Header Ads

গান্ধীবাগ চুক্তিতে ১৬০ কোটি টাকার ন্যূনতম লোকসান শিলচর পুরসভার

নিলয় পাল, শিলচর : 'যখন আমাদের পূর্বসূরিরা প্রশ্ন করবে- তোমরা আমাদের ভাগের জল অপচয় করলে কেন? কেন কেড়ে নিলে আমাদের ভাগের অক্সিজেন? কেন ধ্বংস করলে সবুজায়ন কে? তখন কি উত্তর দেব আমরা আমাদের নিজের প্রজন্মকে!' - নরেন্দ্র মোদি।
ডিসকভারি চ্যানেলের সেই বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চার অভিযানের শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিয়ার গ্রিলসকে ঠিক এই কথাগুলো বলেই শেষ করেছিলেন তাঁদের অভিযান।
কথাগুলোর মধ্যে "দম'' আছে বৈকি! কিন্তু তাঁর সতীর্থরা ভারতের এই শেষ ভূখণ্ডে কি ধংসলিলায় উন্মাদ হয়েছেন, জানেন কি, মি: প্রাইম মিনিষ্টার?
- সম্ভবত অসম রাজ্যের সর্ববৃহৎ মিউনিসিপ্যাল কেলেঙ্কারি হতে চলছে শিলচর গান্ধীবাগ 'মউ' চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে। কি সেই 'মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং' যা নিয়ে এত হৈ-চৈ! 'মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং' অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া বা মউ। আজকের দিনে এই কথাটিই যতসব নাটেরমূল। এই বোঝাপড়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে শত-শত কোটি টাকার কেলেঙ্কারি। শহরের নাগরিক সমাজ অবশ্যই চিন্তায় ও মনে প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে আছেন। 
এরইমধ্যে, কিছু যুক্তি-বিন্দু তুলে ধরা হল :
কি যুক্তিতে শিলচর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একমাত্র সবুজে ভরপুর গান্ধীবাগটি শিলচর পুরসভা একটি বাণিজ্যিক সংস্হাকে কোন ধরনের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই ''দান'' করে দিলেন। দান? হ্যাঁ, দানই বলা চলে। ভু -মাফিয়ার নজর বড়ই রূঢ় আর নেকড়ের মত লোভী থাকে। যেমন, মাস কয়েক আগে বলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা দিলীপ কুমার ও তাঁর 'ষ্টার' স্ত্রী সায়রা বানুকে ঘর ছাড়া করতে বসল কিছু 'মুম্বাইয়া  ডি - ক্যাটাগরি'-এর ভু মাফিয়া। চিন্তা করুন কি ধরনের দুঃসাহসিকতা ও নিষ্ঠুর মানসিকতার উদাহরণ হতে পারে এই ভু- মাফিয়ারা। আর হবেই বা না কেন। অর্থের অথৈ অহংকারে অলংকৃত ভূ-মাফিয়া কুল, 'আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ' হয়ে উঠে,আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো ওদের কথায় - "এই সব টেনসন আমরা এনজয় করি, হলে 'ছক্কা ফারকে' না হলে এইটুকু অর্থের অপচয় আমরা সহ্য করার ক্ষমতা রাখি।" অহংকারী ক্ষমতাশীল ডি-ভূ মাফিয়াদের অবশ্যই জল-অক্সিজেন-সবুজ-প্রাণ-নীল-আকাশ ভূস্বর্গ নয়।অর্থই প্রথম ও শেষ কথা। আর হবেই বা না কেন, লাভাংশের খতিয়ানটির দিকে নজর দিলে সবকিছু 'চিচিং ফাঁক' হয়ে যায়....।
গোলদিঘী মল কেলেঙ্কারিতে দেখা গেছে দরপত্র। (টেন্ডার)- এর কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে তৎকালীন কংগ্রেস পরিচালিত পৌরসভা একতরফাভাবে আসাম প্রগ্রেসিভ কে গোলদিঘির মলের টেন্ডার পাইয়ে দেয় অর্থাৎ, বিস্তর অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির রাস্তা প্রশস্ত করে দেয় তৎকালীন কংগ্রেস পরিচালিত পুরসভা। ঠিক একই রাস্তায় গিয়ে নীহার নারায়ণ ঠাকুর পরিচালিত বর্তমান পৌরসভা আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে প্রতি পদে পদে অনিয়ম ও অর্থনৈতিক বিশাল কেলেঙ্কারির সব রাস্তা খোলা রেখেছেন তার প্রদত্ত 'মউ' তে। প্রশ্ন উঠছে,কে বা কারা, কি স্বার্থ নিয়ে জলের দরে গান্ধী বাগ-এর সত্ত্বা এই বিল্ডার্সদের হাতে তুলে দেন? 
নীহার ঠাকুরের অতীব ঘনিষ্ঠ ছায়াসঙ্গী, যাকে শহরের মানুষ সভাপতি ঠাকুরের 'পিএ' হিসেবেই জানেন। সেই 'পিএ' নিজেই একজন বিল্ডার্স। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠছে সেই 'পিএ' কি পুরপতিকে বিল্ডার্সদের প্রাথমিক শর্ত গুলি মনে করিয়ে দেন নি। শহরের বুকে যেকোন জায়গায় বিল্ডার্সদের জায়গার মালিকপক্ষকে 'কন্সট্রাকশন এরিয়ার' কমপক্ষেও ৩৫ % শতাংশ দিতে হয়। অর্থাৎ, একজন জায়গার মালিক মোট তৈরি হওয়া বিল্ডিং-এর  কমপক্ষে ৩৫ শতাংশের দাবিদার থাকেন। যেমন- দশ হাজার স্কয়ার ফিটের বিল্ডিং বানানো হলে, জায়গার মালিক কমপক্ষেও ৩৫০০ স্কয়ার ফিট আয়তনের সম্পূর্ণ পরিপাটি ভাবে তৈরী হওয়া ঘর-ফ্ল্যাট-দোকান ঘর ইত্যাদি পাবেন। এইতো গেল সাধারণ বাসস্থান এলাকার কথা। এই ৩৫ শতাংশ জায়গা বিশেষ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ অব্দি গড়ায়। অর্থাৎ, শহরের প্রাণকেন্দ্রে যদি দু'পক্ষের মধ্যে কোন জায়গা নিয়ে 'মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং' হয়, সে ক্ষেত্রে জায়গার মালিক তৈরি হওয়া বিল্ডিং-এর ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পেতে পারেন। অর্থাৎ, দরপ্রাপ্ত বিল্ডার্স প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৩ লক্ষ স্কয়ার ফিটের পাঁচতারা খচিত হোটেল, ঝাঁ-চকচকে বাণিজ্যিক মল, ফুড হাব ও ব্যাংকুয়েট হল নির্মাণ করতে যাচ্ছেন। সেই নির্মাণের চুক্তিতে অনৈতিক ও অবৈধ বিন্দুর ছড়াছড়ি। যেমন:  প্রথম অবস্থায় যে বিন্দুর দিকে শহরের প্রত্যেকটি মানুষের চোখ পড়ছে তা হল -
শিলচর শহরের প্রেমতলা, সেন্ট্রাল রোড, ক্লাব রোড, পার্ক রোড, শিলং পট্টিতে কমপক্ষে কাঠা প্রতি জমির মূল্য 35 লক্ষ  থেকে শুরু করে ৫০ লক্ষ টাকা অবধি বাজার দর। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠে গান্ধীবাগের ২০ বিঘা জমির বাজার দর তাহলে কত হতে পারে। এখানে বিঘাপ্রতি ৮ (আট) কোটি টাকা ধরা যেতে পারে। অর্থাৎ গান্ধীবাগের ২০ বিঘা জমির বাজার মূল্য ১৬০ কোটি।
আর শিলচর পুরসভা কিনা, ১০ লক্ষ টাকার বায়না নিয়ে গান্ধীবাগের মৌ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। পুরসভা বিভিন্ন সময়ে শিলচর শহরের বিভিন্ন জায়গায় তাদের জমি বিক্রি করেছে, এমন উদাহরণ অনেক পাওয়া যায়। সদর ঘাটের সামনে জৈনক দেব উপাধির এক ব্যক্তিকে কাঠা প্রতি প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকায় জমি হস্তান্তর করা হয়েছে। একইভাবে ফাটক বাজার এলাকায় কাঠা প্রতি প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লক্ষ টাকায় জমি হস্তান্তর করার উদাহরণ আছে। 
দুটি জমি হস্তান্তরের উদাহরণ আজকের নয় প্রায় বছর কয়েক আগের। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন জাগে শিলচর শহরের জমির দাম কমছে নাকি? ধরা হচ্ছে, নির্মিত হবে কমপক্ষে তিন লক্ষ স্কয়ার ফিট এলাকা। ক্ষেত্রে ৪০ % শতাংশ হিসেবে শিলচর পুরসভার পাওয়া উচিত এক লক্ষ কুড়ি হাজার স্কয়ার ফিট ঝাঁ-চকচকে  সম্পূর্ণ  আধুনিক নির্মিত এলাকা। সেই ৪০ শতাংশের মধ্যেও আবার 'নেট কার্পেট এরিয়া' ও 'সুপার স্ট্রাকচার এরিয়া' মধ্যকার ব্যবধান প্রায় ৫০ হাজারের উপর। প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার স্কয়ার ফিট নির্মিত বানিজ্যিক এলাকার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৩৮০ কোটি টাকা। অথবা পুরসভা যদি তার প্রাপ্য নির্মিত এলাকা প্রতি স্কয়ার ফিট ১৫০০০ টাকার ন্যূনতম বাজার মূল্যে বিক্রি করে তাহলেও পুরসভার ২২৫ কোটি টাকার মুনাফা হবার কথা। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে এতগুলো টাকা কোথায় যাবে।
আমাদের শিলচর পুরসভার বর্তমান সভাপতি সে ক্ষেত্রে ১০ লক্ষ টাকার অগ্রিম অর্থের বিনিময়ে একটি ডেভোলাপারস প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। সেই চুক্তি কিসের ইঙ্গিত বহন করছে? উত্তর হয়তো স্বয়ং সভাপতি বা তার সাগরেদরাই দিতে পারবেন। বা বলতে পারবেন চুক্তিবদ্ধ বাণিজ্যিক সংস্থাটির  কর্ণধাররা।বিশাল অংকের অর্থের কেলেঙ্কারিতে ১০০ শতাংশ মকুব করেছে শিলচর পুরসভা। এই বিশাল অংকের মকুব কি ইঙ্গিত বহন করছে? কারণ সহজেই পরিলক্ষিত ৩৮০ কোটির জায়গায় ১০ লক্ষের অগ্রিম অর্থ সেকি দরপত্র না দানপত্র?
- সে কি ধরনের মউ? পুরসভা তাদের 'মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং' -এ পরিষ্কারভাবে লিখেছে 'লিজ' দেওয়া হলো।  কিন্তু 'লিজ' কথাটি যতটুকু সোজাসাপ্টা ভাষায় লিখতে পেরেছে ঠিক ততটুকু অন্ধকারে রেখেছে নানা প্রশ্নের উত্তর। যেমন: কতদিনের বা কত বছরের লিজ দেওয়া হল ?মৌখিকভাবে তার উত্তর হয়তো আসবে - 'মাত্র 12 বছরের জন্য'। কিন্তু লিজের অন্যান্য বিন্দুগুলি থেকে পরিষ্কার হয়ে উঠছে এই 'লিজ' চিরদিনের জন্য দেওয়া হয়েছে  অর্থাৎ 90 বছরেরও বেশি দিনের জন্য।
কিভাবে, যেমন:
 ১). দর প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটি দোকান ঘর- অফিস ইত্যাদি বিক্রি করতে পারবে।
 ২). ভাড়া দিতে পারবে।
 ৩). সবচেয়ে বড় বিন্দুটি হলো, ব্যাংক ও যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লোন নিতে পারবে। 
জেনে রাখা দরকার ৯০ বছরের কম দিনের লিজ হলে সেই জমিতে জাতীয় কিংবা অন্যান্য নামজাদা ব্যাংক প্রতিষ্ঠান কোন ধরনের ঋণ দিতে ইচ্ছুক হয় না। কিংবা, সেই প্রজেক্টটিকে ছাড়পত্র দেয় না। অর্থাৎ ৯০ বছরের লিজ হলেই ব্যাংক ঋণ দিতে পারে। সোজাসাপ্টা ভাষায় বলা যায়, গান্ধীবাগ নিয়ে পুরসভা কোন ধরনের নির্মাণ চুক্তির ধার ধরেনি। এমনকি জমি বিক্রিও হয়নি। বরং, বলা যায় গান্ধীবাগ-এর জমি দান  হয়েছে। পুরসভা দান করেছে শিলচরের প্রিয় গান্ধীবাগ (পার্ক) এর জমি। দানবীর কর্নদের এই দানের উদ্দেশ্য কি?

(লেখক শিলচর থেকে বহুল প্রচারিত এক দৈনিক পত্রিকার কর্ণধার ও প্রধান সম্পাদক । মতামত নিজস্ব।)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.