Header Ads

আজ কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো !

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় : বাংলায় শারদীয়া দুর্গোৎসবের পর আশ্বিনের শেষ পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো করা হয়। বাঙালি হিন্দুর (বিশেষ করে পূর্ববঙ্গীয়) ঘরে ঘরে কোজাগরী লক্ষ্মীকে আবাহন করা হয়। প্রায় প্রতি ঘরে ঘরেই দেবী লক্ষ্মীর পুজো হয়ে থাকে। লক্ষ্মী হলেন ধন সম্পত্তির দেবী। ধন সম্পদের আশায় ঘরে ঘরে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোয়  নারী পুরুষ উভয়েই অংশ গ্রহণ করেন।
অনেকেই সারা বছর প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পুজো করে থাকেন। এছাড়া রাঢ়বঙ্গে (দক্ষিণবঙ্গে প্রধানতঃ) শস্য সম্পদের দেবী বলে ভাদ্র সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি ও চৈত্র সংক্রান্তিতে এবং  দীপাবলীতে লক্ষ্মীর পুজো হয়। লক্ষণীয় বিষয় হল--খারিফ শস্য ও রবি শস্য ঠিক যে সময় হয় ঠিক সেই সময় বাঙালি হিন্দু মেতে ওঠে লক্ষ্মীর আরাধনায়। তবে পুজোর উপাচারে পরিবর্তন হয় মাস ভেদে।
লক্ষ্মীপুজোর মন্ত্র-
"নমামি সর্বভূতানাং বরদাসি হরিপ্রিয়ে যা গতিস্ত্বৎপ্রপন্নানাং সা মে ভূয়াৎ ত্বদর্চনাৎ।" অর্থাৎ 'হে হরিপ্রিয়ে,তুমি জগতের সমস্ত প্রাণীকে বরদান করে থাক, তোমাকে প্রণাম করি। যারা তোমার শরণাগত হয়, তাদের যে গতি, তোমার পূজার ফলে আমারও যেন সেই গতি হয়।'
ইদানীং গৃহস্থের সুবিধের জন্যই হোক বা পুরোহিতের স্বল্পতার জন্য, লক্ষ্মী পুজো (বারোমেসে পুজো বাদে) হয় সকাল থেকেই। কিন্তু কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর প্রকৃষ্ট সময় প্রদোষকাল। অর্থাৎ সূর্যাস্ত থেকে দু ঘণ্টা পর্যন্ত যে সময়। যদিও প্রদোষ থেকে নিশীথ অবধি তিথি থাকলেও সেই প্রদোষেই পুজো বিহিত। কিন্তু আগেরদিন রাত্রি থেকে পরদিন প্রদোষ পর্যন্ত তিথি থাকলে পরদিন প্রদোষেই পুজো করা বিধেয়। আবার আগেরদিন রাতে তিথি থাকলেও যদি পরদিন প্রদোষে তিথি না থাকে তাহলে আগেরদিন প্রদোষেই পুজো করা কর্তব্য।
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোতে দেখা যায় জেলা ভিত্তিক আঞ্চলিক আচার অনুষ্ঠান। এখনও ঘরে ঘরে প্রতি বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করে তাঁর আরাধনা করা হয়। উপচারে ফল মিষ্টি ছাড়াও থাকে মোয়া, নাড়ু ইত্যাদি। লক্ষ্মীর আচার অনুষ্ঠানেও দেখা যায় নানা ধরনের তাৎপর্য। কোনও কোনও পরিবারে পুজোয় মোট ১৪টি পাত্রে উপচার রাখা হয়। কলাপাতায় টাকা, স্বর্ণ মুদ্রা, ধান, পান, কড়ি, হলুদ ও হরিতকী দিয়ে সাজানো হয় পুজো স্থানটিকে। পুজোর উপকরণ এবং আচার অনুষ্ঠান দেখে অনুমান করা যায় এর নেপথ্যে থাকা কৃষি সমাজের প্রভাব। কিছু কিছু জায়গায় লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষে মেলা বসে। কোথাও বা নৌকাবাইচও অনুষ্ঠিত হয়।
'কোজাগরী' শব্দটির উৎপত্তি 'কো জাগতী' অর্থাৎ 'কে জেগে আছ' কথাটি থেকে। বলা হয়, 'যার কিছু (সম্পত্তি) নেই সে তা পাওয়ার আশায় জাগে, আর 'যার আছে (সম্পত্তি) সে না হারানোর আশায় জাগে'। আর সারারাত জেগে লক্ষ্মীর আরাধনা করাই এই পুজোর বিশেষ আচার। কথিত আছে কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন দেবী রাত্রে খোঁজ নেন --কে জেগে আছেন ? যে জেগে অক্ষক্রীড়া করে , লক্ষ্মী তাঁকে ধন সম্পদ দান করেন । 
"নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ জাগরত্তীতিভাষিণী ।
তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ ।। "
অক্ষক্রীড়া শব্দের সাধারণ অর্থ পাশা খেলা । কেউ কেউ এই দিন পরের বাগানের ফলমূল চুরি করে। এই কাজের মাধ্যমে তারা ভাবে যে লক্ষ্মী দেবী তাদের কৃপা করবেন !
অন্যান্য পুজো আর কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর আলপনাতে বেশ কিছু পার্থক্য থাকে। এই পুজোতে মূল আলপনার সঙ্গে বাড়ি জুড়ে আঁকা হয় ধানের ছড়া, মুদ্রা, আর মা লক্ষ্মীর পায়ের ছাপের ছবি। এই প্রতীকগুলি পুজোর মহত্ত্ব যেমন ব্যাখ্যা করে, তেমনই পুজোর আচারের একটা অংশ হয়ে উঠেছে এই বিশেষ ধরণের আলপনা।
মূর্তি-
মাটির দিয়ে তৈরী ছাঁচে বা কাঠামো তৈরি করে তাতে দেবী মূর্তি তৈরি করে পূজা করা হয়। আড়ি লক্ষ্মী--বেতের ছোট চুপড়ি বা ঝুড়িতে ধান ভর্তি করে তার ওপর দুটি কাঠের লম্বা সিঁদুর কৌটো লালচেলি দিয়ে মুড়ে দেবীর রূপ দেওয়া হত। একে বলা হত ‘আড়ি লক্ষ্মী’।
কলার বের--কলার বের দিয়ে দেবী লক্ষ্মী কল্পনা। কলার বাকলকে গোল করে নারকেলের নতুন কাঠি দিয়ে আটকানো হয়। তাতে সিঁদুর দিয়ে বাঙালি ছাঁচে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা হয়। কলার বাকল দিয়ে তৈরী এই চোঙাকৃতির ভিতরে নিচুনি রাখা হয়। কাঠের আসনের উপরে লক্ষ্মীর পা অঙ্কিত আলপনার উপরে ৯টি চোঙা রাখা হয়। এই ৯তি বাকলের মধ্যে পঞ্চশস্য দেওয়া হয় সর্বশেষে শিস যুক্ত নারকেল রেখে লাল চেলি দিয়ে ঢেকে বউ সাজিয়ে লক্ষ্মী কল্পনা করা হয়।
সপ্ততরী--নবপত্রিকা বা কলার পেটোর তৈরি নৌকা এই পূজার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই নৌকা এখনও বহু গৃহস্থেই তৈরি হয়ে থাকে। তবে বাজারেও এখন কিনতে পাওয়া যায় কলার পেটো। একে সপ্ততরী বলা হয়। এই তরীকে বাণিজ্যের নৌকা হিসাবে ধরা হয়। তাতে অনকেই টাকা -পয়সা, চাল, ডাল, হরিতকি, কড়ি, হলুদ সাজিয়ে রাখেন।
লক্ষ্মীর মুখ সমন্বিত পোড়া মাটির ঘট--লক্ষ্মীর মুখ সমন্বিত পোড়া মাটির ঘটে চাল বা কখনো কখনো জল ভরে সেটিকে লক্ষ্মী কল্পনা করে পূজা করা হয়।
সরায় পটচিত্র--(লক্ষ্মী সরা, সবাহন লক্ষ্মীসরা, লক্ষ্মী সরা, দেবী দুর্গাসহ সুরেশ্বরী লক্ষ্মীসরা) লক্ষ্মী সরা, বাংলার নিজস্ব পটচিত্রধারা
অনেক বাড়িতেই পূর্ববঙ্গীয় রীতি মেনে সরার পটচিত্রে পুজো করা হয়। এই সরাতে লক্ষ্মী, জয়া-বিজয়া সহ কয়েকটি বিশেষ পুতুলকে চিত্রায়িত করা হয়। লক্ষ্মী সরাও হয় নানা রকম, যেমন ঢাকাই সরা, ফরিদপুরি সরা, সুরেশ্বরী সরা এবং শান্তিপুরী সরা। নদিয়া জেলার তাহেরপুর, নবদ্বীপ এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার বিভিন্ন স্থানে লক্ষ্মীসরা আঁকা হয়। তবে অঞ্চল ভেদে লক্ষ্মী সরায় তিন, পাঁচ, সাত পুতুল আঁকা হয়। এতে থাকে লক্ষ্মী, জয়া বিজয়া সহ লক্ষ্মী, রাধাকৃষ্ণ, সপরিবার দুর্গা ইত্যাদি। ফরিদপুরের সরায় দেবদেবীরা সাধারণত একটি চৌখুপির মধ্যে থাকেন। আবার সুরেশ্বরী সরায় উপরের অংশে মহিষমর্দিনী আঁকা হয় আর নীচের দিকে থাকেন সবাহন লক্ষ্মী।
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর ভোগে অনেক বাড়িতেই জোড়া ইলিশ রাখা হয়। তবে ভোগ হিসাবে খিচুড়ি, লাবড়া থাকা আবশ্যিক। সঙ্গে প্রসাদে ফলমূল তো থাকেই , থাকে নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, ভুশের নাড়ু। এছাড়াও লুচি, পায়েস, মিষ্টির নানা আয়োজন থাকে মা লক্ষ্মীর জন্য। পূর্ববঙ্গীয় রীতিতে অনেকেই এইদিন মাছের পাঁচ পদের রান্না করেন। আবার পশ্চিমবঙ্গীয় রীতিতে এই দিন পুরো নিরামিষ খাওয়া দাওয়া হয় এবং চালের কোনো রান্না করা হয় না।
ধান হল লক্ষ্মীর প্রতীক। চাল , অন্ন , খাদ্যশস্য হল লক্ষ্মীর প্রতীক। তাই যারা খাদ্য অপচয় করেন , তাঁদের ওপর দেবী লক্ষ্মী কখনোই তুষ্ট হন না। ধানক্ষেতের আশেপাশে ইঁদুর বা মূষিকের বাস এবং এরা ধানের ক্ষতি করে থাকে। পেচক বা পেঁচার আহার হল এই ইঁদুর। গোলাঘরকে লক্ষ্মীর প্রতীক বলা হয়। গোলাঘরের আশেপাশে ইঁদুরের বসবাস। পেঁচা এই ইঁদুরকে খেয়ে খাদ্যশস্য রক্ষা করে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.