প্রসঙ্গ : মোদী-মমতা সাক্ষাৎ ও রাজীব-এনআরসি ভবিষ্যৎ!!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়: কয়েকদিন আগেও মনে হয়েছিল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর ইহজীবনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখ দর্শন করবেন না। লোকসভা নির্বাচনের আগে ও পরে তিনি মোদীর বিরুদ্ধে যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে একের পর এক মর্মঘাতী বাণ হেনেছিলেন তাতে কারুর পক্ষেই মনে করার কোনরকম অবকাশ ছিল না যে মুখ্যমন্ত্রী অযাচিতভাবেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে দিল্লি ছুটে যাবেন।
তাঁর এই সময় নির্বাচন নিয়েও বিরোধীরা যে সঙ্গত কারণেই নানান প্রশ্ন তুলবেন তাও অপ্রত্যাশিত ছিল না। ‘হরিদাস পাল’ প্রধানমন্ত্রীকে কোমরে দড়ি পরিয়ে ঘোরানো, কান ধরে ওঠবোস করানো, মিষ্টিতে বালি পাথরকুচি মেশানো থেকে গণ্ডদেশে সাংস্কৃতিক থাপ্পর লাগানোর মতো সব ভাষা ও হুঙ্কারের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় প্রকল্প খারিজ করে দেওয়া, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বৈঠকে অনুপস্থিত থাকার মতো সব পিলে চমকানো রেকর্ড সৃষ্টিকারী মুখ্যমন্ত্রীর এই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার নিয়ে বিতর্ক যে তুঙ্গে উঠবে এবং বিরোধী শিবিরে হাজারো প্রশ্নের জন্ম দেবে--এটা জেনে ও বুঝেই মুখ্যমন্ত্রীকে ‘রাজ্যের কিছু সমস্যা’ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে আকস্মিকভাবেই ছুটতে হল দিল্লিতে !
রাজ্যে সিবিআই হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে মুখমন্ত্রীর বিশ্বস্ত আইপিএস রাজীবকুমারকে। উনি একজন আইপিএস মাত্র--চিদাম্বরমের মতো হাইপ্রোফাইল প্রাক্তন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী নন--তবু তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে চিদাম্বরমও বেপাত্তা ছিলেন--হঠাৎ করে উদয় হয়েছিলেন কংগ্রেস সদর দফতরে দলেরই এক সাংবাদিক বৈঠকে। রাজীবকুমার কোন দলের আনুষ্ঠানিক সদস্য-নেতা নন। তাই সেভাবে তাঁর আত্মপ্রকাশের সুযোগ নেই--কিন্তু আত্মগোপনের যে যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে সেটা সিবিআই বুঝতে পারছে।
অমিত শাহ কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারদা-নারদা তদন্তের জাল গুটিয়ে আনার ব্যাপারে সিবিআই রীতিমতো কোমর বেঁধে ময়দানে নেমে পড়েছে। অমিত শাহকে যারা চেনেন তারা জানেন তিনি ‘অপমান’ ভোলেন না। গুজরাটের রাস্তায় চিদাম্বরম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন একজন সাধারণ কয়েদীর মতো তাঁকে গ্রেপ্তার করে হাঁটিয়েছিল সিবিআই--সেই সিবিআইকে দিয়েই চিদাম্বরমকে তিনি বুঝিয়ে ছাড়লেন সেদিন তাঁর অপমান তাঁকে কিভাবে উত্তেজিত করেছিল। নির্বাচনের আগে বাংলাতেও তিনি বার বার অপমানিত হয়েছেন বলে বিজেপির তীব্র অভিযোগ রয়েছে। কাজেই তিনি তাঁর অপমান ভুলে তৃণমূল সরকারের প্রতি বিশেষ সৌজন্যপরায়ণ হবেন বলে ভেবে নেওয়াটা মনে হয় ঠিক হবে না। অমিত শাহ খুব নরম যে হবেন না এটা জেনেবুঝেই মোদী সম্ভবতঃ মমতাকে পরামর্শ দিয়ে থাকবেন অমিত শাহ’র সঙ্গে দেখা করার। এই সাক্ষাৎকারের ফলাফলের ওপর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় নির্ভর করছে--এনআরসি ও রাজীবকুমার।
তাঁর প্রাণ থাকতে তিনি এ রাজ্যে এনআরসি হতে দেবেন না--এমন একটা প্রতিজ্ঞা মুখ্যমন্ত্রী মমতা কলকাতার রাজপথে মহামিছিলের শেষে প্রকাশ্যেই করে রেখেছেন। জেলায় জেলায় কর্মীদের এনআরসি’র বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামিয়ে দিয়েও তিনি দিল্লিতে সাংবাদিকদের সামনে বলে বসলেন--‘একটা বিষয় আপনারা ভুল করছেন--এনআরসি অসমের বিষয়। অসম-কেন্দ্র চুক্তিতেই ওটা ছিল। বাংলায় এনআরসি’র বিষয়ে কোন প্রস্তাব নেই!’ তাঁর এই মন্তব্যে স্বাভাবিক কারণেই সবাই চমকে গেছে। বাংলায় যখন এনআরসি’র কোন প্রস্তাবই নেই তখন কলকাতায় মহামিছিল কেন? জেলায় জেলায় এনআরসি বিরোধী আন্দোলন কেন? কেন না বিজেপি ক্ষমতায় এলে এনআরসি করবে বলেই বার বার ঘোষণা করছে। তাদের এটাও বিশ্বাস ২০২১ সালের নির্বাচনে তারা ক্ষমতায় আসবে। ক্ষমতায় এলে তাদের এনআরসি কর্মসূচীকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।
বিজেপি নেতারা আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বার বার বলে চলেছেন--একুশের আগেই রাজ্যসরকার ক্ষমতাচ্যুত হবে। সেটা কিভাবে সম্ভব? রাজীবকুমারের কাছে যেসব নথিপত্র এবং ডিভাইস ইত্যাদি রয়েছে সেগুলো সিবিআই-এর হাতে এসে গেলে তৃণমূল সরকার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে? তাই কি সিবিআই মরিয়া হয়ে উঠেছে রাজীবকুমারকে খাঁচায় ঢোকানোর জন্য? যদি তাই হয় তাহলে এই মুহূর্তে রাজীবকুমারই দিল্লি-কলকাতার সৌজন্য বিনিময়ের মূল কারণ বলে ভাবছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। রাজীবকুমারের পক্ষে ততদিন আত্মগোপন করে থাকা মনে হয় কঠিন হবে না যতদিন তিনি নিজে সিবিআই-এর কাছে ধরা না দিচ্ছেন। তিনি কিছুতেই জেলে ঢুকবেন না--এটা কি তৃণমূল সরকারের কাছে খুব স্পষ্ট হয়ে গেছে? জেল এড়ানোর জন্য তিনি ততদূর যাবেন যেখানে গিয়ে তিনি সিবিআই-এর হাতে সমস্ত গোপন নথিপত্র তুলে দিতে আর কোন দ্বিধা করবেন না? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের এমন কোন নির্দেশ কি সিবিআই-এর কাছে আছে যার সূত্রে এইরকম কোন বার্তা রাজীবকুমারের কাছে দেওয়া সম্ভব যাতে বলা হতে পারে--তুমি নথিপত্র আমাদের হাতে দিয়ে লিখিতভাবে জানাও কেন এইসব নথি এতদিন আটকে রেখেছিলে--তাহলেই তোমাকে আর জেলে ঢোকানো হবে না !
এমনটা যদি সত্যি সত্যি হয় তাহলে তৃণমূল কংগ্রেস তথা সরকার যেকোন মূল্যে রাজীবকুমারকে বাঁচাবার চেষ্টা করবেই--পারবে কিনা সেটা পুরাপুরি নির্ভর করছে অমিত শাহ’র সিদ্ধান্তের ওপর। রাজীব যদি একবার নথিপত্র সিবিআই-এর হাতে তুলে দেয় তাহলে সত্যি সত্যি তাসের ঘরের মতো তৃণমূল সরকার ভেঙে পড়তে পারে। এই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই কি বিজেপি দাবি করছে--সময়ের আগেই তৃণমূল সরকার ক্ষমতাচ্যুত হবে !
যদি এনআরসি’র বিনিময়ে রাজীবকে রক্ষার ‘সেটিং’ হয় তাহলে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় টিকে হয়তো যাবে কিন্তু কোন ম্যাজিকেই ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না। এনআরসি’র বিরুদ্ধে তৃণমূলের অবস্থান যদি একটুও শিথিল হয় বা মৃদু সমর্থন পায় তাহলে ঘোরতর বিপদে পড়বে তৃণমূল কংগ্রেস। এনআরসি ইতিমধ্যেই এ রাজ্যে ভয়ঙ্কর আতঙ্কের আবহ তৈরি করে ফেলেছে। যারাই এনআরসি’র পক্ষে থাকবে রাজ্যের মানুষ তাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে। বিজেপি ঘুরে দাঁড়াতে পারে যদি তারা নাগরিকত্ব বিল এইভাবে সংশোধন করে এনআরসি’র পক্ষে থাকে যেখানে রাজ্যের কোন বাঙালি হিন্দু নাগরিককেই বিদেশি চিহ্নিত করা হবে না। বিজেপিকে বুঝতে হবে--অসম আর বাংলা এক নয়। অসমে দীর্ঘকাল ধরে বাঙালি খেদাও আন্দোলন হয়ে আসছে এবং জাতিসত্তার আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রেখে যারা অসমের রাজনৈতিক ময়দানে দাপিয়ে বেড়াতে চেয়েছে তাদেরই হাত ধরে বিজেপি সেখানে ক্ষমতায় বসতে পেরেছে। সেখানকার বাঙালি হিন্দুরা বিজেপি ও বাঙালি খেদাও অভিযানের নেতাদের রাজনৈতিক খেলাটা বুঝতে ভুল করেছিলেন বলেই তারাও বিজেপিকে ঢেলে ভোট দিয়েছেন। এখন সেই ভুলের পরিণাম তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। পরের নির্বাচনে তারা নিশ্চয়ই তাদের ভুল শুধরে নিতে পারবেন যদি এই মারাত্মক সংবেদনদশীল ইস্যুটিকে বিজেপি ও বাঙালিবিরোধী নেতাদের মুখোশ খুলে ফেলার হাতিয়ার হিসেবে ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারে। যদিও কংগ্রেসেও বাঙালি বিরোধী নেতা যে নেই তা নয়।
বাংলায় জাতিসত্তার লড়াই নেই। এখানে সারা ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষীর লোকজন নির্ভয়ে বহুকাল থেকে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছেন। এখানে এনআরসি যদি হয়ও তাহলে সেটা হতে পারে শুধুমাত্র অবৈধভাবে এ দেশে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশী-পাকিস্তানী-মায়ানমারীদের শনাক্তকরণের উদ্দেশ্যেই। এদের একটা বড় অংশই সন্ত্রাসবাদী ও আতঙ্কবাদীদের মদতপুষ্ট হয়েই এ দেশে অনুপ্রবেশ করে চলেছে। এদের বিরুদ্ধেই আনআরসি হলে বাংলার বিপুল বাঙালি হিন্দুর ভোট বিজেপি হারাবে না। অন্যথায় তাদেরও ২০২১ সালে এ রাজ্যে ক্ষমতায় ফেরা সম্ভব হবে না।
ঠিক এই জায়গাটাতেই যদি সিপিএম তথা বামফ্রন্ট কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ আন্দোলনে নামতে পারে এবং আতঙ্কিত রাজ্যবাসীকে আশ্বস্ত করতে পারে তাহলে বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা সম্ভব হতে পারে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কেউ না পেলেও সময় পরিস্থিতির দাবিতে যদি কংগ্রেস-সিপিএম-তৃণমূল সার্বিক বিজেপি বিরোধী আন্দোলনকে তীব্রতর করে তুলতে পারে তাহলে বিজেপিকে ঠেকানোর পাশাপাশি এনআরসিকেও ঠেকানো যাবে। হুজ্জুতের বশে যারা ভাবছেন বাংলায় এনআরসি’র খুবই দরকার তারা কেউ কল্পনাও করতে পারছেন না রাজ্যের হালটা কি হবে ! যারা অসমের বাঙালিখেদাও আন্দোলনের ইতিহাস ও তার শেষপর্যন্ত এই করুণ পরিণতির পূর্বাপর ইতিবৃত্ত জানেন না এবং বোঝেন না পরবর্তীকালে নিজেদেরও ক্ষমা করতে পারবেন না। বিজেপি’র রাজ্যসভাপতি’র হুঙ্কার মতো এ রাজ্যে যদি দু’কোটি মানুষকে বিদেশি চিহ্নিত করা হয় তাহলে কোন্ দেশ তাদের ফিরিয়ে নেবে? বাংলাদেশ তো ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে ১৯৭১-এর পর একজনও বাংলাদেশী ভারতে অনুপ্রবেশ করে নি। বিজেপি সভাপতি এই রাজ্যে দু’কোটি মানুষের খাঁচার ব্যবস্থা করতে পারবেন তো?
এ প্রশ্ন ব্যক্তিগতভাবে আমার একার নয়--প্রতিটি রাজ্যবাসীর। সময় ও রাজনীতি এ রাজ্যকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায় সেটাই এখন দেখার !!
কোন মন্তব্য নেই