সত্যজিত রায়ের ইন্দিরা ঠাকরুন পথের পাঁচালী কে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন

সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী’ সিনেমার পর্দায় যাঁর উপস্থিতি অল্প সময়ের, অথচ যাঁর ছায়া ছড়িয়ে আছে পুরো ছবির গভীরে — তিনি হচ্ছেন ইন্দির ঠাকরুন। আর সেই চরিত্রে যিনি প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন তিনি এই চুনীবালা দেবী।

সত্যজিৎ রায় তখন "পথের পাঁচালী" সিনেমার হরিহর, সর্বজায়া, অপু, দুর্গা সব চরিত্রের অভিনেতা/অভিনেত্রী পেয়ে গেছেন কিন্ত ইন্দির ঠাকরুন চরিত্রের অভিনেত্রীকে খুঁজে পাচ্ছেন না। ঐ রকম একজন বৃদ্ধা অভিনেত্রী না পেলে যে এ  সিনেমা করাই যাবে না! অবশেষে সন্ধান মিলল ঠাকরুনের। পাইকপাড়ায় থাকেন এক বৃদ্ধা। বয়স আশি। নাম তার চুনীবালা দেবী। খুঁজ পেয়েই সত্যজিৎ রায় চলে গেলেন চুনীবালা দেবীর কাছে। তখন তার বাড়িতে এক জায়গায় বসে সত্যজিৎ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি পথের পাঁচালী  উপন্যাস পড়েছেন? বৃদ্ধা চুনীবালা অল্প লেখাপড়া শিখেছিলেন। কিছু বইও পড়েছিলেন। চুনীবালা বললেন, হ্যাঁ পড়েছি বাবা। তখন সত্যজিৎ রায় জিজ্ঞেস করলেন, সিনেমায় ইন্দির ঠাকরুন করতে পারবেন? চুনীবালা ফোকলা দাঁত বের করে হেসে বললেন, "তা তোমরা একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিলে পারবো বই কি বাবা!"

শুটিং এগিয়ে চলল। প্রতিদিন সকালবেলায় ট্যাক্সি করে চুনীবালাকে শুটিং স্পটে নিয়ে যাওয়া হত। সন্ধ্যেবেলায় আবার ট্যাক্সি করে ফিরিয়ে দেওয়া হত বাড়িতে। সত্যজিৎ একদিন চুনীবালাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনি ধর্মমূলক গান গাইতে পারবেন?" চুনীবালা বললেন, "পারবো।" পথের পাঁচালীতে চুনীবালা চাঁদনি রাতে দাওয়ায় বসে হাততালি দিয়ে গাইছেন সেই গান, 'হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো, পার করো আমারে ....."। এই গানটা চুনীবালা সত্যজিৎ রায়কে শুনিয়েছিলেন। সেই খালি গলায় গান শুনে সত্যজিৎ মুগ্ধ! সেই গানই রেকর্ড করা হল। ছবিতে খালি গলায় সেই গানই গাইলেন চুনীবালা। এক অসম্ভব সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করে সেই গান পথের পাঁচালী ছবিকে এক অন্য জগতে পৌঁছে দিলেন চুনীবালা।

পথের পাঁচালী সিনেমা ১৯৫২ সালে এক শরৎকালে কাশ ফুল আর রেলগাড়ির দৃশ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল; শেষ হতে সময় নিয়েছিল তিন বছর। ১৯৫৫ সালে ২৬ অগাস্ট পথের পাঁচালী মুক্তি পেয়েছিল। সেই বছরেই নিউইয়র্কে এ ছবি প্রথম মুক্তি পেয়েছিল। সত্যজিৎ বুঝেছিলেন এ ছবির মুক্তি চুনীবালা দেবী দেখে যেতে পারবেন না। তাই একদিন প্রজেকটার মেশিন নিয়ে সত্যজিৎ রায় এ সিনেমা চুনীবালাকে তাঁর বাড়িতে দেখিয়ে এসেছিলেন। সিনেমা মুক্তির আগে মহান হৃদয় সত্যজিৎ রায়ের উদ্যোগে চুনীবালা পথের পাঁচালী ছবি বাড়িতে বসেই দেখে গেছিলেন। 

ঠিকই ছবি মুক্তির আগেই চুনীবালা চলে গেলেন। এবার আসল চমক এলো! ম্যানিলা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আন্তর্জাতিক সম্মানের পুরস্কারে অভিনেত্রীর নাম ঘোষিত হল। চুনীবালা দেবী হলেন, ভারতীয় অভিনেতা ও অভিনেত্রীর মধ্যে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিতা অভিনেত্রী! এক বিরল সম্মানের অধিকারিনী।

অনেকেই সম্ভবত এ খবর জানেন না। কিন্তু এই পুরস্কার তিনি গ্রহণ করতে ম্যানিলায় যেতে পারেননি কারণ তার আগেই তিনি বিদায় নিয়েছিলেন।

ইন্দির ঠাকরুন "চুনীবালা"-র প্রতি শ্রদ্ধা জানাই👏❤️

#MayDay2025