Header Ads

পিনাকী ঠাকুরঃকিছু স্মৃতি কিছু কথা

শঙ্খশুভ্র  দেববর্মণ

ব্লেড দিয়ে কাটা শিরা, ফোঁটা ফোঁটা মেঝেতে পলাশ
প্রত্যেক রক্তের বিন্দু ফুটে ওঠে বসন্তে, সবুজে

এবার পুলিশ-কেস, কাটাছেঁড়া, মর্গ, ছুটোছুটি
দু চারটে বন্ধু আর হাজার শত্রুর সা রে গা মা

আদরের নৌকোটা ক্ষীণ স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছি
কাগজের নৌকোটা কালস্রোতে ভাসিয়ে দিলাম

ঢেউ, ধাক্কা, উলটে গেল, ওই সোজা হয়েছে আবারও
কতদূর যেতে পারবে অনিশ্চিত অন্ধকার সব

এত রাতজাগা, প্রুফ, প্রেসের তাগাদা, রক্তফোঁটা
পুরনো, মলাট ছেঁড়া প্রেসিডেন্সি রেলিংয়ের ধারে ...

জেনে যেতে ইচ্ছে করে একশো বছর পর বাংলা বই কেউ পড়বে
                                                             কি না?  (আদরের নৌকা, পিনাকী ঠাকুর)


মনে পড়ছে কিছু কথা। ২০০৮'এ সাহিত্য একাডেমির এক অনুষ্ঠানে পিনাকী অনেকের সঙ্গে শিলঙে এসেছিলেন। আমি তখন শৈল শহরে। পোস্টেড। পিনাকী সোজা চলে এসেছিলেন আমার কাছে। আসলে শিলঙে আসার আগেই আমায় ফোন করতে শুরু করেছিলেন। শিলঙে আসার  ব্যাপারে  খুবই   উৎসাহী  ছিলেন।  গরমাগরম জিলিপি সহযোগে তুমুল আড্ডা হয়েছিল তখন। পিনাকী বাবু থেকে পিনাকী হয়ে উঠেছিলেন আমার কাছে। বলেছিলেন, ''আমরা বন্ধু । কেন পিনাকী বাবু বলছো আমায়।'' আমি কলকাতা কিম্বা পশ্চিমবঙ্গের কবি নই। কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম পিনাকী বহির্বঙ্গের কবিতা এবং কবিদের সম্পর্কে বেশ ভালো রকম খোঁজখবর রাখেন। কৃত্তিবাস সাহিত্য পত্রিকার জন্য তিনি তখন আমার কবিতা চেয়ে নিয়েছিলেন। আর সব সময়ই বলতেন, ছাপানোর আগে সুনীলদাকে (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) দেখিয়ে নিচ্ছি। বন্ধুত্ব এইভাবেই গাঢ়তর হয় আমাদের।  

 সন্দেহাতীতভাবেই   কবি  পিনাকী  নব্বুই  দশকের অন্যতম কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত  হয়েছিলেন। ‘’শব্দ  ব্যবহারের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী এবং সতর্ক, যতিচিহ্নগুলি তাঁর  কবিতায়  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, চারপাশকে দেখার ডিটেলে ...মাত্রামতো মজা  মিশিয়ে  দেন। এ ভাবে তাঁর  কবিতায় বুদ্ধিদীপ্ত আধুনিকতার   স্বক্ষেত্র গড়ে  উঠে।‘’ প্রতিভার  উজ্জ্বল  স্বাক্ষর রয়ে  গেছে  তাঁর বিভিন্ন কবিতায়। 
 ২০১২ সালে  পিনাকী যখন তাঁর চুম্বকের ক্ষত বইয়ের জন্য আনন্দ পুরস্কার পেয়েছিলেন – খুবই খুশি  হয়েছিলাম। তারও  আগে অবশ্য তিনি মর্যাদাব্যঞ্জক  বাংলা অ্যাকাডেমি ও কৃত্তিবাস পুরস্কারও পেয়েছিলেন। 

এদিকে আমি শিলং, মেঘালয় থেকে বদলি হয়ে রাজস্থান, বিহার, ঝাড়খন্ডের দায়িত্বভার সামলাই। তারপর দিল্লি হয়ে এই সময়ে উত্তরপূর্ব ভারত। পরিব্রাজকের জীবন যেন! পিনাকীর সঙ্গে যোগাযোগ তবু অক্ষুণ্ণ ছিল। কথা হতো সেল ফোনে।কলকাতায় সাহিত্য উৎসবে দেখা হতো। দেখা হয়েছিল ঢাকা, বাংলাদেশেও। জাতীয় কবিতা পরিষদের আমন্ত্রণে কবিতা পড়তে গিয়ে দেখি কলকাতা থেকে বীথি দি'র (বীথি চট্টোপাধ্যায়) সঙ্গে পিনাকী আর শিবাশিস চট্টোপাধ্যায় এসেছেন। ওঁদের সঙ্গে বেশ ভালোই কেটেছিল ঢাকার কবিতা উৎসবের সেই কয়েকটা দিন। 

পিনাকী তাঁর বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বহুবার। কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্বেও ব্যস্ততার জন্য কলকাতায় তাঁর বাড়িতে যাওয়া কখনও সম্ভব হয়ে উঠেনি। সেবার কলকাতায় এক সাহিত্য উৎসবে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর কবিতার বই। সেই 'বিপজ্জনক' বইয়ের প্রথম পাতায় লিখেছিলেন, প্রিয় বন্ধু শঙ্খশুভ্রকে .........। 

সেই নির্জনতার  কবি   শেষ পর্যন্ত  কোন  নির্জনে অন্তর্হিত  হলেন কে জানে!  কবিতার কাছে, জীবনের কাছে, নিজের অস্তিত্বের  কাছে  যেন  অমোঘ প্রশ্ন ছিল তাঁর; ‘’জেনে যেতে ইচ্ছে করে একশো বছর পর বাংলা বই কেউ পড়বে   কি না?’’ মহাকালের  গর্ভে নিশ্চিত লুকিয়ে   আছে  সেই উত্তর। কিন্তু কবিসুলভ  সেই  অনিশ্চয়তাবোধের  তাড়নাতেই  কী  তাঁর  কবিতার এই  সংযোজন আর সমৃদ্ধিকরণ!  তাই  হয়তো রেখে  গেলেন,  চুম্বনের ক্ষত, কলঙ্করচনা, বসন্ত মস্তান,  মৌসম,  চুম্বনের ক্ষত, জীবন বেঁধেছি   হাতবোমায়  - এইরকম কিছু অবিস্মরণীয়  কাব্যগ্রন্থ।  বাংলা কবিতার   বিবর্তনের  ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হয়ে রইল  এইসব বই।  

এই মুহূর্তে কিন্তু  আমার  মনে পড়ছে  শুধু  পিনাকীর  সেইসব কথা!  বারবারই বলতেন, শঙ্খ তোমার কাছে আসছি। ঘুরে বেড়াবো কয়েকটা দিন। পিনাকী আর এলেন না। আর কখনও কী আসবেন! বলবেন কী, ''শঙ্খ, এবার আমি অবশ্যই আসব; অনেক ঘুরবো!'' আমার সেলফোনে এখন সেই নাম্বারটা শুধু দেখি আর ভাবি ফোন করলে পিনাকী কথা বলবেন তো! 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.