ষ-শক্তি, শোভা বর্ধন করছে। এমন দালান ভরা প্রতিমা, এমন হৃদয়ভরা আবেগ, এমন কালভরা ভক্তিভাব, এমন জগৎভরা উপকরণ, এমন সম্প্রীতিভরা উৎসব আর কোন দেশে নেই। তাই বাঙালির দুর্গোৎসব মানুষের হৃদয়োৎসবের চরমোৎকর্ষ এবং বাঙালির পরম গৌরবের বিষয়।
কিন্তু দেবী দুর্গা কে? তাঁর স্বরূপ কি? তিনি কি শুধুই জননী কিংবা কন্যা? পুরাণ বলছে, দুর্গা আদিভূতা নারায়ণী শক্তি। ঐ শক্তি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়কারিণী। ঐ শক্তির প্রভাবেই ব্রহ্মাদি দেবতা সকল বিশ্বসংসার জয় করেন ঐ শক্তি  থেকেই এই সংসারের উৎপত্তি। জগতের  সংহারের জন্য দেবাদিদেব মহাদেবকে ঐ শক্তি প্রদান করা হয়েছে। ঐ শক্তি দয়া, নিদ্রা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, তৃপ্তি, শ্রদ্ধা, ক্ষমা, ধৃতি, তুষ্টি, পুষ্টি ও লজ্জাস্বরূপিণী। উনিই গোলকে রাধিকা, বৈকুন্ঠে লক্ষ্মী, কৈলাসে সতী এবং হিমালয়ে পার্বতী। উনিই সরস্বতী ও সাবিত্রী। বহ্নিতে দাহিকা শক্তি, ভাস্করে প্রভাশক্তি, পূর্ণচন্দ্রে শোভাশক্তি, জলে শৈত্য শক্তি, শস্যে প্রসূতিশক্তি, ধরণীতে  ধারণাশক্তি, ব্রাহ্মণে ব্রাহ্মণ্যশক্তি, দেবগণে দেবশক্তি, তপস্বীতে তপস্যাশক্তি, সকলই উনি। ঐ শক্তি গৃহীগণের গৃহদেবতা, মুক্তের মুক্তিরূপা এবং সাংসারিকের মায়া। রাজার রাজলক্ষ্মী, বণিকের লভ্যরূপা, মেধাবীতে মেধাস্বরূপা সবই ঐ শক্তি। এক কথায় দুর্গাশক্তি  সর্বশক্তি স্বরূপা। তাই তো দিকে দিকে ধ্বনিত হয়-- 
     ‘সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে।
     শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী নারায়ণী নমোহস্তুতে/
     সৃষ্টিস্থিতিবিনাশানাং শক্তিভূতে সনাতনী।
     গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণী নমোহস্তুতে/
     শরণাগত দীনার্ত পরিত্রাণ পরায়ণে। 
যে সমস্ত শক্তির সাহায্যে সংসার -জীবন, এই পার্থিব জীবন সুখময়, যশোময় ও আনন্দময় হয় সেই সমস্ত শক্তিকে একত্র করে  বাঙালি শরৎকালে দুর্গা প্রতিমার অর্চনা করে। পাঁচটি শক্তির সমাবেশে একটি যুদ্ধে জয়ী হওয়া  যায়। যুদ্ধে জয়ী হবার জন্যেই মহিষমর্দিনীর সৃষ্টি। পাঁচটি শক্তি হল, বিদ্যা-অন্ন-ঐশ্বরিক-উপযুক্ত সেনাপতি ও সিদ্ধি। ঐশ্বরিক শক্তি বা আদ্যা শক্তির রূপক হলো--দুর্গা, বিদ্যা ও বুদ্ধি হলো--সরস্বতী, অন্ন--লক্ষ্মী, উপযুক্ত সেনাপতি--কার্ত্তিক এবং সিদ্ধি হলো--গণেশ।  যুদ্ধে যাওয়ার আগে প্রাচীন বাঙালি এই পঞ্চশক্তির মূর্তি গড়ে শরৎকালে উপাসনা করতেন। এই ধরণের মূর্তির প্রচলন কিন্তু বাঙলার বাইরে আগে ছিল না। কিন্তু কালের প্রবাহ আগের মতোই ব’য়ে চলেছে। তার সঙ্গে  চিরপ্রথানুযায়ী ভেসে এসেছে সেই চিরদিনকার  জননীর বোধন-মন্ত্র। যে আনন্দের সাড়া ঘরে ঘরে প’ড়ে গেছে, নিরানন্দের নগ্ন রূপ যে তার মাঝে ফুটে ওঠে না তা নয়, তবুও অনাদি কালের শাশ্বত দেবতাকে আবার বরণ করে নেবার জন্য ব্যগ্র হতে হয়; তৃষিতের আর্তনাদ, বুভুক্ষিতের করুণ কান্না, গৃহহীনের বেদনা, নিষ্পেষিতের জীবন-জ্বালা আবহমান কাল ধরে ছুটে চলেছে--অনেক দূরের, অনেক উচ্চের সেই অসীম দেবতার চরণে মুক্তির মোহে! তবুও সমস্ত কুন্ঠা, সমস্ত গ্লানি, জীবনের সমস্ত বেদনা দূরে ফেলে রেখে দিতে হয়, চিরন্তনীর  আগমন লগ্নে। সেই জন্যেই বিশ্বজননীর সামনে  নতজানু হয়ে প্রার্থনা জানাতে হয়-- 
‘বিশ্বেশ্বরী ত্বং পরিপাসি বিশ্বং,/ বিশ্বাত্মিকা ধারয়সীতি বিশ্বম্।/ বিশ্বেশবন্দ্যা ভবতী ভবন্তি,/ বিশ্বাশ্রয়া যে ত্বয়ি ভক্তিনম্রাঃ\/ দেবি! প্রসীদ পরিপালয় নোহরিভীতের্নিত্যং / যথাসুরবধাদধুনৈব সদ্যঃ।/ পাপানি সর্ব্বজগতাঞ্চ শমং নয়াশু,/ উৎপাতপাক-জনিতাংশ্চ মহোপসর্গান্\ / প্রণতানাং প্রসীদ ত্বং দেবি ! বিশ্বার্ত্তিহারিণি !/ ত্রৈলোক্যবাসিনামীড্যে ! লোকানাং বরদা ভব !
এবং এখানেই শেষ নয়, সকাম প্রার্থনায়ও নতজানু হয় সংসারী সাধারণ মানুষ-- 
‘দেহি সৌভাগ্যমারোগ্যং দেহি দেবি পরং সুখং। রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি/ বিধেহি দেবি কল্যাণং বিধেহি বিপুলাং শ্রীয়ম্।   রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি/’ 
দুর্গতিনাশিনীর কাছে তাঁর সন্তানদের চাইবার শেষ নেই বটে তবে এই অকপট প্রার্থনাই শরতের আকাশ বাতাসে ধ্বনিত হয়ে আসছে চিরকাল !

(পত্রিকায় প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদন। নকল করার আগে অনুগ্রহ করে দু’বার ভাববেন !)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.