Header Ads

যতটা হচ্ছে তা যথেষ্ট নয়, নারীকে এগোতে হবে আরও অনেকটা পথ



রিংকি মজুমদার 

জন্মলগ্নে একটি মেয়ে সন্তান কিন্তু জানে না, সে নারী, না পুরুষ। তারপর পদে পদে তাকে টিপ পরিয়ে, ঝুঁটি বেঁধে, পুতুল খেলিয়ে, রান্নাবাটি ধরিয়ে দিয়ে, বাইরে ঘোরা বন্ধ করে, মুখে সর-হলুদ মাখিয়ে সামাজিকভাবে তাকে ক্ৰমশ মেয়েলি করে তোলা হয় আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থায়। আস্তে আস্তে যখন সে বড় হয় তার পরিবার, আশেপাশের পরিবেশ, সমাজ ব্যবস্থা তাকে নারী করে তোলে। পুরুষের থেকে একটি মেয়ের শারীরিক গঠন স্বাভাবিক ভাবেই প্ৰাকৃতিক কারণে কোমল কিন্তু চিন্তা করার ক্ষমতা নারী পুরুষের একই। তারপর আমাদের পশ্চাৎগামী পারিপাৰ্শ্বিক পরিবেশ অৰ্থাৎ পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থাই নারীকে পরিপূৰ্ণ মানুষ হিসেবে সম্মান না দিয়ে মেয়ে সন্তানকে অবলা, অৰ্ধাঙ্গিনী রূপে গড়ে তুলছে। তবে বৰ্তমানে মেয়েরা আগের তুলনায় অনেক এগিয়ে এসেছে। সুখের কথা এই , মেয়েদের মধ্যে সেই চেতনা বোধটা আস্তে আস্তে জাগছে। তবে যতটা হচ্ছে তা যথেষ্ট নয়। আরও এগোতে হবে। অনেকটা পথ।  আমাদের দেশে আজ থেকে ৪০ বছর আগেও আমাদের রক্ষণশীল সমাজে  মূলস্ৰোতের নারীদের কথা বাদ দিয়ে সমাজে এগিয়ে চলার ক্ষেত্ৰে সাধারণ ঘরের মেয়েদের খুব একটা প্ৰাধান্য দেওয়া হত না। তার উপর উত্তরপূৰ্বাঞ্চলে অসমের মতো জায়গায় মেয়েদের অবস্থান আরও শোচনীয় ছিল। ঠিক সেই সময়ে আজ থেকে ৪২ বছর আগে ১৯৭৬ সালে অসমিয়া সমাজে মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন নারী মিলে গঠন করেছিলেন ‘অসম লেখিকা সংস্থা’। তখনকার দিনে বেশিরভাগই তো একান্নবৰ্তী পরিবার ছিল। শশুর-শাশুড়ি, স্বামী, পুত্ৰ, কন্যা, ঠাকুরপো, ননদ, ঘর সংসার সামলে একজন নারীর পক্ষে একটি সংস্থা চালানো যে কতটা দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সংস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল অসমিয়া সমাজে নারীদের ঘর-সংসার ছাড়াও লেখালেখির মাধ্যমে নিজের জন্য একটা আলাদা পরিচয় তৈরি করা। এতে করে অসমিয়া সমাজে বহু নারীই লেখালেখির জগতে নিজের আত্মসম্মান, আলাদা করে একটি পরিচয় তৈরি করেওছেন। এরপর ১৯৯৯ সালে গঠন হয় ‘পূব গুয়াহাটি লেখিকা সংস্থা’। দিন দুয়েক আগে সংস্থার সপ্তম দ্বি-বাৰ্ষিক অধিবেশন হয়ে যায়। যেখানে সম্মানীয় মুখ্য অতিথির আসন আলোকিত করেছিলেন অসম লেখিকা সংস্থার প্ৰাক্তন সভানেত্ৰী তথা সাহিত্যিক হরপ্ৰিয়া বারুকিয়াল বরগোহাঞি। এছাড়াও অনুষ্ঠানে ছিলেন সংস্থার সভানেত্ৰী মঞ্জুলা শৰ্মা ভট্টাচাৰ্য, সংস্থার কাৰ্যকরী সভানেত্ৰী মৃদুলা শৰ্মা, সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার প্ৰাপ্ত সাহিত্যিক ড০ জয়ন্ত মাধব বরা, সাহিত্যিক নিরুপমা বরগোহাঞি, বিশিষ্ট সাংবাদিক সাহিত্যিক সুপৰ্ণা লাহিড়ী বড়ুয়া প্ৰমুখ।
এদিনের অধিবেশনে ‘নারীর সম্মান রক্ষায় সমাজের ভূমিকা’ নিয়ে বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক সুপৰ্ণা লাহিড়ী বড়য়া। তিনি বলেন- এক সঠিক সময়ে সংস্থা আলোচনার জন্য সঠিক বিষয় নিৰ্বাচন করেছে।  প্ৰাক কৃষি ব্যবস্থার সময় যখন আমাদের সমাজে কোনও উৎপাদন ছিল না। পরিবার সৃষ্টি হয়নি।  তখন মেয়েরা কোলে সন্তান নিয়ে খাবার সংগ্ৰহ করতে বনে জঙ্গলে জীবজন্তুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। আদি কাব্যগ্ৰন্থ ঋক বেদে বহু মহিলা কবি যেমন অদিতি, ইন্দ্ৰানী, দক্ষিণা, অপরা নাম ছিল। সে সময়টা নারীর জন্য সোনালী যুগ ছিল। সেসময় নারী অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছিল। নিজের ইচ্ছামতো জীবন সঙ্গী নিৰ্বাচন করার স্বাধীনতা পেয়েছিল এবং সেসময় বিধবা বিবাহ বৈধ ছিল। প্ৰসঙ্গক্ৰমে তিনি ঋক বেদের যুগে বিদুষী নারী মৈত্ৰেয়ী এবং গাৰ্গীর নাম উল্লেখ করেন। পরবৰ্তীকালে ভারতীয় সংস্কৃতিতে আৰ্য এবং অনাৰ্যের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়। নারীর অসম্মানের প্ৰশ্নওটিও তখন থেকে চলে আসে। তিনি আরও বলেন, যুগে যুগে নারী নিজের সম্মান রক্ষার জন্য আত্মসম্মানের সঙ্গে যদ্ধ করেছে। আধুনিক যুগের প্ৰসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, নব্বইয়ের দশকের পর থেকে নারীর উন্নয়নের শ্লোগান যত গভীর হয়েছে, নারীর সম্মান ততই কমতে শুরু করেছে। তার কারণ বিদেশী পুঁজি এই সময় থেকেই লাগাম ছাড়া দৌড় শুরু করে। দেশের অৰ্থনীতি বহুজাতিক কোম্পানির হাতে চলে যায়। তাঁর মতে গত ৩০ থেকে ৪০ বছরে ভারতীয় নারীর সম্মান রক্ষার ক্ষেত্ৰে সমাজ ব্যবস্থা ব্যৰ্থ হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানির স্বাৰ্থ সিদ্ধির জন্য বিজ্ঞাপন তথা ইন্টারনেটের মাধ্যমে নারী ক্ৰমশ পন্যে পরিণত হয়েছে। তাই আজকের দিনে নারীর সম্মান রক্ষাৰ্থে সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূৰ্ণ প্ৰশ্ন। নারীর সম্মান রক্ষাৰ্থে প্ৰয়োজন এমন অকটি মুক্ত বিচরনের সমাজ। যেখানে থাকবে এক আৰ্থ সামাজিক ব্যবস্থা। নারীর সম্মান রক্ষাৰ্থে এক দীৰ্ঘস্থায়ী সংগ্ৰামের প্ৰয়োজন রয়েছে। হতে পারে তা বৌদ্ধিক চেতনার বিকাশের মধ্য দিয়ে। তার জন্য ‘অসম লেখিকা সংস্থা’ই আগামী দিনে নারীকে পথ দেখাবে বলে আশা প্ৰকাশ করেন তিনি।
এদিনের অনুষ্ঠানে সাংবাদিক সুপৰ্ণা লাহিড়ী বড়ুয়ার বক্তব্য সংস্থার সদস্যদের আগামী দিনে আরও কৰ্মক্ষম হতে যথেষ্ট অনুপ্ৰেরণা যোগাবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্ৰে একটি কথা উল্লেখ করতেই হয় যে বিশ্বব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে। সমাজে নারী-পুরুষের ভূমিকার ব্যাপারে আধুনিক সমাজে নারীকে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে না করে একে অন্যের পরিপূরক মনে করলেই আমাদের সমাজ তথা জীবন পরিপূর্ণতা পাবে এমনটাই মনে করছেন সচেতন মহল। এদিনের অনুষ্ঠানে গীতাঞ্জলি বৈশ্য নাথের সম্পাদনায় ‘পূৰ্বাঙ্গনা’ নামের একটি পত্ৰিকা উন্মোচন করেন প্ৰখ্যাত সাহিত্যিক নিরূপমা বরগোহাঞি। গোটা অনুষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেন ‘পূব গুয়াহাটি লেখিকা সংস্থা’র সম্পাদিকা প্ৰণীতা শৰ্মা বরদলৈ। অনুষ্ঠানে সংস্থার উপদেষ্টা চিনিচম্পা মহন্ত, যুগ্ম সম্পাদিকা রীতামণি বরদলৈ, সহকারী সম্পাদিকা রঞ্জুশ্ৰী বৰ্মণ, সভাপতি মনোরমা দবী, সাংস্কৃতিক সম্পাদিকা নীতিমালা কটকী, বিনীতা ডেকা, উপ সভানেত্ৰী গীতাঞ্জলী সোণোয়াল, প্ৰকাশন সম্পাদিকা মায়া শৰ্মা সমেত সংস্থার আরও অন্যান্য সদস্য অনেকেই  উপস্থিত ছিলেন।
      

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.