Header Ads

এনআরসি : আজকের দিনে কী করতে হবে

হরকুমার গোস্বামী

অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক সুশান্ত কর

‘বিদেশি সমস্যা’কে  কেন্দ্ৰ করে গেল চারটি দশক জুড়ে অসমের সমাজ জীবন আলোড়িত হয়েছে  । ৩১ আগস্টে প্ৰকাশিত নাগরিক পঞ্জী  ‘বিদেশি সমস্যা’টি যে আসলে অসমিয়া  অভিজাতদের একটি অংশের সৃষ্টি তথা আরোপিত এক কাল্পনিক সমস্যা, সেই কথাটিই যুক্তি নিৰ্ভর ভাবে সাব্যস্ত করল। নাগরিকদের  একাংশের  প্ৰতি করা পক্ষপাতমূলক আচরণ, চরম অমানবিকতা, অহেতুক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ইত্যাদি থেকে শুরু করে  অজস্ৰ ত্ৰুটি বিচ্যুতিতে প্ৰক্ৰিয়াটি  ভারাক্ৰান্ত, তৎসত্ত্বেও এটিই লাখ লাখ বাংলাদেশিতে  অসম ভরে যাবার তথা ভূমিপুত্র (খিলঞ্জিয়া)-দের অস্তিত্বের  প্ৰতি হুমকি বলা প্রচারিত কল্পকাহিনিগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়েছে। দশকের পরে দশক ধরে চালানো কুটিল বর্ণবাদী উগ্রজাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে প্রত্যাহ্বানের মুখে ঠেলে দিয়েছে। 

           যারা সেই সেদিন অব্দি এনআরসি-র অত্যুৎসাহী সমর্থক ছিলেন, যারা এনআরসি প্রক্রিয়ার ত্রুটি বিচ্যুতিকে যারাই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন তাদের ‘বিদেশির রক্ষক’ ‘অসম দ্রোহী’ বলে নিন্দার ঝড় তুলছিলেন তারাই আজ এন আর সি-কে নাকচ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন।  কল্পকল্পকাহিনিগুলো চিচিং ফাঁক হতেই যে তাদের আপত্তি, সেই কথাটি স্পষ্ট।  এন আর সি প্রক্রিয়াকে  প্ৰলম্বিত তথা দীৰ্ঘস্থায়ী করার কৌশল তৈরিতে  কেন্দ্ৰ তথা রাজ্যের ক্ষমতাসীন শাসক শ্রেণির ভূমিকা সবার জ্ঞাত।  এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্ষমতার অলিন্দে অলিন্দে বিচরণ করে দালালি তথা জাতিরক্ষার বাগাড়ম্বরে প্রচার মাধ্যমের মধ্যমণি হয়ে লম্ফ ঝম্প করে যারা—সেই তারা। সেসব কথা আর এখন লুকোনো নেই।  ভারত সরকারের বৈদেশিক পরিক্ৰমা মন্ত্ৰালয় যখন নাগরিক পঞ্জীর প্ৰক্ৰিয়াকে  স্বচ্ছ, সম্পূৰ্ণ বৈজ্ঞানিক এবং উচ্চতম ন্যায়ালয়ের দ্বারা নিৰ্ধারিত প্ৰক্ৰিয়া বলে স্বাগত জানিয়েছে, তখন  শাসক দলের এন আর সি বিরোধী স্থিতি তাদের দুমুখো তথা চরম প্রতিক্রিয়াশীল রূপটিকে উন্মোচিত করে। এরা এন আর সি-কে একটি  রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে অনন্ত কাল ধরে  ব্যবহারোপযোগী করে রাখতে চায়, চায় ‘বিদেশি’ ইস্যুটিকে জীইয়ে রাখতে।  কারণ ইস্যুটি বেঁচে থাকলে এদের লাভ।  ইস্যুটি থাকা মানেই  বিভাজনের খেলাটি খেলতে থাকা যাবে। ইস্যুটি থাকা মানেই হচ্ছে অসমের প্রকৃত ইস্যুগুলোকে ঢেকে রাখা যাবে। 

এন আর সি-তে নাম এলো না ১৯,০৬,৬৫৭ জনের। এইসব মানুষের নাম তালিকাতে  অন্তৰ্ভূক্তির থেকে বাদ গেল বিভিন্ন কারিগরি কারণে, ভবিষ্যতে এদের বহুর নাম নাগরিক পঞ্জিতে আবার ঢুকে যাবে।  কী করে বাদ গেল, কেন বাদ গেল, কী কারণে কজনের নাম বাদ গেল ইত্যাদি নিয়ে বৈদ্যুতিন মাধ্যম অহরহ সম্প্রচার করে যাচ্ছে গ্রাউন্ড জিরো রিপোর্ট।  নিঃসন্দেহে নেই নেই করে হলেও ১৯,০৬,৬৫৭ জনের  তিন চতুৰ্থাংশের  নাম যে এন আর সি-তে প্রবেশ করবে সেটি নিশ্চিত।  শেষ অব্দি ঝাড়াঝাড়ি করে হয়তো আমরা পাব তিন চারলাখ মানুষের নাম। যারা ব্যর্থ হবেন দলিল দস্তাবেজ দিয়ে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণে। তাদের শ্রেণিগত অবস্থান কী—সেইসব পূর্বানুমান করতে অসুবিধে হবার কথা নয়। সমাজের সবচাইতে নিচের স্তরটিতেই যে এদের অবস্থান তা নির্দ্বিধাতে বলে দেওয়া যায়। 

এন আর সি-তে যাদের নাম এলো না, বলা হচ্ছে তাঁদের নাম তুলবার জন্যে ট্রাইব্যুনালে আপীল করতে হবে।  ট্রাইব্যুনালের রায় যদি বিরুদ্ধে যায়, তবে  ভুক্তভোগী উচ্চতর তথা উচ্চতম ন্যায়ালয়ের দ্বারস্থ হতে পারবেন। কথাটি বলা যত সহজ, আসলে কি ততই সহজ? সরকার দুৰ্বলদের  ট্রাইব্যুনালে আপীলে আইনি  সহায়তা দেবার কথা বলছেন। দুৰ্বলদের প্ৰতি সরকারি সহায়তা ন্যায় ব্যবস্থার একটি প্রতিষ্ঠিত নীতি, সরকার অন্তত এই ক্ষেত্রে নিজের দায়বদ্ধতা  অস্বীকার  করেন নি। আসু এর তীব্র বিরোধিতা করেছে। প্রশ্ন তুলেছে, বিদেশির বেলা সরকারের এতো দরদ কেন? জেনোফোবিয়া তথা ঘৃণার রাজনীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত আসুর এই প্রতিক্রিয়া অবশ্য প্রত্যাশিত।  বিজেপি, কংগ্রেস, অগপ সহ  কিছু দল তথা সংগঠন এন আর সি-চ্যুতদের ট্রাইব্যুনালে আইনি সাহায্য দেবার কথা বলছে। ভোটের রাজনীতির অঙ্কই যে এন আর সি-চ্যুতদের প্ৰতি এদের প্রেম  উথলে  উঠবার কারণ তা সহজেই অনুমান করা যায়।  

বৰ্তমানের ১০০টির বিপরীতে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০০ করা হয়েছে। শ কোটির হিসেবে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এর জন্যে। ইতিমধ্যেই এনআরসি-র নামে সরকারি ভাবে ব্যয় করা হল ১৬০০ কোটি টাকা। গেল চার বছরে অন্য সমস্ত কাজ ফেলে রেখে ৫৫০০০ আধিকারিক এবং কৰ্মচারিদের ব্যস্ত রাখা হল এনআরসি-র কাজে। স্কুল কলেজের শিক্ষক পাঠদানের বদলে ব্যস্ত রইলেন এনআরসি-র কাজে,স্তব্ধ রইল উন্নয়নমূলক তাবৎ কাজ কর্ম। ১৬০০ কোটি টাকা,সরকারি খরচের হিসাব। অন্যদিকে  নাগরিকত্ব সাব্যস্ত করার নামে মানুষের হাত থেকে কত টাকা যে বেরিয়ে গেল তার হিসাব কি আমরা রেখেছি?‘রাইটস এণ্ড রিস্ক এনালাইসিস গ্ৰুপ’নামের বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষাতে প্রকাশ পেয়েছে খসড়ার থেকে নাম বাদ পড়াতে শুনানিতে যারা হাজির হয়েছিলেন তাদের সম্মিলিত ব্যয়ের পরিমাণ ৭৮৩৬ কোটি টাকা। এই হিসাবটি কোনোভাবেই অতিরঞ্জিত নয়। আসলে ৬৭,৬২০টাকা (কেন্দ্ৰীয় বিত্ত মন্ত্ৰালয়ের দ্বারা প্ৰকাশিত ২০১৮ সনের তথ্য) জনপ্রতি আয়ের রাজ্যের অর্থনীতিতে কোমর ভেঙে দেবার মতো গদার বাড়ি। গৃহযুদ্ধে ভারাক্রান্ত দেশ একটার থেকে ভয়াবহ তথা বিপৰ্যস্ত অসমের আৰ্থিক পরিস্থিতি। আগের একটি লেখাতে এনআরসি-ছুটদের মামলাগুলো  নিষ্পত্তি হতে গিয়ে ট্রাইব্যুনালে যা ধন ব্যয় হবে তার একটি হিসেব আমরা দিয়েছি। এই বিশাল সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি করতে ট্রাইব্যুনালগুলোর বাবদ কম করেও ব্যয় হবে অতিরিক্ত ৫০০ কোটি টাকা। ভুক্তভোগীদের কথা না হয় ধরলামই না। এনআরসি-র শুনানিতে যাদের আৰ্থিক কোমর ভেঙেছে তাঁরা মূলত পুব বাংলার লোক। কয়েক দশক ধরে তারা কোমর সোজা করতে পারবেন না, সে নিশ্চিত। 
এন আর সি তালিকা প্রকাশ করা থেকে আজকের দিন অব্দি বেশ কয়েকজন নতুন করে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। ক্ৰমে বেড়ে চলেছে মৃত্যু মিছিলে যোগদাতার সংখ্যা। কত ভয়ানক মানবিক সংকটে রাজ্যটি প্রবেশ করছে, এ তারই সূচক।
১৯৯৭ সনে রাজ্যের  ৩,৬০,০০০ মানুষকে ‘ডি-ভোটার’ হিসাবে চিহ্নিত করা হল। গেল একুশ বছরে বছরে ট্রাইব্যুনালের  নামে খরচের হিসেব নিন, হিসাব নিন  সন্দেহজনক বলে চিহ্নিত কতজনের নাগরিকত্বের নিশ্চিতি ট্রাইব্যুনাল দিল তারও। এখনো ঝুলে আছে অসংখ্য ‘ডি-ভোটারে’র ভাগ্য লিপি! ১৯,০৬,৬৫৭ একটি বৃহৎ সংখ্যা, ৭০টি রাষ্ট্রের নাগরিক থেকে বেশি এই সংখ্যা। যেখানে কিনা গেল ২১ বছরে নিশ্চিত হয় নি ৩৬০,০০০ জন ‘ডি-ভোটারে’র নাগরিকত্বের প্রশ্নটি সেখানে  ১৯০৬,৬৫৭ জনের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে যে সময় লাগবে তার হিসেব করুন। জবাব আপনি নিজেই পাবেন। তাই আজ প্রশ্ন করবার সময় এসে গেছে , এভাবেই আমরা সব কিছু চলতে কি দেব?

কয়েক দশক উড়ে ‘বিদেশি’প্রশ্নকে কেন্দ্র করে যে বিভেদের রাজনীতি চলছে তা অসমের সমাজ জীবনকে স্থবির করে ফেলেছে। বিধ্বস্ত রাজ্যের অর্থনীতি। শত হাজারটা সমস্যাতে ভারাক্রান্ত অসমের সমাজ জীবন। শতাব্দীর প্রলয়ঙ্করী বানের বিধ্বস্ত হবার পরেও কেন্দ্রীয় সাহায্য থেকে বঞ্চিত হন রাজ্যবাসী। একটার পরে একটা কল কারখানা বন্ধ হয়ে আসছে।   অসমের  সম্পদ রাজির উপর চলছে অহরহ লুট, কেড়ে নেওয়া হয়েছে রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা, একটার পর একটা জলবোমা অসমবাসীর মাথার উপরে সাজানো হয়েছে। বেকারত্ব, দারিদ্র্য, সীমাহীন প্রতারণা বঞ্চনার রেকর্ড হয়ে চলেছে। এইসব প্রশ্নে আমরা এক হয়ে দাঁড়াতে পারি নি। এই বাস্তবতাকে আমাদের বুঝতেই হবে। নতুনভাবে বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।  

এক নতুন গণতান্ত্ৰিক অসম যদি আমরা চাই তবে সবাই মিলে  ন্যায় এবং মানবতার পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতেই হবে, দাঁড়াতে হবে আর্তজনের পক্ষে। আমাদের গড়ে তুলতে হবে সত্যিকার এক জাতীয় ঐক্য---এটিই আজ সময়ের দাবি।  সময়ই সামনে নিয়ে এসেছে এই   মুহূর্তে তুলে ধরবার যোগ্য দাবিগুলোকে। আসুন, আমরা মন দিয়ে তাকাই, মত বিনিময় করি আর্তজনের হয়ে এই মুহূর্তে তুলবার মতো এইসব কিছু দাবি।

§ ট্রাইব্যুনালের নামে হাজার কোটি টাকার শ্রাদ্ধ নয়, নয় দীর্ঘকালীন হেনস্তা, নয় বছর বছর জোড়া অনিশ্চয়তা। প্রশাসনিক গণ-শুনানি এবং গণ-সাক্ষ্যের মাধ্যমে এন আর সি-ছুটদের তৎকালীন ভাবে ন্যায় প্রদান করা হোক।

§ ডিটেনশন ক্যাম্পের মতো অমানবিক ব্যবস্থা বন্ধ করুন। ডিটেনশন ক্যাম্পে অন্যায়ভাবে বন্দি সবাইকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হোক।

§ ট্রাইব্যুনালে বিদেশি ঘোষণা করা মামলাগুলো উচ্চতম ন্যায়ালয়ের  তত্বাবধানে উচ্চতর তথা উচ্চতম ন্যায়ালয়ের অবসর প্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে গঠিত বিশেষ আয়োগ  দিয়ে পুনরীক্ষণ করা হোক।

§ ন্যস্ত স্বার্থে 'সন্দেহজনক বিদেশি' বলে  ছাপ মেরে স্বদেশিদের বিদেশি সাজাবার ষড়যন্ত্র বন্ধ হোক। সামাজিক গণ মনিটরিং কমিটি এবং  প্রশাসনিক পদ্ধতিতে 'ডি ভোটার' সমস্যার শীঘ্র সমাধান করা হোক।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.