Header Ads

কনওয়ে সিনিক রেলরোডে আমেরিকার উত্তর পূর্বাঞ্চল ভ্ৰমণের অনুভূতি



নিউ জার্সির সমরসেট থেকে আশীষ কুমার দে
১১ অক্টোবর সকাল দশটায় বেড়িয়ে পড়লাম নিউ হ্যাম্পশায়ার এর উদ্দেশ্যে। আবহাওয়া দফতরের খবর মতে এগারোটা থেকে শুরু হবে বৃষ্টি যা চলবে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত। অগ্রিম বুকিং থাকায় দুর্যোগ জেনেও দিন পরিবর্তন করা সম্ভবপর হল না। ৩৩৫ মাইল (আমেরিকায় মাইল প্রচলিত, কিমি প্রায় ৫৪০) অ্যাতোটা পথ পাড়ি দিতে আমাদের লাগবে মাত্র সাড়ে পাঁচ ঘন্টা। পথে মুষল ধারে বৃষ্টি সামনে রাস্তা পনেরো মিটারের বেশি দেখা যাচ্ছে না। গাড়ি বিভিন্ন সতর্কতা মেনে চলছে। রাস্তায় ইলেকট্রনিক বোর্ডের মাধ্যমে জানতে পারলাম সামনে ট্রাফিকের অবস্থা। মাঝখানে কিছুক্ষণের বিরতির পর আমরা দুর্যোগ মাথায় নিয়ে প্রায় দু ঘন্টা বিলম্বে পৌঁছলাম স্কারবরো, এটি নিউ হ্যাম্পশায়ার এর একটি শহর এখানেই হোটেল ম্যারিয়ট ফেয়ারডিলে আমারা দুদিন থাকবো। স্কারবরো, বেছে নেওয়ার কারণ এখান থেকে মেইন রাজ্য ও কনওয়ে দুটো মোটামুটি এক ঘন্টার ড্রাইভ। সাধারণত এখানে এক মিনিটে একমাইল যাওয়া যায়। এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার প্রচুর রাস্তা, GPS দেখে ঠিক করে নেওয়া যায় প্রয়োজনে যানজট এড়িয়ে অন্য রাস্তা ধরা হয়। রাস্তায় কোথায় কত গতিতে গাড়ি চালাতে হবে তাও নির্দেশ দেওয়া আছে, রাস্তায় পুলিশ ও স্যাটেলাইট, এরোপ্লেন থেকে নজরদারি রাখা হয়, অনেক সময় গতি বেশী হলে বা বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালালে অন্য চালক হর্ণ দিয়ে সতর্ক করেন না শুনলে ৯১১ নম্বরে খবর দিয়ে দেন নিজের দায়িত্বে। আপনি হঠাৎ করেই দেখলেন পুলিশের গাড়ি ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ধরে ফেলেছে। এত তৎপরতার পরেও স্পীডিং একটি সমস্যা হাই ওয়েতে যদিও দুর্ঘটনার সংখ্যা গাড়ির অনুপাতে খুবই কম। দিনেও গাড়ির হেডল্যাম্প জ্বালিয়ে গাড়ি চালাতে হয় রাস্তায় হর্ণের ব্যবহার একদম নেই। এখানে পাঠকদের  জানিয়ে রাখি ৯১১ একটি ইমার্জেন্সী নম্বর এই নম্বরে কল করলে পুলিশ, দমকল ও অ্যাম্বুলেন্স সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হয়। এই নম্বরটির প্রচলন হয় ৯/১১ এর পর। সকালে হোটেলে ব্রেকফার্স্ট করে ঠিক ৯টা ৩০ মিনিটে বেড়িয়ে পড়ি নর্থ কনওয়ে স্টেশনের দিকে। এদিন আকাশ মেঘলা ছিল। ঠান্ডা বাতাস বইছিল তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি, একঘন্টা গাড়ি চালিয়ে পৌছে গেলাম নর্থ কনওয়ে স্টেশনে। নর্থ কনওয়ে নিউ হ্যাম্পশায়ারের একটি ছোট্ট ছবির মতন শহর। ( স্থানীয় সূত্রে গ্রাম ) স্টেশনের পরিবেশ ও পরিকাঠামো দেখে মনে হচ্ছিল, টাইম মেশিনে চড়ে পৌঁছে গেছি একশ বছর আগের কোনো ইউরোপের শহরে। স্টেশন বিল্ডিং তৈরি হয়েছিল ১৮৭৪ সালে। ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের অনুকরণে, এটি আমেরিকান ন্যাশনাল হেরিটেজ সাইট, ভেতরে ঢুকে অবাক হয়ে যাই, সেই পুরনো মর্সের টরেটক্কা মেশিন, সিগন্যাল ব্যবস্থার টোকেন বল মেশিন, টিকিট বিক্রির বাক্স সযত্নে রাখা। রাখা আছে বিভিন্ন ধরনের সিগন্যালিং এ ব্যবহৃত বাতি, ইউনিফর্ম, টুপি, বোতাম, হুইসেল সহ গার্ড বক্স । এছাড়াও আছে পুরানো স্টীম ইঞ্জিনের মিনি প্রোটোটইপ, মালগাড়ি ও যাত্রীবাহী কোচ। এই নর্থ কনওয়ে স্টেশন তৈরি হয়েছিল ১৮৭০ সালে মেইন ও বোস্টনের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের জন্য। এটি মেইন সেন্ট্রাল রোড ডিভিশনের সংযোগকারী লাইন যা হোয়াইট মাউন্টেন অঞ্চলের মানুষের কথা ভেবে তৈরি করা হয়েছিল। ১৮৭৬ সালে আলেকজেন্ডার গ্রাহাম বেল নর্থ কনওয়ে স্টেশন থেকে তাঁর সহযোগী ওয়াটসনের সাথে ১৪৩ মাইল দুরে বোস্টন স্টেশনে টেলিগ্রাফ লাইনে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৭২ সালে এই লাইনকে বাণিজ্যিক ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর এই রেল পথকে পর্যটনের জন্য ১৯৭৪ সালে খুলে দেওয়া হয়, ১৯৮৪ সালে এটিকে আবার বন্ধ করে দিতে হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে ফ্যাবিয়ান স্টেশন পর্যন্ত একটি রুট ও অন্যটি বারলেট অবধি খোলা হয় যা বর্তমানেও চলছে। নর্থ কনওয়ে থেকে একটি ট্রেন ফ্যাবিয়ান পর্যন্ত যায় ও একই পথে ফিরে আসতে সময় লাগে ৫:৩০, অন্য ট্রেনটি যায় বারলেট পর্যন্ত সময় লাগে ১:৩০ মিনিট । আমাদের ট্রেন এর নাম Notch Train, আটটি কামরা সহ দুটি ডিজেল চালিত ইঞ্জিন। এই ট্রেনের প্রতিটি কামরার একটি পৃথক নাম রয়েছে। সবকটি ঐতিহ্যবাহী পঞ্চাশ থেকে একশ বছরের পুরনো। সাধারণত এদেশে প্রচন্ড ঠাণ্ডার কারণে সব কামরা বাতানুকূলিত হলেও এই ট্রেনের একটি বিশেষ কামরা খোলা, প্রয়োজনে খড়খড়ি তুলে জানালা বন্ধ করা যায় এর নাম 'সিলভার কাসকেড'। আমাদের কামরায় একটি আপার ডোম আছে এটিকে কিনে আনা হয়েছে কানাডিয়ান রেলে থেকে, এর নাম 'Dorthea Mae, শুধু মাত্র কুড়ি জন যাত্রী এই প্রিমিয়াম ডোমে বসতে পারেন বাকীরা নীচে। একটি প্রথম শ্রেণীর কামরা এটির নাম সি পি রীড একটি ডাইনিং কার আছে এখানে ৪৮ জন বসে যেতে পারেন এবং যাত্রীদের পছন্দের মতো খাওয়ার পরিবেশন হয়। এই Hattie Evans এর ভেতরে ওক কাঠের প্যানেলিং, অপুর্ব তেল রঙের ম্যুরাল ও খাদ্য পরিবেশনের বুথ আছে। ডাইনিং কারে খাওয়ার প্রচলন শুরু হয় ১৯০০ শতকে, আমাদের দেশেও এই ব্যবস্থা চালু হয়েছিল ঐ সময়ে, কয়লা ও জল নেওয়ার জন্য ট্রেন যখন বড় বড় স্টেশনে অনেক্ষণ দাঁড়াত, যাত্রীরা সেই সুযোগে নেমে খেয়ে নিতেন, তাদের নামা ওঠার অসুবিধা কমানোর জন্য ডাইনিং কার চালু হয়েছিল, দীর্ঘদিন ভারতীয় রেলে এই পরিষেবা চালু ছিল যা বর্তমানে বন্ধ। আমেরিকায় সবকটি হেরিটেজ ট্রেনে ডাইনিং কার সাথে থাকে। আমার মনে পরে হাওড়া দিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেসে সত্তর দশকে এই ব্যবস্থা চালু ছিল। আমাদের সবাইকে টিকিট দেখিয়ে লাইন দিয়ে ট্রেনে উঠতে হল। এই পুরো ট্রেনটির নাম ' কনওয়ে সিনিক রেল রোড ' । আমাদের এই ট্রেন যাত্রার উদ্দেশ্য আপালাচিয়ান পর্বত মালার, 'নচ' পাহাড়ের উপরে উঠে অটাম ফল এর সৌন্দর্য উপভোগ করা। আমেরিকার উত্তর পূর্বাঞ্চলে ( নিউ ইংল্যান্ড ) হেমন্ত ঋতুর সময় কিছু গাছের পাতা সবুজ রঙের থেকে হলুদ, কমলা, খয়েরি, লাল হয়ে যায়, এর পরে পাতা ঝরা শুরু হয়। নচ হচ্ছে সাড়ে আট হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত একটি জাতীয় উদ্যান, পথের একপাশে পাহাড় ও অন্য দিকে সাকো নদী। পুরো মাউন্টেন রেঞ্জ এ পড়বে চারটি স্টেশন, খাড়া পাথরের ক্লিফ, দুর্গম ঘাটী, পাহাড়ী ঝর্ণা, ঝোড়া, দুটি রেল ব্রিজ, ফ্র্যাঙ্কেনস্টিন ট্রেস্টলে ও উইলি ব্রুক। যাত্রাপথে অনুভব করতে পারছিলাম ১৪০ বছর আগে কি ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতার দরকার ছিল দুর্গম এই পাহাড়ের উপর দিয়ে লাইন পাতা ও এখনও এটিকে সচল রাখা। আমরা প্রকৃতির রঙের খেলা দেখতে দেখতে উঠে আসি সর্বোচ্চ শিখরে নচ এ। পর্যটকদের জন্য ট্রেনটি দাঁড়িয়ে যায়, এই সুযোগে আমরা মন ভরে সৌন্দর্য উপভোগ করি ও ক্যামেরায় তুলে নিই। পুরো রেল লাইনের পাশে পাশে আছে হাঁটা ও বাইসাইকেল ট্রেইল। এর মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম ক্রফোর্ড নচ স্টেশনে, এখানে একঘন্টার বিরতি, এই স্টেশনটিও হেরিটেজ সাইট, এর পাশে আছে সাকো নদীর উৎপত্তি সাকো লেক। এই সাকো নদী ক্যানোয়িং এর জন্য বিখ্যাত, লোককথা বলে এই নদীতে প্রতি বছর তিনজন সাদা লোকের জলে ডুবে মৃত্যু হয়। "স্কোয়ান্ডো ও তার স্ত্রী এবং শিশু পুত্র সাকো নদীতে ক্যানো করে যাচ্ছিলেন, সেই সময় তিনজন মদ্যপ নাবিকের সামনে পরেন, নাবিকেরা শিশুটিকে জলে ফেলে দিয়ে দেখতে চাইছিলেন আদিবাসী আমেরিকান শিশুদের জন্মগত সাঁতার কাটার ক্ষমতা । শিশুটিকে তার মা উদ্ধার করলেও কয়েকদিন পর সে মারা যায়। স্কোয়ান্ডো অভিশাপ দেন প্রতি বছর তিনজন সাদা আমেরিকান এই নদীতে মারা যাবেন"। ক্রফোর্ড স্টেশনের প্ল্যটফর্ম নীচু হওয়ার জন্য যাত্রীদের নামার জন্যে তৈরি হয়েছে কাঠের রেম্প। ক্রফোর্ড স্টেশনে নেমে অনেকেই স্টেশনের ক্যাফেটেরিয়াতে বা ডাইনিং কারে খেয়ে নিচ্ছেন, খাদ্য তালিকায় আমাদের রুচি সম্মত খাওয়ার থাকবেনা জেনেই আমরা বাইরে থেকে খাবার নিয়ে এসেছিলাম । এক ঘন্টা পর ট্রেন আবার যাত্রা শুরু করল এবার গন্তব্য শেষ স্টেশন ফ্যাবিয়ান, এখানে ইঞ্জিন খুলে পেছনে লাগিয়ে আবার রওয়ানা হল। যাত্রার পুরো পথেই ধারাভাষ্য দিয়ে যাচ্ছেন গাইড যা খুবই উপভোগ্য। এবারেও সহযাত্রীদের মধ্যে বয়স্কদের সংখ্যাই বেশি, এর মধ্যে অনেকেই সুদূর রাজ্য থেকে এসেছেন, একদল প্রৌঢ় এসেছেন প্রতিবেশী দেশ কানাডার ওন্টারিও অনেকেই প্রতিবছরই আসেন। তাদের অনুভূতি প্রতি বছর ফলের রঙ পৃথক। আমার কাছে এই জীবনের পরম প্রাপ্তির তালিকায় আরও একটি নতুন সংযোজন। ছোটবেলায় হাজারিবাগে (ঝারখন্ড) বসন্তের সময় বাবা নিয়ে যেতেন পলাশের রঙ দেখাতে ক্যনারি হিলে, সারা পথে দিদি'রা গাইতে গাইতে যেত ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে !! আমরা দেখলাম হেমন্তে প্রকৃতির ক্যানভাসে শিল্পীর আগুনে রঙের খেলা।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.