Header Ads

প্রসঙ্গ : রাজ্যপাল ও রাজনীতি

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় : এই মুহূর্তে এ রাজ্যের প্রধান বিতর্কের বিষয় হিসেবে উঠে আসছে ‘‘রাজ্যপালের রাজনীতি’’ ! আজ এবিপিআনন্দে ঘুরে ফিরে এই বিষয়টাই তেড়েফুঁড়ে উঠে আসছিল প্রায় সকলের বক্তব্যেই। বিতর্কের মূল বিষয় ছেড়ে কেউ কেউ কুস্তি লড়ার চেষ্টা করেছেন নিজের নিজের দলের পক্ষ নিয়ে। এপিডিআর না কি যেন একটা করেন সুজাত ভদ্র মহোদয়--তাঁর চিরকালীন প্রতিষ্ঠানবিরোধী চিৎকার যথারীতি আজও উচ্চমাত্রাতেই ছিল--যদিও তাঁর বক্তব্য খুব বেশি শোনার মতো আগ্রহ আমার মতো অজ্ঞানী লোকের থাকার কথা নয়--আজও ছিল না কারণ, তিনি হাঁ করলেই কি বলবেন কাকে দংশন করবেন এবং কি কি যুক্তিতে করবেন তা আমার অজানা থাকে না। ক্ষমতাসীন দল ও তার মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল এবং মন্ত্রী সাংসদ বিধায়কদের (তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ বা জীবনদর্শনের সঙ্গে যাদের মেলে না) তুলোধনা করাই তাঁর জীবনের ব্রত বলে তিনি মনে করে আসছেন। সুতরাং তাঁর একঘেয়ে ক্লিশে বোলচাল আনন্দের স্টুডিওতে আনন্দ লহর তুললেও আমাকে টানে না--ক্লান্ত করে।
সে যাইহোক, আমাদের দেশে রাজ্যপাল ও রাজনীতি নিয়ে গবেষণাধর্মী এক বিরাট গ্রন্থ রচনার প্রচুর মালমাশলা চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু তেমন কোন গ্রন্থ রচিত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। আমার এটাও জানা নেই--রাজ্যপাল পদটি যেহেতু জননির্বাচিত পদ নয়--রাজ্যের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ পালনে বাধ্য এক অলঙ্কৃত পদ--নিজস্ব কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার বর্জিত এক পুতুল বিশেষ--তা সত্ত্বেও কেন এই বিপুল ব্যয়বহুল পদটিকে তুলে দেওয়া হচ্ছে না? রীতি ও নৈতিকতার দোহাই পেরে রাজ্যপাল নামের ব্যক্তিকে রাজভবনে আটকে রাখা সংবিধানসম্মত কিনা তা নিয়ে বিতর্কের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে বিতর্ক হয় না। 
রাজ্যপালের সুপারিশ মোতাবেক নাম্বুদিরিপাদের সরকার খারিজের মধ্যে দিয়ে রাজ্যপালকে ব্যবহারের যে কংগ্রেসী রাজনীতির সূত্রপাত হয়েছিল তা পরবর্তীতে আরও পরিপুষ্ট হয়েছে। রাজ্যপালের সুপারিশে নির্বাচিত সরকার খারিজের বৃহত্তম রেকর্ড এখনও কংগ্রেসের দখলেই রয়েছে। যখনই যে রাজ্যে কোন রাজ্যপাল সাংবিধানিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে কিছুমাত্র সক্রিয় হতে চেয়েছেন তখনই সেইসব কেন্দ্র বিরোধী সরকারের মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিরা রাজ্যপালের পদের গরিমা রক্ষার ব্যাপারে সচেতন করার প্রয়াস পেয়েছেন--যদিও যারা সচেতন করতে চেয়েছেন তারা নিজেরাই নিজেদের সাংবিধানিক গরিমাকে গোল্লায় পাঠাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না !
কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন সরকার রাজ্যপালের পদটিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের জন্যেই নিজেদের পছন্দের লোককেই ঐ পদে বসিয়ে থাকে। ফলে সঙ্গত কারণেই কেন্দবিরোধী রাজ্যসরকারের সঙ্গে একটা সংঘর্ষের বাতাবরণ তৈরি হয়। বিশেষ করে সেই রাজ্যপাল যদি জগদীপ ধনকড়ের মতো কপিবুক রাজ্যপাল হন তাহলে তো কথাই নেই। 
ধনকড়ের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কারণ তিনি দীর্ঘ পাঁচঘন্টা ধরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতে থাকা যাচ্ছেতাই রকমের নৈরাজ্য দেখতে দেখতে মুখ্যমন্ত্রী ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থদের সঙ্গে বার বার কথা বলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বাঙ্গীন নিরবতা লক্ষ্য করে অস্থির হয়ে উঠছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ও লোকসভার স্পীকারের কাছে জবাবদিহির দায়বদ্ধতার কারণে। শেষপর্যন্ত আর চুপ করে বসে থাকাটা শুধু রাজ্যপাল হিসেবেই নয়--বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য্য হিসেবেও যুক্তিযুক্ত মনে হয় নি। তিনি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয়মন্ত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর এই সক্রিয়তাকে অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ অসাংবিধানিক অতিসক্রিয়তা হিসেবে চিহ্নিত করে রাজ্যপালকে রাজনৈতিক পক্ষপাত দুষ্ট ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরেছেন !
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ‘‘পরম্পরা’’ (আইন ও সংবিধানসম্মত নয়) রক্ষার জেদে উপাচার্য্য ‘‘মরে গেলেও পুলিশ ডাকবেন না ‘’ বলে চুড়ান্ত নাটকীয় একটা সিকোয়েন্স তৈরি করে সোজা তাঁ ডেপুটিকে নিয়ে একটা বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে শয্যা নিলেন ! এর পরেও আচার্য্য-রাজ্যপাল কেন রাজভবনে বসে বসে যাদবপুর ক্যাম্পাসের তামাশা উপভোগ করলেন না--এমন প্রশ্নে রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হতে থাকল ! এ প্রসঙ্গে বর্ষীয়ান পোড় খাওয়া রাজনৈতিক নেতা তথা মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের স্পষ্টভাষণ আমার কাছে যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত এবং গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে।
আজ আনন্দের খোশ বৈঠকে ভদ্রবাবু পুলিশ না ডাকার পরম্পরা রক্ষা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কি ভাবে উপাচার্য্য ছুরিকাহাত হয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন সেই ‘‘গৌরবময়’’ স্মৃতিচারণ করলেন। তাঁর স্মৃতিচারণের জোশ দেখে মনে হচ্ছিল ছাত্রবিক্ষোভে উত্তাল সেদিনও তেমনই কিছু একটা ঘটলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুকুটে আর একটি গৌরবময় পালক যুক্ত হতে পারত--কিন্তু রাজ্যপাল তা হতে না দিয়ে খুব পক্ষপাতমূলক রাজনীতি করলেন !
রাজ্যপাল সাংসদ তথা কেন্দ্রীয়মন্ত্রীকে উদ্ধার করে আনার পর যাদবপুরের ছাত্রদের বিরুদ্ধে--বামনেতাদের বিরুদ্ধে-তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে যেমন একটাও নিন্দাসূচক বা সমালোচনামূলক মন্তব্য করেন নি--তেমনই চার নম্বর গেটে উন্মত্ত বিজেপি কর্মীদের তাণ্ডবেরও নিন্দে করেন নি। করেন নি কারণ, তিনি আসলেই রাজনীতি করার জন্য সেখানে যান নি। যদি তিনি উভয়পক্ষেরই নিন্দে করতেন বা সমালোচনা করতেন তাহলেও তিনি রাজনীতিই করতে গিয়েছিলেন বলা হত--এবং তিনি রাজ্যপাল বলেই কারুর বিরুদ্ধে কোন মন্তব্য না করেও তিনি রাজনীতি করেছেন--এমনটাই বলা হল। যাদবপুরের ঘটনার সম্পূর্ণ দায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ-রাজ্য প্রশাসন এবং হাইকোর্টের নির্দেশকে চরম পরিস্থিতিতেও ভায়োলেট করে পরম্পরাকে রক্ষার মানসিকতার। রাজ্য প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেন তাহলে চার নম্বর গেটে বিজেপি কর্মীরা তাণ্ডবের সুযোগ পেত না।
রাজ্যের কোন বিরোধী দলের অনশন মঞ্চে একাধিকবার ছুটে যাওয়া বা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীকে দেখতে যাওয়া রাজ্যপাল যদি পক্ষপাতমূলক রাজনীতিক চিহ্নিত না হন তাহলে ধনকড় কেন চিহ্নিত হচ্ছেন?--আসলে এটাই হল প্রকৃত রাজনীতি। 
আমি আগেও বলেছি--আবারও বলছি--জগদীপ ধনকড় আসলেই একজন কপিবুক রাজ্যপাল--রীতি-নীতি-আইন-সংবিধানের অজুহাতে তাঁকে তার কাজ থেকে আটকানো যাবে না। ফলে সংঘর্ষের মাত্রা যত দিন যাবে বাড়তে থাকবে। রাজ্যসরকার তার মোকাবিলা কিভাবে করে সেটাই এখন দেখার !

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.