Header Ads

নির্বাচনী কথা, লিখেছেন মলয় কান্তি দে



ভোট দিয়ে কী হয়? ভোট দিয়ে কি আমরা আমাদের পছন্দের সরকার বানাতে পারি? আমাদের ভোটে  যে সরকার হয়, সে কি সত্যিই আমাদের সরকার? আমাদের মানে তো জনগণের, অর্থাৎ যে সরকার জনগণের কথা ভাববে। জনগণের কথা ভেবে প্রতিটা সিদ্ধান্ত নেবে। জনগণ কী চায়? জনগণ বসে খেতে চায় না, তারা রোজগারের সুযোগ চায়। তারা চায় নিত্যপ্রয়োজনের জিনিষগুলো তাদের  সামর্থ্যের  মধ্যে থাকুক। তারা শিক্ষা চায়, অসুখ বিসুখে চিকিৎসা চায়। বিশুদ্ধ পানীয় জল আর নির্মল হাওয়া চায়। রাস্তাঘাটের উন্নতি চায়। সমাজে শান্তি চায়, যাতে তারা নিরাপদে খেটে খেতে পারে। এই চাওয়াগুলো কি খুব বেশী কিছু? কোনও সরকারই কেন মানুষের এই সামান্য চাহিদাগুলো মেটাতে পারে না? পারে না, কারণ এই প্রত্যেকটি চাওয়ার পথে কাঁটা ফেলে রেখেছে পুঁজিপতিরা। এই সব দাবির যে কোনও একটা মিটাতে গেলেই পুঁজিপতিদের স্বার্থে আঘাত পড়ে। পুঁজিপতিদের স্বার্থ আর সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিপরীতমুখী। পুঁজিপতিরা চায় কম লোক খাটিয়ে বেশী মুনাফা করতে, ফলে রোজগারের সুযোগ কমে। জিনিষপত্রের দাম কমালে তাদের মুনাফা কমে, তাই তারা জিনিষপত্রের দাম কমাতে দেয় না। সরকারী  খরচে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিয়ে তারা চায় এগুলো নিয়ে ব্যবসা করতে, মুনাফা বাড়াতে। কল  কারখানায় দূষণ রোধ করতে তাদের বাড়তি খরচ হয়, তাই তারা অবলীলাক্রমে দূষিত বর্জ্য মিশিয়ে দেয় জলে হাওয়ায়, আর সেই দূষিত জল-হাওয়া ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় মারণ রোগ। রাস্তাঘাট বানানোর টাকা নয়ছয় করে তারা মুনাফা বাড়ায়। মুনাফার ভাগ দেয় নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের। ফলে নেতা-মন্ত্রী চুপ, দুর্ভোগ কেবল জনসাধারণের। এই পুঁজিপতিরা কিছুতেই চায় না, সাধারণ মানুষের  ভাল হোক। কিন্তু আমাদের সরকার কেন তাদের কথা শোনে? ওই পুঁজিপতিরা কি ভোট দিয়ে সরকার বানাতে পারে? ক’টা ভোট আছে তাদের? ভোট তো  সব আমাদেরই হাতে। ভোট আমাদের হাতে, কিন্তু ক্ষমতা আমাদের হাতে নয়। ব্রিটিশের হাত থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে এমন একটা শ্রেণীর হাতে, যারা আসলে দেশীয় পুঁজিপতি আর বড় বড় ভূস্বামীদের প্রতিনিধি। তারা গণতন্ত্রের একখানা সাইনবোর্ড বানিয়েছে। সবাইকে বলছে, এই গণতন্ত্রে জনগণই সরকার বানাবে। কিন্তু এমন একখানা নির্বাচনের ছক সাজিয়ে  রেখেছে, যে ছকের মধ্য দিয়ে কেবল তাদের পছন্দের লোকই শেষ পর্যন্ত সরকার বানাতে পারে। অন্যরা বড়জোর কিছু কিছু আসন  পাবে, কিন্তু সরকার বানাতে পারবে না। প্রথমেই আসে টাকার কথা। টাকা ছাড়া এ দেশে নির্বাচন জেতা যায় না। আর টাকার পরিমানও নেহাত কম নয়। এক একটা নির্বাচনে জয়ী হতে গেলে এক একজন প্রার্থীর কোটি টাকার উপর খরচ পড়ে। কে জোগাবে সেই টাকা? যে জোগাবে, সে কি এমনি এমনি জোগাবে? সে তো চাইবেই তার টাকা সুদে আসলে বহুগুণ হয়ে ফেরত আসুক। তাই তো আমাদের দেশের নির্বাচন আসলে দু-নম্বরী টাকার খেলা। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনের খরচ জোগায় পুঁজিপতিরা। এই সব দল ক্ষমতায় এসে সেই সব পুঁজিপতির স্বার্থ দেখবে না তো কি জনসাধারণের স্বার্থ দেখবে? ফলে এই নির্বাচন-ব্যবস্থা এমনই এক গ্যাঁড়াকল, যেখানে পুঁজিপতিদের টাকায় নির্বাচন খেলে জিতে গিয়ে সরকার বানাতে হবে এবং সেই সরকার বানিয়ে কেবল পুঁজিপতিদের স্বার্থেই কাজ করতে হবে। মুখেই শুধু বলা হবে, এটা গণতন্ত্র, এখানে জনগণই সব। কার্যত জনগণের হাতে শুধু ভোট দেবার ক্ষমতা। অন্যকে জেতানোর ক্ষমতা। নিজে দাঁড়াবার, বা নিজের পছন্দের মানুষকে জিতিয়ে আনার ক্ষমতা নেই। ফলে এই নির্বাচন ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের সমস্যার কোনও সমাধানও নেই।  
কেন আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা এত ব্যায়বহুল? আসলে এটা যেন একটা খরচের প্রতিযোগিতা। যে বেশি খরচ করবে, তারই জয়ের সম্ভাবনা বাড়বে। তাই বড় বড় সভা সমাবেশ, গাড়ি ভাড়া করে গ্রাম থেকে  মানুষ আনা, সভায় ভিড় বাড়ানো, তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা, চারদিকে প্রার্থীদের, নেতাদের বিশাল বিশাল কাট-আউট, ফেস্টুন, দেয়াল লিখন। বিশাল কর্মীবাহিনীর খরচ জোগানো। আজকাল তো নির্বাচন মানে এক বিরাট বিপণন ব্যবস্থা। এখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কী করে সম্ভব? এ যেন শুরুতেই বলে দেওয়া হল, টাকা থাকে তো খেলবে এসো। যারা এই গণতন্ত্রের সাইনবোর্ড খানা ঝুলিয়েছে, তারাও চায় নির্বাচনে প্রচুর টাকা খরচ হোক। একটা উৎসব উৎসব ভাব আসুক। না হলে যে ভোটে মানুষের উৎসাহ কমে যাবে! এমনিতেই তো সারা দেশের এখন গড়ে ষাট শতাংশের বেশী ভোট পড়ে না। সাইনবোর্ড-ওলাদের কাছে এটা দুশ্চিন্তার বিষয়। মানুষ যদি ভোটই দিতে না আসে, তা হলে গনতন্ত্রের মান থাকে না। সারা পৃথিবী আঙ্গুল উঁচিয়ে বলবে, অমুক দেশে গণতন্ত্র নেই। তাই মানুষকে ভোটদানে আগ্রহী করতে সরকার বিপুল অর্থ খরচ করে। দামী দামী তারকাদের দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়। বলা হয় নির্বাচন গণতন্ত্রের মহোৎসব। বলা হয় আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র। ঢপের চপ গণতন্ত্র আর ঢপের চপ উৎসব।
তবে সবাই যে পুঁজিপতিদের টাকায় ভোট লড়ে, তা নয়। পুঁজিপতিরাও যাকে তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করে না। তারা কেবল সেই দলকে সাহায্য করবে, যে দল জিতে আসতে পারে। শাসকদল তো সেই সাহায্য পাবেই, এমন কি বিরোধী দলও পায়, যদি তারা বিশ্বাস জাগাতে পারে যে এবার তারাই আসছে ক্ষমতায়। বাকিরা কোত্থেকে পায় ভোট খেলার টাকা? বামপন্থীরা বেশীর ভাগই নির্ভর করে তাদের কর্মী ও সমর্থকদের চাঁদায়। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ট্রেড ইউনিয়নগুলোও চাঁদা দেয়। শুধু চাঁদা নয়, তারা  আদর্শের খাতিরে নিখরচায় প্রচারের কাজও সামলায়। কিন্তু এতেও কাজ হয়না, যদি না দলগুলো মানুষের নানা ন্যায্য আন্দোলনে নিজেদের জড়িয়ে রাখতে পারে। আন্দোলনের ঢেউয়ে ভেসে নির্বাচন জিতে শাসন-ক্ষমতায় আসার নজির আমাদের দেশে অনেক আছে। মণ্ডল আন্দোলন থেকেই ক্ষমতায়  এসেছেন লালুপ্রসাদ, মোলায়েম সিং। অসমে বহিরাগত বিরোধী আন্দোলন থেকেই ক্ষমতায় এসেছে  অসম গণ পরিষদ। পশ্চিম বাংলায় সাধারণ মানুষের আন্দোলনের হাত ধরেই বাম ফ্রন্টের ক্ষমতায় আসা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ক্ষমতায় আসার পর এই দলগুলো মানুষের সমস্যার কোনও সমাধান দিতে পারে না, কারণ চাবিকাঠি আগলে রেখেছে পুঁজিবাদের দালালরা। ক্ষমতায় এসে তারা আর আন্দোলনেও থাকে না, ফলে জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। তখন ক্ষমতায় টিঁকে থাকতে গেলে পুঁজিপতিদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা ছাড়া উপায় নেই। 
অথচ সরকার চাইলে কিন্তু এই ব্যবস্থায় এমন কিছু সংশোধন আনতে পারত যাতে নির্বাচনের খরচ কমে এবং কাউকে পুঁজিপতিদের টাকার ওপর নির্ভর না করতে হয়। ব্যায়বহুল প্রচার নিষিদ্ধ করে শুধুমাত্র  সরকারের গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে সমস্ত প্রার্থীর জন্য সমান প্রচারের সুযোগ করে দিতে পারত। বড় বড় সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করতে পারত। যে কোনও ধরণের বিপণন নিষিদ্ধ করতে পারত। এমন ব্যবস্থা করতে পারত যাতে টাকার জোর নির্বাচনে কোনও প্রভাব ফেলতে না পারে। কিন্তু কে আনবে সে সব সংশোধন। পুঁজিপতিরা আনতে দেবেই বা কেন? নির্বাচন-ব্যবস্থা তাদের হাত থেকে বেরিয়ে গেলে তাদের আর হাতে থাকল কী? ফলে সাধারণ মানুষের মৌলিক সমস্যা নিরসনের কোনও রাস্তাই খোলা  নেই। তাহলে কী আমরা ভোট দেব না? অবশ্যই দেব। কারণ আমাদের হাতের এই ভোটাস্ত্রটা যতই ভোঁতা  হোক, এই ছাড়া তো আমাদের  আর কোনও অস্ত্র নেই। এই অস্ত্রটাকেই কাজে লাগিয়ে আর কিছু না  পারি, অন্তত খারাপের মধ্যে কম খারাপ দলটাকে বেছে নিতে পারব। যারা আমাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা না করে, আমাদের রুটি রুজির দফা রফা ঘটিয়ে শুধু দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদের  ফাঁকা বুলি শোনাচ্ছে, তাদের শাস্তি দিতে পারব। সরকার বানাতে না পারি, বিরোধী তো বানাতে পারব। গণতন্ত্রকে টিঁকিয়ে রাখতে গেলে একটা শক্ত বিরোধীপক্ষ দরকার। বিরোধী না থাকলে সরকার স্বৈরাচারী হয়ে পড়ে। এমন কি, সংখ্যার জোরে তারা তখন সংবিধানটাই পাল্টে দিতে  পারে। অনেকেই তো বলতে শুরু করেছেন, এবার জিতলে আর নির্বাচন করতে দেবেন না। সে রকম হলে কিন্তু আমাদের এই একমাত্র অস্ত্রটাও বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। তখন আর আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও দাম থাকবে  না।  কেউ এসে আমাদের দরজায় দাঁড়াবে না, কেউ আমাদের কথা শুনবে না, আমাদের কথা ভাববে না। তাই যে কোনও মূল্যে এই ভোটাধিকারটা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আর, আমাদের মৌলিক সমস্যাগুলোর কী হবে? না, এই নির্বাচন ব্যবস্থা আমাদের মৌলিক সমস্যার কোনও সমাধান দিতে পারবে না। তার জন্যে চাই আন্দোলন, পথে ঘাটে হাটে মাঠে আন্দোলন। আন্দোলনের কাছে হার মানবে না এমন শক্তি ভূ-ভারতে নেই। আর আন্দোলন যদি না করতে পারি, তাহলে মনে রাখতে হবে, we deserve to be treated like a ভেড়ার পাল। আমাদের উদ্ধারের আর কোনও পথ খোলা নেই।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.