Header Ads

পয়লা বৈশাখ থেকে পচিঁশে বৈশাখ, নানা সুরে, কবিতায় ভরে থাকতো বৈশাখ....


সুপৰ্ণা লাহিড়ী বড়ুয়া

বৈশাখের প্ৰতিবেদন
বালিকা বেলায় জেনেছিলাম, বৈশাখ মানে কবিগুরু রবীন্দ্ৰনাথ। পয়লা বৈশাখ থেকে পচিঁশে বৈশাখ। লাল পাড় সাদা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে মা যখন হারমোনিয়ামে সুর তুলতো এসো হে বৈশাখ এসো এসো.... আমাদের প্ৰতিটি কামরার ঘুমন্ত মূহুৰ্তগুলো যেন প্ৰাণ পেয়ে উঠতো। নানা সুরে, কবিতায় ভরে থাকতো বৈশাখ। মা আবৃত্তি দারুন করতো। ‘ভগবান তুমি যুগে-যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে... কান পাতলে আজও শুনতে পাই। পৃথিবী থেকে মায়ের বিদায় নেওয়ার বয়সও প্ৰায় কুড়ি বছর হয়ে গেল। তবু মা আছে। আমার পড়াশুনা, গানের প্ৰতি টান, কবিতার ঘরকন্নার মাঝেই মায়ের সজীব উপস্থিতি। সারা বৈশাখেই মায়ের সেই শখের লাল পাড় সাদা শাড়িটা ভেসে ওঠে বার-বার। 
পরিণত বয়সে আমার নতুন মা বলেছিলেন, বৈশাখ বা বহাগ মানে বিহু। উৎসবের মাস। ভালোবাসার সময়। মানুষের সঙ্গে, ফসলের সঙ্গে, ঘরের প্ৰতিটি পশু-পাখি, আমাদের চারপাশের সজীব-নিৰ্জীব পদাৰ্থের সঙ্গে বহু দূর থেকে আসা এই অজনজাতীয় মেয়েটিকে নিয়ে বড়ই বিব্ৰত হতেন নতুন মা। জনগোষ্ঠীয় নিয়ম শেখেনি কিছুই। একটু একটু করে গল্পের মতো করে বোঝাতেন। চৈত্ৰ মাসের শেষ দিনটা গরু বিহু। সেদিন বাড়ির গৃহপালিত জন্তুদের নিয়ে উৎসব করতে হয়। ওদের জন্যেই পিঠে তৈরি করতে হয়। বাড়ির তরিতরকারী দিয়ে বরণ করতে হয়। নতুন হলুদ বাটা দিয়ে ওদের স্নান করাতে হয়। গরুর গলায় নতুন রশি। গরু বিহুতে গরুকে বেত দিয়ে মারতে নেই। ‘মাখিলতি’ পাতার ডাল গায়ে বুলোতে হয়। সেদিন গ্ৰামের গৃহস্থের বাসায় সৰ্বত্ৰ ‘জাক’ দিতে হয়। জাক কী? এক মুঠো মাটি ভাগ-ভাগ করে বাসার বিভিন্ন জায়গায় রেখে দিতে হয়। তার ওপর গাছের লাকড়ি গুড়ো করে, আগুন দেওয়া হয়। ঠিক যেমন ধুনো দেওয়া হয়। ধিক্ ধিক্ করে জ্বলে ওঠে আঁচ। গধূলির গায়ে ছোট ছোট ধোঁয়াগুলো ভাসতে ভাসতে দূরে চলে যায়। গ্ৰামের মানুষেরা ভাবে চলতি বছরের সব ভুল ত্ৰুটি-অমঙ্গল ক্ৰমশ কেটে গেল। নতুন বছরে আবার সব ভালো হবে। নতুন করে শুরু হবে। 


বছর দুই হল  শাশুড়ি মা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তবু এই বিহুতেই ওঁর শেখানো নিয়মগুলো করতে চেষ্টা করার সময় বারে বারে অনুভব হয় সাদা মেখলা চাদরের উপস্থিতি। বাগানের একশো এক ধরনের শাক তুলতে গিয়ে, গরু বিহুতে গরুকে হলুদ মাখাতে গিয়ে, ধানের ভড়ালে জাক দেয়ার সময় এমনকি হাঁস মুরগির ঘরে ঢুকেও মনে হয় তিনি আছেন। সৰ্বত্ৰ। উৎসবের নানা মূহুৰ্তে, বৈশাখের নতুন বাঁকে মায়েরা বুঝি এভাবেই সঙ্গে থাকেন।  
উজান অসমের জেরাই গ্ৰাম,মুদৈ গ্ৰাম, মুলুক গ্ৰাম, ভাটি চুক, টুলুঙা, নতুন কদমনি।.......। ছোট ছোট গ্ৰাম। মেঠো পথ। দুপাশে সবুজ। যতদূর চোখ যায় যেন সবুজ চাদর গায়ে জড়ানো এক অনন্যা প্ৰকৃতি। গত কুড়ি বছর ধরে এই গ্ৰামগুলোতে বিহুর সময় আসা হয়। প্ৰতিবারেই কিছু পরিবৰ্তন চোখে পরে। প্ৰথম যেবার আসি ১৯৯৭ সাল সেটা। গ্ৰামগুলোতে অনেক জায়গায় লাইট ছিল না। লন্ঠন। সাত তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে শুয়ে পড়তো সবাই। ভোরবেলা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তো। কৃষক পরিবারই বেশি ছিল। কাছের চা কোম্পানির কৰ্মরত বাবু বা ক্লাৰ্কও। কাঁচা বাড়িগুলোর একপাশে নিকোনো বারান্দায় তাঁতশাল। সারা বছর ধরে মেয়ে-বউরা গামছা-রুমাল-মেখলা-চাদর বপন করতো। 

উৎসবে কাছের মানুষ, বাড়িতে আসা আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবদের সেই উপহার দেয়ার নিয়ম আছে। প্ৰতি বাড়িতেই ঢেঁকি দেখতে পাওয়া যেতো। ধান কুটতো মেয়েরা। বাড়ির উঠোনে হাঁস-মুরগি। ছাট্ট বাগানটা তরিতরকারিতে সবুজ। বড় বাগান হলে কথাই নেই। বিহুর মাসটা কাজ কম আনন্দ বেশি। নতুন ফসল বপনের আগের মুহূৰ্ত। বৰ্ষা আসার অপেক্ষায়। সারা রাত ধরে বিহুর ‘হুসুরি’ চলতো। ছেলেরা বিহু গান গেয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গৃহস্থকে আশীৰ্বাদ করে। সারা বছরের মঙ্গল কামনায়। গৃহস্থ বাড়ির তৈরি পিঠে, জলখাবারের আপ্যায়ন করে। উজান অসমের গ্ৰামের বিহুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গ্ৰামের বড় বড় গাছের তলায় মেয়েরা বিহু নাচতে যায়। কী যে সুন্দর লাগে। ছেলেরাও আসে। হাসি-ঠাট্টা, ‘গছ তলর বিহু’ বলে। প্ৰেম নিবেদনের মুহূৰ্ত। বিহুর মাসে অনেক প্ৰেমিক প্ৰেমিকাকে নিয়ে চলে আসে। এটা এক ধরনের বিয়ে। ‘পলুয়া বিয়ে’। একবার বিহুতে গিয়ে চোখ পরলো কিছু বাড়ি পাকা হয়েছে। তাদের বাগানগুলোতে শাক-সবজি নয়, চা বাগান তৈরি করেছে। তাতে নাকি বেশি পয়সা। বাড়িতে টিভি বিদ্যুৎ এসেছে। পুরনো রান্নাঘরের পাশে ছোট রান্নাঘর। গ্যাস কিনেছে মানুষ। পয়সা থাকা বাড়িগুলোর পিঠেতেও পরিবৰ্তন একটু বেশি নারকেল কিংবা ব্যবহার। অনেকেই হাঁস-মুরগি তেমনভাবে পুষছে না। কারণ তারা বয়লার ফাৰ্ম খুলেছে। সময় বদলায়। মানুষের বেঁচে থাকার গল্পও বদলায়। উৎসবের রঙও পরিবৰ্তন হয়। কোন গল্পটা ভাল বা মন্দ সেটা আপেক্ষিক বদলের প্ৰভাব গুলোই প্ৰতিবেদনের বিষয়। যেমন মাঝে এক সময় বিহুর সময় বেশ কয়েকটি বাড়ির ছেলারা উধাও। নেই-নেই, কোথায় গেল? পাহাড় পেরিয়ে অন্য কোথাও। কেউ ফিরেছে, কেউ ফেরেনি। কেউ পথেই মারা গেছে। 
গত দুই তিন বছরের বহাগ ভীষণ দ্ৰুত বদলে গেছে। চা বাগনগুলো আগের মতো লাভজনক নয়। গ্ৰামের অৰ্থনীতি প্ৰশ্নের মুখোমুখি। মানুষের চাহিদাগুলোও অন্য রকম হয়েছে। মোবাইল হাতা হাতে। ছেলে মেয়েরা গ্ৰাম ছেড়ে অন্য রাজ্যে যাচ্ছে। বড় বড় শপিং মল, রেস্তোঁরা, পাবে চাকরি করবে। গ্ৰামে পয়সা নেই। একজন গেলে আরেকজনও পা বাড়ায়। এবার বিহুতেও প্ৰায় আটজন ছেলে মেয়ে কেরালায় গেছে। গ্ৰামে এখন বেশিরভাগেই টিভি, ফেসবুক, হোয়াটসআপে আনন্দ নিচ্ছে। চাল ডালের দোকানেই সন্ধ্যা হলে মদের আড্ডা। গ্ৰাম ছুয়ে সোজা চলে গেছে হাইওয়ে। সুতরাং বাইক লাগবে। ছেলেরা কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত হবে না। কিছুতেই না। লজ্জার কথা। সরকার এক টাকা কেজি দরে চাল দেবে। পঁচা হোক পোকা খাওয়া হোক তাই নিয়ে নেও। বয়স্করা নতুনদের বোঝাতে পারছে না কৃষিকাজ আমাদের বেঁচে থাকার ধৰ্ম। বীজ সংরক্ষণ আমাদের অস্তিত্ব প্ৰমাণের লড়াই। গাছ তলার বিহু নাচ প্ৰায় উঠেই গেছে। যদি টিভি লাংবাদিক আসে তাহলে একদিন কিংবা দুদিন নিয়ম রক্ষা। 
মন খারাপের বৈশাখ। কৃষিভূমি যদি শেষ হয়ে আসে। কৃষক হয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা চলে যেতে থাকে। নিজেদের লোক জীবনের লোক সংস্কৃতির প্ৰতি দায়বদ্ধতা যদি হারিয়ে যায়। বহুজাতিক কোম্পানির হাতে নিজের পূৰ্বপুরুষের মাটি তুলে দিতে অপরাধ প্ৰবণতা গ্ৰাস না করে গ্ৰামের পাশের জঙ্গল কেটে রিসোৰ্ট হবে। গ্ৰামের পুকুর, খাল-বিল বুজিয়ে অন্য কোনও পরিকল্পনা তৈরি করা হবে। মোবাইল টাওয়ারের প্ৰতাপে বিহু পাখিরা মারা যাচ্ছে। পরিবেশটাই অন্যরকম। গত কুড়ি বছরের আমার দেখা গ্ৰামগুলো এক অন্য পৃথিবী হয়ে যাচ্ছে। স্মাৰ্টসিটিকে বাঁচিয়ে রাখতে ছেলেমেয়েরা সস্তা শ্ৰমিক হয়ে ছুটছে। বড় বড় মোবাইল কোম্পানিগুলো মঞ্চ তৈরি করে বিহু অনুষ্ঠান করছে। নামি দামি তারকারা কয়েক লক্ষ টাকার পারিশ্ৰমিক নিয়ে বিহু গান গাইছে। বিহু গানের সুরেও সেই গ্ৰামীণ কৃষিজীবনের ছোঁয়া নেই। আগে শহর থেকে গ্ৰামে যেতো সবাই বিহু দেখতে। এখন গ্ৰাম থেকে শহরের রকম জমক আলো, রোশনাই দেখতে ছেলেমেয়েরা আসছে। 
গ্ৰামের জীবন এখন ক্ৰমশ রক্তাল্পতায় ভোগা ফ্যাকাসে নারীর মতো। সুস্থ সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব কিন্তু গ্ৰামের ময়েদেরই নিতে হবে। বুঝতে হবে সব পরিবৰ্তনই উন্নয়ন নয়। সন্তানকে বোঝাতে হবে সঠিক জীবনবোধের পরিভাষা। এই বৈশাখ, এই বহাগ হাত ধরার সময়। হাত ছাড়ার নয়। একক জীবন যাপন নয়, প্ৰয়োজন এক সংঘবদ্ধ কৌম জীবন। আমার বিশ্বাস, আবারও জেগে উঠবে গ্ৰাম, গ্ৰামীণ মায়েরা। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.