Header Ads

অসমে বাঙালিদের অস্তিত্ব ও অবদান এবং সাম্প্ৰতিক এন আর সি সংকট (১)

ইতিহাসের আলোকে অসমীয়া বাঙালি সম্পৰ্ক

প্ৰদ্যোৎ গোস্বামীঃ বাসুগাঁও
অসমের বাঙালি জীবনকে এই মুহূৰ্তে ‘এন আর সি' নামক এক মহিষাসুর যেন তাড়া করে বেড়াচ্ছে। শুর দিকটায় এই এন আর সি বা নাগরিক পঞ্জিকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে কোন ধরণের বিরূপ ভাবনা কিন্তু ছিলনা। জাতি ধৰ্ম বৰ্ণ নিৰ্বিশেষে সকলেই একে স্বাগত জানিয়েছিলেন। মনে এই বিশ্বাসটুকু ছিল যে অসম আমাদের মাতৃভূমি, আমাদের স্বদেশ। তাই, স্বদেশ আমাদের প্ৰতি অবিচার করবে না। আর এই বিশ্বাসের উপর ভর করেই নাগরিক পঞ্জী নবায়ন প্ৰক্ৰিয়ায় পূৰ্ণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সৰ্বসাধারণ। সকলেই চেয়েছিলেন একটি শুদ্ধ নাগরিক পঞ্জী। বিদেশী বিতারণের নামে অসমে আর যাতে রাজনীতি না হয়, আর যাতে অসমের মাটি মানুষের রক্তে রক্তাক্ত না হয়--এমনটাই ছিল আম জনতার আশা-আকাংক্ষা। যার জন্য এই প্ৰক্ৰিয়ার যাবতীয় হয়রানি সকলে নিৰ্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিলেন একটু আশায় যে শুধুমাত্ৰ ভাষার উপর ভিত্তি করেই একটা সম্প্ৰদায়ের উপর বিদেশী বলে আঙুল তোলা এবার বুঝি বন্ধ হবে। তাই সরকারের অহেতুক আশংকাকে ভুল প্ৰমাণিত করে অত্যন্ত শান্তিপূৰ্ণ পরিবেশেই প্ৰকাশিত হয় এন আর সি-র প্ৰথম এবং চূড়ান্ত খসড়া। তবে এই চূড়ান্ত খসড়াতে কিছু করণিক বিচু্যতি ও বিসঙ্গতি ছাড়াও যে জিনিসটা স্পষ্ট ভাবেই প্ৰকাশ পেলো সেটা এই যে তালিকা থেকে বাদ পড়া মোট চল্লিশ লক্ষ সাত হাজার সাতশ সাত জন মানুষের প্ৰায় বেশিরভাগই বংগভাষী। আর তার অধিকাংশই সমাজের দরিদ্ৰ ও নিপীড়িত শ্ৰেণীর শ্ৰমজীবি মানুষ। অবশ্য এই বাদের তালিকায় বেশ কিছু অসমীয়াভাষী ও জনগোষ্ঠীয় বা জনজাতীয় মানুষও রয়েছেন। তবে চূড়ান্ত তালিকাতে তাদের নাম অন্তৰ্ভূক্তির পথ যে খুব কঠিন হবে না, একথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখেনা। কারণ অরিজিনাল ইনহ্যাবিটেন্ট অৰ্থাৎ খিলঞ্জিয়া বা আদি বাসিন্দা নামের এক বিশেষ দরজা তাদের জন্য খোলা রয়েছে। খিলঞ্জিয়া কী বা কারা? এই বিতৰ্কের সমাধান না করে শুধুমাত্ৰ ভাষা ও উপাধির উপর ভিত্তি করে এক শ্ৰেণীর মানুষকে বিশেষাধিকার প্ৰদান করা কতটা যুক্তিযুক্ত এনিয়ে একটা বিরাট প্ৰশ্ন চিহ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। যাহোক সেই বৃহৎ সংখ্যক বাঙালির মধ্যে যারা মধ্যবিত্ত, তাদের বেশির ভাগেরই সম্ভবতঃ ছেষট্টি বা একাত্তরের নথি রয়েছে। তাই দাবী প্ৰক্ৰিয়ার মাধ্যমে তাদের উতড়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এদের অন্তৰ্ভূক্তির পথ কন্টকাকীৰ্ণ করতে যেভাবে দাবার ঘুটি সাজানো হচ্ছে তাতে শরতের আকাশে কালো মেঘের ভ্ৰnকুটি দেখা যাচ্ছে স্পষ্টতই। কুটনীতির চালে হেরে গেলে জীবনের সৰ্বস্য লুটিয়েও তারা যে আইনি লড়াই লড়বেন বা লড়তে বাধ্য হবেন, এটা প্ৰায় নিশ্চিত। মধ্যবিত্তরা নিতান্তই গরীব ঐ শ্ৰমজীবি নিরীহ মানুষগুলোর, তাদের কী গতি হবে? আজীবন যারা প্ৰাত্যহিকতার পাথুড়ে যন্ত্ৰণায় জৰ্জরিত, প্ৰতিরাতে যাদের নিদ্ৰা বিঘ্নিত হয় পরের দিনের সংকুলানের ভাবনায়, তাদের থাকবে একাত্তরের আগের রেজিষ্টি্ৰকৃত জমির দলিল/ সরকারী নিয়োগপত্ৰ বা লাইসেন্সের কপি/ ব্যাঙ্ক-পোষ্ট অফিসের নথি কিংবা লাইফ ইন্সিয়রেন্স/ আসলে চল্লিশ লক্ষ থেকে সংখ্যাটাকে খুব নামানো যাবে না। না হলে যে লজ্জার শেষ নেই। তাই হয়তো সহজ সাম্ভাব্য নথি গুলোকে বাতিল ঘোষণা করে পরিস্থিতিটা কঠিন করে দেওয়া হচ্ছে। সমস্তটাই হয়ে উঠছে নথির খেলা। নথি থাকলে তুমি দেশী, নইলে বিদেশী। ঠিকানা ডিটেনশন ক্যাম্প। এরকম এক যাচ্ছেতাই মনোভাব নিয়েই যেন চলছে অসম। ভুল বলছি? তাবে আসুন আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যাক, যাতে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে উঠে। 
অসমে একটা বহু প্ৰচলিত শব্দ ‘ডি' ভোটার। বিগত দশক থেকে এটা চালু হয়েছে এরাজ্যে। বাদবাকী ভারতের কেউই, এমনকি দেশের স্বরাষ্ট্ৰমন্ত্ৰী বা প্ৰধানমন্ত্ৰীরাও নাকি কষ্মিন কালেও শব্দটা শোনেননি। (হাল অমলে অসমে এসে তারা জ্ঞাত হয়েছেন)। কী এই ‘ডি' ভোটার। ‘ডি' ভোটার মানে হল ‘ডাউটফুল ভোটার' বা সন্দেহজনক নাগরিক। হঠাৎ করেই ভোটার তালিকাতে কারো নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে এই ‘ডি'। এরাজ্যের বাঙালি জীবনে যেন উগ্ৰপন্থার থেকেও ভয়ানক হয়ে উঠেছে ‘ডি'। ‘ডি' অসলে এমন এক দৈত্যের নাম যা যেকোন সময় যেকোন মানুষের ঘাড়ে চেপে বসতে পারে। আর একবার ঘাড়ে চাপলে জীবনকে দুৰ্বিসহ করে তুলতে কোন কসুরই সে বাদ রাখে না। তাই অসমের বাঙালি জীবনে ‘ডি' এখন সবচেয়ে বড় সন্ত্ৰাসের নাম। ভাবা যায়/ শুধুমাত্ৰ সন্দেহের ভিত্তিতেই এখানে একজন নাগরিক'কে ডিটেনশ্যন ক্যাম্প নামক জেলে পাঠানো যায়, কেড়ে নেওয়া যায় তার সাংবিধানিক অধিকার। পশ্চিমবঙ্গ, ত্ৰিপুরা, মেঘালয় কিংবা বিহার, পাঞ্জাব, রাজস্থান কোথায় নেই অনুপ্ৰবেশ সমস্যা। কিন্তু, শুধুমাত্ৰ সন্দেহের বশে একজন মানুষের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেবার মতো এমন হীন প্ৰথা আর কোথাও নেই।
যাই হোক, এন আর সি নামক এই প্ৰক্ৰিয়ার মাধ্যমে এক বিরাট সংখ্যক শ্ৰমজীবি বাঙালি যে হয়ে যেতে চলেছে রাষ্ট্ৰহীন, এটা এখন প্ৰায় সন্দেহাতীত। বাঙালি জীবনের এই কঠিন সময়ে ভীত সন্ত্ৰস্ত ঐ মানুষগুলোর অসহায় মুখ যখন চারপাশে ঘুড়ে বেড়ায়, তাদের কেউবা যখন এই দুঃসহ জীবন থেকে মৃত্যুকেই শ্ৰেয় বলে ভেবে নেয়, তখন ভেতরকার সত্ত্বাটা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে প্ৰতিবাদে গৰ্জে উঠতে চায়। পদ্যের সুষমাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে গদ্যের কড়া হাতুড়িটাই তুলে নিতে চায়। এ কোন দেশে বাস করছি আমরা/
দেশ। কাকে বলে দেশ? দেশ বোধহয় এমন একটা জায়গা যেখানে শান্তিতে নিশ্বাস নেওয়া যায়। যেখানে একে অপরের প্ৰতি সহানুভূতিশীল ও সহমৰ্মী এবং একে অন্যের ভালমন্দের ভাগীদার। দেশ মানে এমন একখণ্ড মৃত্তিকা যা মানুষকে লালন করে, পালন করে পরম মমতায়। আর যখন সেই ভূমিখ` বা ভৌগলিক পরিসীমার প্ৰতি মানুষের মনে মাতৃভাবের উন্বেষ ঘটে, তখন সেটা দেশ থেকে র+পান্তরিত হয় স্বদেশে।
একদিন পূৰ্ববাংলা থেকে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে ছিন্নমূল হয়ে শুধুমাত্ৰ বেঁচে থাকার আশায় যারা এসে উঠেছিল বা বলা ভালো আশ্ৰয় নিয়েছিল শান্তির বাসভূমি এই অসম দেশে, এখানের মাটি ও মানুষের ভালোবাসায় লালিত পালিত হয়ে একদিন এই দেশটাকেই তারা ভেবে নিয়েছিল স্বদেশ বা মাতৃভূমি। সুদীৰ্ঘ জীবন পরিক্ৰমায় এদেশে তারা অনেক কিছুই দেখেছে। দেখেছে জাতি দাঙ্গা, গোষ্ঠী সংঘৰ্ষ, রক্তক্ষয়ী অসম আন্দোলন.... আরো কত কিছু। তবু পড়ে গিয়েও উঠে দাঁড়িয়েছে বারবার। এতো উত্থান পতনের মধ্যদিয়ে এগিয়ে গিয়েও এই দেশটার প্ৰতি একাত্ম বোধের শিকড় যখন প্ৰথিত হয়েছে গভীর থেকে গভীরে, ঠিক এমন একটা সময়ে আবারও তাদের জীবনে যেন নেমে আসতে চলেছে এক ভয়ঙ্কর অমানিশা। নিয়তি বড়ই নিষ্ঠুর।
কিন্তু কেন? কেন এতো যন্ত্ৰণা সইতে হবে বারবার? কেনইবা এতো বিদ্বেষ? এ প্ৰশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে আসুন একটু তথ্যানুসন্ধানে যাওয়া যাক। অসমে বাঙালি মাত্ৰেই যেন দেশভাগের পর এরাজ্যে এসে আশ্ৰয় নেওয়া এক বিরাট সংখ্যক পূৰ্ববঙ্গের ছিন্নমূল মানুষ। এই ধারণাটা খুব কৌশলগত ভাবে সাধারণ অসমবাসীর মনে ঢুকিয়ে দেবার একটা চেষ্টা করে আসছেন একাংশ বিচ্ছেদকামী মানুষ। কিন্তু আসল সতি্যটা যে এটা নয়, তা বৰ্তমান শিক্ষিত ও প্ৰগতিশীল অসমীয়া মহলকে বোঝানোর প্ৰয়োজন নেই। তাঁরা জানেন যে বাঙালির অসম আগমন ও বসবাসের ইতিহাস সুদীৰ্ঘকালের। যে আহোম জনগোষ্ঠীর নাম থেকে এই প্ৰদেশ বা রাজ্যের নামাকরণ হয়েছিল বলে অনেক ইতিহাসবিদেরাই মত পোষণ করেছেন, সেই আহোমদের আগমনের পূৰ্বে অৰ্থাৎ একাদশ দ্বাদশ শতিকাতেও কিন্তু অসমে বাঙালির অস্তিত্বের প্ৰামাণিক তথ্য ইতিহাসে রয়েছে। ত্ৰয়োদশ শতিকার প্ৰথম দিকে মূলতঃ চীন দেশের টাই বা থাই সম্প্ৰদায়ের রাজনৈতিক উচ্চাকাংক্ষা বিশিষ্ট চুকাফা নামের একজন আহোম কেঁাওর (রাজা) প্ৰায় নয় হাজার অনুগামী সহ পাটকাই পৰ্বত পার হয়ে ব্ৰহ্মপুত্ৰ উপত্যকার উজান অঞ্চলে (যাকে এখন আমরা উজনি অসম বলি) রাজ্য স্থাপন করে। নানা ধরণের সন্ধি ও বৈবাহিক সম্পৰ্ক স্থাপনের মধ্যদিয়ে তিনি সম্পূৰ্ণ প্ৰদেশটাকেই নিজেদের অধিনে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। এই টাই রাজারা ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, দক্ষ প্ৰশাসনিক, মেধা সম্পন্ন এবং বিদ্যোৎসাহী। অনাৰ্য মূলের এই আহোম স্বৰ্গদেউরা (রাজা) আৰ্যাবৰ্তের সংস্কৃতি ভালোবেসে মিথিলা কন্বকুব্জ ও মূলত গৌড়বঙ্গ থেকে প্ৰচুর ব্ৰাহ্মণকে সপরিবার এদেশে আনিয়ে সসম্মানে সংস্থাপিত করলেন ধৰ্ম ও শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে। তাদের সাথে পাৰ্ষদ হিসাবে আনা হ'ল বেশ কিছু কায়স্থ সম্প্ৰদায়ের মানুষকেও। এছাড়াও এক বৃহৎ সংখ্যক কামার, কুমার, কাঁসারী, জোলা আদি বৃত্তিগত দক্ষ লোকদের বাংলাদেশ থেকে আনিয়ে তারা অসমের বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করান। কালের গতিতে নিজ অস্তিত্ব ভুলে যাঁরা সম্পূৰ্ণ ভাবে বিলীন হয়ে গেছে অসমের সমাজ সংস্কৃতিতে। এরপর উল্লেখযোগ্য প্ৰব্ৰজন ঘটে ইংরাজ আমলে অৰ্থাৎ এখন থেকে প্ৰায় দুশ বছর আগে। এই প্ৰদেশে নতুন করে প্ৰসারিত তাদের শাসন কাৰ্যে সুবিধার জন্য প্ৰশাসনিক ও করণিক কাজে দক্ষ বাঙালিদের তাঁরা পৰ্যায়ক্ৰমে নিয়ে আসেন। বিভিন্ন সময়ে নানা প্ৰলোভনে চাষবাসের জন্য নিয়ে আসা হয় বঙ্গমূলের প্ৰচুর চাষি। যাদের সংস্থাপিত করা হয় বৰ্তমান মূলতঃ বরপেটা, কামর+প ও গোয়ালপাড়া অঞ্চলের বিস্তীৰ্ণ কৃষিভূমিতে। সেই চাষিদের পরিশ্ৰম ও দক্ষতায় ধীরে ধীরে অনুৰ্বর ও জলাজমি হয়ে উঠলো শষ্য শ্যামলা। কৃষিতে দেশের অন্যতম অনগ্ৰসর রাজ্যটি ঐ সব বহিরাগত বাঙালি (হিন্দু ও মুসলমান) চাষিদের অক্লান্ত পরিশ্ৰমে উনিশ শতিকার মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতিকার মধ্যভাগ পৰ্যন্ত রবিশষ্য উৎপাদনের ক্ষেত্ৰে বিপ্লবের সূচনা করেছিল। ফলত রবিশষ্য উৎপাদনে সৰ্বভারতীয় স্তরে অসম শীৰ্ষস্থান অধিকারে সমৰ্থ হয়। রাজ্যের কৃষি ব্যবস্থাকে আমূল পাল্টে দিয়ে  অৰ্থনৈতিক উন্নয়ন মজবুত করায় বিশেষ ভূমিকা গ্ৰহণকারী এই বাঙালিরা আজ ব্ৰাত্য। শুধু বৃটিশ কেন। তৎকালিন অসমীয়া ভুইঞারাও পূৰ্ববঙ্গীয় চাষিদের অসমে নিয়ে আসার পিছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৮৯৭ সনের মাৰ্চ মাসে আসাম এ্যসোসিয়েশনের সেক্ৰেটারি বাবু গজানন বয়া বৃটিশ সরকারকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে অসমের প্ৰায় ৭০.১৫ণ ভূমি পতিত হয়ে রয়েছে। পূৰ্ববঙ্গ মূলের চাষিদের কিছু বিশেষ সুবিধা প্ৰদান করে এখানে সংস্থাপন দিলে শষ্য উৎপাদনের মধ্য দিয়ে অসমকে আৰ্থিকভাবে মজবুত করা সহজতর হবে। বৃটিশ সরকার তাঁদের প্ৰস্তাব যথাযোগ্য গুত্ব দিয়ে তা কাৰ্যকরী করতে বিহিত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এর বেশ কিছু পর প্ৰতিষ্ঠিত চা-শিল্পে শ্ৰমিক অভাব দেখা দিলে এই বাঙালিদেরকে কাজে লাগিয়ে তারা বিহার ও বঙ্গদেশ থেকে আনিয়ে নেন এক বৃহৎ সংখ্যক কোল, ভীল, সাঁওতাল ও মুণ্ডা সম্প্ৰদায়ের আদিবাসী, যাদের এখন আমরা চা-শ্ৰমিক বা জনজাতি হিসেবে জানি। এদের প্ৰসঙ্গটি এখানে উল্লেখের কারণটি হ'ল যে, এন আর সি' এর নিয়ম এবং সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় এই চা-শ্ৰমিকরা পেয়ে গেলেন ‘ও আই' অৰ্থাৎ আদিবাসিন্দার স্বীকৃতি। আর যারা আহোম আমলে বা প্ৰাক আহোম কাল থেকে অসমে বাস করছেন তাদের ভাগ্যে সেই ‘থোর বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোর'।
‘বাঙালিরা অসমের ভাষা সংস্কৃতি গ্ৰহণ করে না'- এই মিথ্যের আবরণটাকে ভাঙতে গেলে আরো কয়েকটি কথা যে না বললেই নয়। বাঙালি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণ ও পরিস্থিতিতে অসমে এসে বসবাস করে তাদের ভাষা সংস্কৃতি শুধু গ্ৰহণই করেন নি, তারা অসমের সমাজ ব্যবস্থায় এমনভাবে বিলীন হয়ে গেছেন যে তাদের অস্তিত্ব আলাদা করে খুঁজে বের করা আজ যথেষ্ট কষ্টদায়ক। ব্যাপারটা একটু খোলসা করতে গেলে একটু বিস্তারে যেতে হবে, যেতে হবে বেশ কয়েকশ' বছর পিছনে।
একটা সময় আরেকটা মিথ খুব প্ৰচলিত ছিল যে বহিঃরাজ্য থেকে অসমে এলে মানুষ ভেড়া হয়ে যায়। কেউ ফিরে যেতে পারেনা। একে সুযোগ বুঝে বঙ্গীয় মূলের মানুষের অসম বিরোধিতা বলেও আখ্যায়িত করেছেন অনেকেই। আসলে প্ৰাকজ্যোতিষপুর সু-প্ৰচীন কাল থেকেই ছিল জ্যোতিষ চৰ্চার পীঠস্থান। আর জ্যোতিষ চৰ্চার প্ৰতি বাঙালির আগ্ৰহ ও কৌতুহল সৰ্বজন বিদিত। এছাড়া একান্ন পীঠের অন্যতম শক্তিপীঠ কামর+প কামাখ্যার প্ৰতি বাঙালির শ্ৰদ্ধা ও ভক্তিও চিরকালীন। এই দুইয়ের প্ৰতি কৌতুহল, ভক্তি ও আগ্ৰহের বশে বহু কষ্ট স্বীকার করে পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা দুৰ্গম পথ পেরিয়ে বাঙালিরা এসে হাজির হতেন অসমে। আর এটা প্ৰামাণ্য সত্য যে, এদের বেশির ভাগই আর ফিরে যেতে পারেন নি। কেউবা পথদসু্যদের হাতে খুন হয়েছেন। কিছু পথক্লান্ত ও রোগাক্ৰান্ত হয়ে মারা গেছেন। আবার অনেকেই অসমবাসীর আতিথ্য ও মনোরম প্ৰাকৃতিক শোভায় বিমুগ্দ্ধ হয়ে থেকে গেছেন এখানেই। এদেশীয় মেয়েদের বিয়ে করে এদেশের সুন্দর ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভালোবেসে সম্পূৰ্ণ ভাবে বিলীন হয়েþ গিয়েছিলেন অসমের সমাজ ব্যবস্থায়। যুগ, পরিস্থিতি, পরিবেশ সব পাল্টে গেলেও এধরণের ঘটনা ঘটে চলেছে অদ্যাবধি। আমাদের চোখের সামনেই নিম্ন অসমের গোয়ালপাড়া, অভয়াপুরি, বরপেটা, নলবাড়ী এমনকি গুয়াহাটিতেও এমন প্ৰচুর বাঙালি ছিলেন যারা বৰ্তমানে নিজেদের সম্পূৰ্ণ রূপে অসমীয়া বলে প্ৰতিষ্ঠা করেছেন, করছেন। বললে অত্যুক্তি হবে না যে ভট্টাচাৰ্য, চৌধুরী, চক্ৰবৰ্তী, গোস্বামী কিংবা দাস, দত্ত, রায়, মজুমদার আদি উপাধিধারী বহু কট্টর অসমীয়াভাষীদের পূৰ্বপুষ বংগমূলের। এমনকি ভুইঞা, বরভুইঞা এবং বেজবয়াদের মধ্যেও এমন অনেক রয়েছেন যাদের পূৰ্ব নিবাস গৌড়বঙ্গ বা কন্বকুব্জ। অসমীয়া কলা-সংস্কৃতি জগতের প্ৰবাদ পুষ কলাগু বিষ্ণুপ্ৰসাদ রাভার পূৰ্ব পুষের আদি নিবাসও বাংলাদেশের ঢাকা শহরে। উদাহরণের একটা দীৰ্ঘ তালিকা নিশ্চয়ই দেওয়া যেতে পারে, তবে সেটা উদ্দেশ্য নয়। সম্প্ৰীতির সুপ্ৰাচীন ঐতিহ্যকে সামনে রেখে বিদ্বেষের তুষাগ্নিকে চিরতরে নিৰ্বাপিত করে এক শান্তিপূৰ্ণ সমাজ গঠনই এই লেখনির উদ্দেশ্য।

ক্ৰমশঃ

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.