Header Ads

শিয়াল ডাকা, জোনাক জ্বলা, দিনগুলি মোর...

অধ্যাপক প্রশান্ত চক্রবর্তী
ছবি-সৌজন্য ইন্টারনেট।
নয়া ঠাহর : জোড়াপুকুর বা জোড়াপুখুরি বাজার। গঞ্জ। ছোট্ট ছোট্ট গুমটি দোকান। আলকাতরার টিন কেটে ঝাপগুলো বানানো। অনেকগুলো পুরনো বট, অশ্বত্থ, শিরিষ, কৃষ্ণচূড়া...! সন্ধে নামতেই এই দোকান ওই দোকানে কুপি হ্যারিকেন পেট্রোমাক্স জ্বলে ওঠে। পতপত করে পাম্প লাইটে পাম্প দেয় দোকানিরা। অমূল্যকাকুর বাড়ি বাজারের এক কোনায়। তার পাশেই খোকন দর্জির দোকান। সেখানে ঘুরঘুর করি। খোকন দর্জির মাথা তোলার সময় নেই। সামনে পুজো। সারা বছরের কামাই। রাত জেগে কাজ করেন তিনি। বাবা বলেছেন, খোকন দর্জির দোকানের কাছাকাছি থাকতে। বাড়ির "হরু"(ছোট) "পুয়া"(ছেলে) বলে আমার কপালে হয়তো একটা হাফ প্যান্ট জুটবে। সেটাও নয়া নয়। 
 মুরশুমে বৃষ্টি হয়নি। পুরো আষাঢ় শ্রাবণ বাবা বিষণ্ণ...।পুবমুখী বাঁশ শনের ঘর~জীর্ণ চাল। এই ভাঙে সেই ভাঙে দশা। চারদিকে "ঢিক"(বড়ো বাঁশের আলগা খুঁটি দিয়ে ঠেলে রাখা) দেয়া। পুবের উঠানের ধারে বাবাকে মনমরা বসে থাকতে দেখতাম। ফসল হয়নি। সময়মতো বৃষ্টি নেই। উজান মাটিতে আমাদের জমি। বৃষ্টির জলই ভরসা। সারা বছরের খোরাকি একটু একটু করে কমতে কমতে ভাঁড়ার শূন্য হতে থাকে। দুবেলা ভাত জোটানোই দায়। ভাদ্রের শুরুতে আউসের খেত জলে ভরায় কিছুটা রক্ষা।
মঙ্গলবার লংকায় হাটবার। সারা হপ্তার সবচেয়ে শস্তা জিনিস পাওয়া যায়। সদর রাস্তা থেকে বাবার সাইকেল নালার পারে নামতেই আমরা দে দৌড়। বাবা হাট থেকে ফিরছেন। হয়তো বাবা পুজোর জামাকাপড় কিছু এনেছেন। আমি, নিলুদা, কুটিদা~আমরা ছোট। সবার নজর সাইকেলের হ্যান্ডালে ক্যারিয়ারে বাবার বাজারি ব্যাগ-বস্তা-থলের ওপর। 
বাবা মাটির বারান্দায় ধপ করে বসেন। ঢকঢক করে পেতলের  ঘটি মুখের ওপর ঘরে জল খান। এক এক করে কাঁসা পেতলের বাসনকোসন সবই বন্ধক বা বিকি করতে হয়েছে। কে জানে এই ঘটির আয়ু কতদিন। মহার্ঘ বলতে ঘরে তো আর কিছু রইল না। বাবা আলগোছে শাকসবজি তরিতরকারি বের করে মাটির দাওয়ায় রাখেন। আমরা উদ্গ্রীব। অবশেষে একটিই মাত্র কাপড় বেরোয়~ঠাম্মার শেমিজ। সাদা। বাদবাকি কারও জামাকাপড় এবারে আর হবে না হয়তো। এবার বাবার হাত শূন্য। 
রাতে কুটি দা নিলু দা জড়াজড়ি করে শুয়েছে। আমি ঠাম্মার বুকে নরম চড়ুই পাখির মতন গুটিসুটি ঢুকে আছি। ঠাম্মা গুনগুন করে রাধারমনের গান করেন~"শ্রীকৃষ্ণের বিচ্ছেদঅনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে ভ্রমর কইও গিয়া"। মন খারাপের রাত বাড়ে। মহালয়া চলে গেছে। আর বোধহয় এবারে জামাকাপড় জুটবে না। চোখের কোনা দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। হালকা ঠান্ডা পড়েছে রাতে। মায়ের পুরনো শাড়ি দিয়ে তৈরি নকশি "খেতা" (কাঁথা) ভাঁজ করে গায়ে দিয়েছি। ঢেঁকি ঘরের কোনায় কুটিদা নিলুদার ফিসফিসানি শুনি~"বাবায় কইছইন~ডেকা বিকি করবা।" 'ডেকা' মানে আমাদের গরুর দামড়া বাচ্চাটি। ওকে বিক্রি করলে হয়তো পুজোর জামাকাপড় আসবে...! বুকের ভেতর ধক্ করে ওঠে। গরুর 'ডেকা' বাচ্চাটি আমার বড্ড প্রিয়। কত যে খেলি ওর সাথে। ডাক দিলেই দৌড়ে চলে আসে। গলায় হাত বুলিয়ে দিলেই মাথা আবেশে তুলে দেয়। মায়াবি চোখ মোদে...! ওকে বিক্রি করে দেয়া হবে?! তারপর?! শুনেছি ওদালি থেকে আসে মুসলিম গরুবাজারিরা। ওরা নাকি নিয়ে গিয়ে কেটে ফেলে। কান্নায় বুকটা ভেঙে যায়। চাই না আমার জামাকাপড়। ডেকা বেঁচে থাক তবু। ডুকরে উঠি! ঠাম্মা চমকে উঠে বলেন~"হরু মানু, কান্দস কেনে~কান্দিস না।"
রাত পোহায়। নরম ভোর। ঠান্ডাও পড়েছে বেশ। ঠাম্মার "রাই জাগো গো...জাগো শ্যামের মনমোহিনী বিনোদিনী রাই" শুনে ঘুম ভাঙে। পুকুর পাড়, নিমের ডাল, দাঁতন, খাঁটা পায়খানা~বাঁশঝাঁড়~চান, মুড়িগুড়~এভাবেই দিনের শুরু। 
দুপুরে খাওয়ার পর জামতলায় দিদিদের উকুন বাছা, জল্পনা। মায়ের বিয়ের দুখানা শাড়ি ট্রাংক থেকে বের করে রোদে দেয়া হয়েছে। আর তো ভালো শাড়ি নেই। এরমধ্যে একটায় আঁচলের দিকে দুটো ফুটো করেছে নেংটি ইঁদুর। নেপতালিনের ভ্যাপসা গন্ধ। ছোড়দি বলে~"না গো সুনা লইজ্জা করে। মাইনষে কিতা কইব!" কেননা, গেলবারও এই শাড়ি পরেই বেরোতে হয়েছে। লোকে বুঝে যাবে শাড়িটা গেলবারও পরেছিল, পুরনো, তাই লইজ্জা। সেজদি আলগোছে পায়ে আলতা মাখে আর বলে~"রাইত্কে যাইমু"। রাতে গেলে লোকে টের পাবে না যে শাড়িগুলো আদ্দিকালের। 
বিকেলে আসেন পিসিমা। রাজরানির মতো দেখতে। উত্তর পাড়ার ধান খেতের ভেতর দিয়ে আলপথ ধরে মন্থর গতি...। গর্ভবতী ধান। ধানযুবতীদের বুকে বুকে দুধ জমেছে। পুরুষ্ট স্তন যেন। কাঁচা পাকা বিস্তীর্ণ ধানখেতে এলিয়ে যায় শরতের মৃদুমন্দ হিমেল হাওয়া। 
পিসিমা উঠানে পা দিয়ে জলচকি টেনে হাঁক দেন~"কই গেলায় গ অঞ্জলির মা~"! মায়ের তো সবচেয়ে বেশি মন খারাপ। ছেলেপুলেগুলোর গায়ে একটা নয়া সুতোও এবারে হয়তো চড়বে না। আনমনে সুপুরি কাটেন। পিসিমার নিদান একেবারে সরল। কানু দা, ভানু দা থাকে ডিমাপুর। দুই পিসতুতো দাদা। ওরা শহরে কাজকারবার করে। ওদের অনেক পুরনো জামা-প্যান্ট আছে। দর্জিকে দিয়ে কাটিয়ে সেলাই করে নিলেই তো হয়। একেবার নতুনই লাগবে। 
ওই পরামর্শ মেনেই খোকন দর্জির দোকানে সন্ধেবেলা ঘুরঘুর করি। হ্যাজাক জ্বালিয়ে মূর্তি বানানো হচ্ছে। অদূরে যাত্রাগানের রিহার্সেল। আমাদের স্কুলবাড়ির বেঞ্চি সরিয়ে। শঙ্খ বিড়ির ফুকফুক...! জোরালো গলায় হম্বিতম্বি...সংলাপ। অট্টহাসি। বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে চোখ রাখি। অমনি পেছন থেকে~"কিগুরে অনো!? গুপি ডাক্তরর হরু পুয়া নানি?" বাজখাই গলা শুনেই  পড়িমরি দৌড়। বুকে থুকথুকি দিই। আর একটু হলেই ধরে ফেলেছিল।
আবার দর্জির দোকান। আহা, সার সার জামা প্যান্ট। আমার যদি এর মধ্যে একটা হতো...! 
অনেক সময় নজর রাখছেন খোকন দাদা। অবশেষে~নিরুপায় তিনি বলেন~"পুরানা কাপড় কাটিয়া বানানির সময় কই রে ভাই...!"
এভাবেই পূজা আসে। 
রাতে যাত্রাগান। বাবা আলিবর্দি। বড়দা সিরাজ। নাই-বা জুটল জামাকাপড়...তাও তো আমরা নবাবের বাড়ির ছেলেপুলে। স্টেজের পাশে ঢোলক তবলা করতাল নিয়ে প্রমোদ বাইনের পাশে একটা জায়গা অন্তত জোটে। খড়ের গাদায় পিলপিল মানুষ। স্কুলবাড়িতে ততক্ষণে বাতাসা নকুলদানা দিয়ে কালা বাঁশি ধলা বাঁশিতে "জয় রাধে"! বেল বাজে তিনবার~ঢং ঢং ঢং। ঝমঝম করে বেজে ওঠে বাজনা। ভুলে যাই জামাকাপড় জোটেনি~সব অপ্রাপ্তি সব বেদনা কষ্ট~সব ভুলে গিয়ে রাতভর বুঁদ হয়ে থাকি~আর, প্রহরে প্রহরে চলে দেবীর আরাধনা।...

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.