অসমের দুৰ্ভাগ্য কিছু সংখ্যক পেশাদার আন্দোলনকারী সাম্প্ৰদায়িক সম্প্ৰীতিতে বিষ ঢালছে
জাতীয় সংহতির বিরুদ্ধ শক্তিকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে হবে
অতীন দাশ
‘সত্য'র জয় অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু মিথ্যার প্ৰাবল্য সাময়িকভাবে হলেও যে বৃহৎ বিনষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়– তা পূরণ করা অনেক সময়ই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অসমে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনীকে কেন্দ্ৰ করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে– তা আদ্যোপান্ত মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে। যা নয় তাই প্ৰচার করে সাধারণ মানুষকে উন্মাদ করে দেওয়ায় যে আত্মঘাতী বিড়ম্বনা তার ফল যে শেষ পৰ্যন্ত রাজ্যের জনগণকেই ভোগ করতে হবে– নূন্যতম মগজ-মস্তিষ্কের অধিকারী ব্যক্তিমাত্ৰেই তা উপলব্ধি করতে পারবেন। অসমের দুৰ্ভাগ্য যে কিছু সংখ্যক পেশাদার আন্দোলনজীবি– যারা বছরের পর বছর বিভিন্ন ছুতোনাতায় আন্দোলনের নাম করে সাধারণ জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে রাজসিক জীবন-যাপন করেন, সরকারে অধিষ্ঠিত ক্ষমতাবান ব্যক্তিরাও এই ফড়েদের প্ৰশ্ৰয় দেন রাজনীতির বাণিজ্যে লাভালাভের দিকে নজর রেখে। কিন্তু সবচেয়ে পরিতাপের বিষয়, কিছু কিছু বুদ্ধিজীবি, শিল্পী, সাহিতি্যকরাও এই স্বাৰ্থান্ধ নিৰ্বোধদের কাতারে এসে পা মেলান যা একদিন তাদের বিবেককে যে প্ৰশ্নবিদ্ধ করবে, সে সম্ভাবনা নিশ্চিত। ‘হিন্দু নাগরিকত্ব বিল' আইনে পরিণত হলে অসমে এক কোটি আশি লক্ষ বাঙালি হিন্দু এসে রাজ্যের ভূমিপুত্ৰদের সবকিছু কেড়ে নেবে– এই অপপ্ৰচারে রাজনৈতিক কাপালিকরা অসমের সহজ-সরল মানুষকে বধ্যভূমিতে এনে দাঁড় করাচ্ছে, বলা হচ্ছে– শরাইঘাটের শেষ লড়াই লড়তে হবে। কিন্তু সম্পূৰ্ণ প্ৰচারটাই যে মিথ্যা– রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকরা তা তুলে ধরতে খুব কমই বেরিয়ে আসছেন। ‘হিন্দু নাগরিকত্ব বিল' বলে কিছু নেই– নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে আসলে আফগানিস্তান, পাকিস্থান, বাংলাদেশ থেকে ধৰ্মীয় নিপীড়নের বলি হয়ে যারা ভারতে এসে আশ্ৰয় নেবে– তাদের নাগরিকত্ব প্ৰদানের কথা বলা হয়েছে। এই নাগরিকত্ব প্ৰদানও হবে সময়সাপেক্ষ, বিভিন্ন আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা তা লাভ করবেন। যে কেউ ভারতে প্ৰবেশ করামাত্ৰই নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন, এমন কোনও কথা নয়। এই অনুযায়ী যারা উল্লিখিত দেশগুলো থেকে এসে আশ্ৰয়প্ৰাৰ্থী হবেন– সারা ভারতবৰ্ষে তাদের পুনৰ্বাসন দেওয়া হবে। এক কোটি আশি লক্ষ বাংলাদেশি হিন্দু এসে অসমে হাজির হবে– এমন আষাঢ়ে গল্প একমাত্ৰ গণ্ডমুৰ্খ ছাড়া কেউ ছড়াতে পারে না। কিন্তু অসমে কিছু পণ্ডিতমন্য ব্যক্তি, টিভি চ্যানেলের দৌলতে যাদের ‘আন্তৰ্জাতিক প্ৰজ্ঞাবান' বলে বিভূষিত করা হচ্ছে, এই প্ৰচারে তারাও অংশ নিচ্ছেন। বুদ্ধিজীবিরাও যখন এ ধরণের প্ৰচারে লিপ্ত হন, জাতিবিদ্বেষী উন্মাদনায় ইন্ধন যোগান– তখন সহজেই অনুমান করা যায়, চিন্তা-চেতনার মান কোন স্তরে পৌঁছেছে।
প্ৰচার চালানো হচ্ছে যে বৰ্তমান কেন্দ্ৰীয় সরকার অসমের জাতি, মাটি এবং ভেটির পক্ষে হুমকিস্বরূপ। অসমের ‘জাতীয় নেতা' হিসেবে বিভূষিত সৰ্বানন্দ সনোয়ালের নেতৃত্বের প্ৰতিও অনাস্থা প্ৰকাশ করা হচ্ছে, বলা হচ্ছে, বিজেপি-আরএসএস-এর দাপটে অসমিয়া জাতি বিপন্ন, হিন্দুত্বের প্ৰসারই হচ্ছে– অসমিয়াত্বের বিলুপ্তি, এই পরিস্থিতির মোকাবেলায় স্বাধীন অসমের কথা ভাবা ছাড়া উপায় নেই, এই জন্য রাজনৈতিক দলমত নিৰ্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
অথচ প্ৰকৃত বিচারে কেন্দ্ৰে নরেন্দ্ৰ মোদি নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পাৰ্টির সরকার এবং রাজ্যে সৰ্বানন্দ সনোয়াল নেতৃত্বাধীন সরকার প্ৰতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই স্বল্প সময়ে অসমের জনজীবনে যে মৌলিক কিছু কাজ হয়েছে– পূৰ্ববৰ্তী সরকারের আমলে তার কোনও প্ৰয়াসই দেখা যায়নি। অসমের ভূমিপুত্ৰদের অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে আসু এবং গণসংগ্ৰাম পরিষদ পরিচালিত বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলনের ফলশ্ৰুতি হিসেবে ১৯৮৫ সালে ‘অসম চুক্তি' সম্পাদিত হয়েছিল। কংগ্ৰেস এবং অগপ দল কেন্দ্ৰ এবং রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও চুক্তি রূপায়ণে নূন্যতম অগ্ৰগতি হয়নি। তেত্ৰিশ বছর পর সৰ্বানন্দ সনোয়াল, হিমন্ত বিশ্ব শৰ্মাদের উদ্যোগে নরেন্দ্ৰ মোদি সরকার কেন্দ্ৰীয় অনুমোদন জানিয়েছে, অসম চুক্তির ৬ নং ধারা রূপায়ণে কমিটি গঠন করে দিয়েছে। এর পর যারা অভিযোগ তুলছে রাজ্যের বিজেপি সরকার অসমের ভূমিপুত্ৰদের কথা ভাবছে না– তাদের দরদ বাঙালি হিন্দুদের জন্য, এদের জ্ঞানপাপী ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! রাজ্যের প্ৰাক্তন মুখ্যমন্ত্ৰী তরুণ গগৈ, কংগ্ৰেস সভাপতি রিপুন বরা বা প্ৰাক্তন মুখ্যমন্ত্ৰী প্ৰফুল্ল কুমার মহন্তরা যখন নরেন্দ্ৰ মোদি বা সৰ্বানন্দ সনোয়ালের বিরুদ্ধে কথা বলেন– তখন তাদের কী একবারও মনে হয় না– ড০ মনমোহন সিং সংসদে অসমের প্ৰতিনিধি হিসেবে দশ বছর প্ৰধানমন্ত্ৰী, তরুণ গগৈ একনাগাড়ে পনেরো বছর মুখ্যমন্ত্ৰী এবং প্ৰফুল্ল কুমার মহন্তও দু'দফায় রাজ্যের সর্ব্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকে অসম চুক্তি রূপায়ণ বা জাতি, মাটি ও ভেটি রক্ষায় কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। জবাব নিঃসন্দেহে ‘বিগ জিরো।'
আসল ব্যাপারই হচ্ছে– রাজনৈতিক ভূমি দখলের লড়াই। বিজেপি কেন্দ্ৰে এবং রাজ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে জনপরিত্যক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই, তেমনি জাতীয় সংহতির প্ৰতিপক্ষ আঞ্চলিক রাজনীতিও অপ্ৰাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। তাই অস্তিত্বরক্ষার প্ৰেশ্ন সবাই একজোট হয়েছেন। আলফার স্বাধীন অসম-এর দাবি সামনে এনে জনগণের আবেগকে উসকে দেওয়ার সুচতুর চক্ৰান্ত চলেছে। পেছনে রয়েছে বিদেশি মদতদাতারা। দেদার অৰ্থ আসছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে। তাই তারা বেপরোয়া। দেশকে বিপন্ন করেও নিজেদের আ্যাজেণ্ডা সফল করতে চায়।
যারা স্বাধীনতার প্ৰশ্ন তুলছেন, তারা নিশ্চিতই এত মুৰ্খ নয়, তারা জানেন লড়াই লড়তে হবে ভারত নামক রার্ষ্ট্ৰের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। কাশ্মীরের অভিজ্ঞতা কী খুব মধুর। অসম রাজ্য অখিল গগৈ, হীরেন গোঁহাই বা অন্য কারও জমিদারী নয় যে প্ৰভুরা ডাক দিলেই প্ৰজারা এক কাতারে দাঁড়িয়ে যাবেন! এখানে বরাক উপত্যকা, বড়োল্যাণ্ড, চর-চাপরি, পাহাড়ি জেলা, হিন্দীবাসী এবং নানা ধরণের উপজাতিদের বাস রয়েছে। স্বাধীন অসমের জন্য নিজস্ব জমি আগে চিহ্নিত হোক, তারপর না হয় ‘আন্তৰ্জাতিক প্ৰজ্ঞাবানরা' তাদের আন্তৰ্জাতিক মুরব্বিদের দ্বারস্থ হবেন। ভারত রার্ষ্ট্ৰের প্ৰচলিত আইন মোতাবেক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্ৰহণের যে সংস্থান রয়েছে– তার প্ৰয়োগ ব্যক্তি নিৰ্বিশেষেই প্ৰযোজ্য। দেশ বিরোধীদের হয়ে যারা কথা বলেন তারাও সমদোষে দোষী। জাতীয় সংহতির বিরুদ্বে শক্তিকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে হবে।
লেখকঃ অসমের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি, বরাকের শিলচরবাসী কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক।দৈনিক যুগশঙ্খ-র প্ৰাক্তন সম্পাদক। বাঙালিদের সাংবিধানিক প্ৰদত্ত মৌলিক অধিকার, স্বাভিমান আন্দোলন নিয়ে বরাবর নিরপেক্ষ নিৰ্ভিকভাবে কলম ধরেছেন। সাহিত্যিক হিসাবে অসম সরকার তাকে পেনশন দিয়েছে। যোগাযোগঃ৭৮৯৬৮৪২৪৫৬









কোন মন্তব্য নেই