নেশনহীন ভারত বিজেপি অন্যান্য
নেশনহীন ভারত--বিজেপি, কংগ্রেস ও অন্যান্য।
খগেনচন্দ্র দাস।
সম্প্রতি ভারতবর্ষের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল কংগ্রেসর সর্বাধিনায়ক রাহুল গাঁধীর একটি মন্তব্য সামাজিক মাধ্যমে বেশ ভালভাবে ছড়িয়েছে। তিনি যা বলেছেন তার সারসংক্ষেপ এই যে, 'ভারতীয় জাতি বলে কিছু নেই; ভারত একটি সম্মিলিত গণরাজ্য।' যদিও জাতি ও নেশন সমার্থক নয় তথাপি আমরা এক্ষেত্রে নেশন বলেই ধরছি। নানা কারণেই তার অধিকাংশ বক্তব্যই মানুষ আজকাল আর গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন না। কিন্তু তার এই দুটি ছোট্ট বাক্য আদৌ গুরুত্বহীন নয়। তবে এই অর্ধসত্য কথাগুলি তিনি সচেতনভাবে বলেছেন কি না আমরা জানি না। ভারতীয় নেশন বলে সত্যিই কি কিছু আছে বা অতীতে ছিল? নেশনের কী প্রয়োজন?এসবের উপর কিঞ্চিৎ আলোকপাতের উদ্দেশেই এই আলোচনা। নেশন এই ইংরেজি শব্দটির যথার্থ কোন বাংলা প্রতিশব্দ নেই এমন ধারণা রবীন্দ্রনাথ থেকে আধুনিক কালের অনেক মনীষিই পোষণ করেন, নেশন আর জাতি সমার্থক নয়। তাই আলোচনায় আমরাও নেশন শব্দটিই ব্যবহার করব।
ভারতবর্ষে সত্যিই কোন নেশন কি কখনও ছিল? ভবিষ্যতে একটি শক্তিশালী ভারতীয় নেশন কীকরে গড়ে উঠতে পারে ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাতের প্রয়াস করার আগে নেশন কী,এবিষয়ে বিভিন্ন মনীষীদের ধারণা কী তা জেনে নেওয়া জরুরি।
উনবিংশ শতিকার ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনান নেশন সম্পর্কে যা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সারসংক্ষেপ করেছেন এভাবে---"মানুষ জাতির, ভাষার, ধর্মমতের বা নদীপর্বতের দাস নহে।অনেকগুলি সংযতমনা ও ভাবোত্তপ্তহৃদয় মানুষের মহাসংঘ যে--একটি সচেতন চরিত্র সৃজন করে তাহাই নেশন।" ("নেশন কী; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র-রচনাবলী; সুঃসঃ দ্বিতীয় খণ্ড পৃঃ ৬২১) রেনানের এই চিন্তার আধারেই গড়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেশন সম্পর্কিত ভাবনা। সেই ভাবনার বশবর্তী হয়েই রবীন্দ্রনাথ বলছেন---"নেশন একটি সজীব সত্তা,একটি মানস পদাৰ্থ।"
(তদেব; পৃঃ ৬২১) এই সজীব মানস সত্তা গড়ে ওঠে ইতিহাসকে কেন্দ্র করে। সেই ইতিহাস শুধুমাত্র সাম্রাজ্যবাদী বা আক্রমণকারীদের গৌরব গাঁথা নয়। তবে, কী সেই ইতিহাস যা, নেশন গড়তে সাহায্য করে? এর কিছুটা আভাস আমরা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ উপন্যাসের ব্রহ্মচারী ও মহেন্দ্রের কথোপকথন থেকে পেতে পারি।যেখানে ব্রহ্মচারী স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা জগদ্ধাত্রী প্রতিমা দেখিয়ে মহেন্দ্রকে বলছেন,এটি মায়ের অতীত রূপ তারপর নিরালঙ্কারা কালীমূর্তি দেখিয়ে বললেন, এটি মায়ের বর্তমান রূপ, আর সবশেষে স্বর্ণনির্মিত দশভূজার মূর্তি দেখিয়ে বললেন, এটি মায়ের ভবিষ্যত ছবি। লক্ষণীয় বিষয় এই যে,এখানে মূর্তিকে একটি প্রতীক হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছেন, "অতীতের গৌরবময় স্মৃতি ও সেই স্মৃতির অনুরূপ ভবিষ্যতের আদর্শ--- একত্রে দুঃখ পাওয়া, আনন্দ করা আশা করা। ---- একত্রে দুঃখ পাওয়ার কথা এইজন্য বলা হয়েছে যে, আনন্দের চেয়ে দুঃখের বন্ধন দৃঢ়তর।
অতীতে সকলে মিলিয়া ত্যাগদুঃখ-স্বীকার এবং পুনর্বার সেইজন্য সকলে মিলিয়া প্রস্তুত থাকিবার ভাব হইতে জনসাধারণকে যে একটি একীভূত নিবিড় অভিব্যক্তি দান করে তাহাই নেশন।" (তদেব; পৃঃ ৬২১)
বিংশ শতাব্দীর বিস্ময়কর চিন্তাবিদ, দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার নেশন সম্পর্কে একটি ততোধিক চিত্তাকৰ্ষক সংজ্ঞা প্রস্তুত করেছেন,তিনি বলেছেন---
"-- নেশন গড়বার কাজে দেশ,রাষ্ট্র, ভাষা,ধর্ম প্রভৃতি তত্ত্বগুলো একেবারেই গৌণ। আসল জিনিষটা হচ্ছে ওইগুলির কোন একটি বা একাধিক তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গড়ে ওঠা একধরণের চেতনা বা সেন্টিমেন্ট। নেশন জিনিষটার অস্তিত্ব আসলে নিছক সেন্টিমেন্ট প্রসূত; এর বেশি কোন কিছু নয়।"
(দেশ প্রেমিকদের প্রতি; শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার, পৃঃ ৩)
নেশন যদিও একটি সেন্টিমেন্ট যা কার্যত একটি বিমূৰ্ত ধারণা তথাপি এর কাৰ্যক্ষমতা অপরিসীম। যার উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে। এর কিছু উদাহরণ শ্রীসরকার উদ্ধৃত করেছেন তাঁর পূর্বোক্ত ক্ষীণ কলেবর গ্রন্থটিতে। যেমন আর্যদের আগমনের সময় আর্য অনার্য সংঘাতের ফলে সৃষ্ট বিজয়ী আর্য নেশন ও পরাজিত অনার্য নেশন;মুসলমান আক্রমণের ফলে সৃষ্ট মুসলমান ও অমুসলিম নেশন; বৌদ্ধ ও অবৌদ্ধ নেশন; সর্ববশেষ ইংরেজ শাসনের ফলে শোষিত ভারতীয়দের সৃষ্ট ইংরেজ বিরোধী সেন্টিমেন্ট প্রসূত ভারতীয় নেশন। বস্তুত রেনান থেকে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার,নেশন সম্পর্কে প্রত্যেকের বক্তব্য থেকেই একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, জনগণের মনোজগতে উদ্ভূত আবেগই নেশন এর জন্মভূমি ও বিচরণভূমি। তথাপি নেশনের আবেগ সম্পৃক্ত একটি রাষ্ট্র অর্থাৎ নেশন স্টেট আর নেশনলেস স্টেট অর্থাৎ নেশনহীন রাষ্ট্রের মধ্যে সামগ্রিক দিক থেকে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। নেশন বোধ সম্পৃক্ত একটি রাষ্ট্র অনায়াসে অসাধ্য সাধন করতে পারে,যা একটি সাধারণ রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়।
এই নেশন বোধ,সেন্টিমেন্ট বা আবেগ কখনও কখনও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আপনা আপনি সৃষ্টি হতে পারে আবার রাষ্ট্রনায়কদের ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টাতেও গড়ে উঠে। নিজে নিজে তখনই গড়ে উঠে যখন রাষ্ট্র অনাকাঙ্খিতভাবে কোন বহিঃশত্রুর আক্রমনের শিকার হয় অথবা কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা চিন ও পাকিস্তানের ভারত আক্রমণ ও করোনা মহামারীর কথা উল্লেখ করতে পারি। যে সময়ে দেশের জনগণের মধ্যে নেশন বোধ ভীষণভাবে জাগ্রত হয়েছিল।এই পরিস্থিতি যখন অতিক্ৰম করে আসা হয় তখন সেই সেন্টিমেন্টও স্বাভাবিক কারণেই অপসৃত হয়ে যায়। ক্রিকেট খেলার আবেগের সঙ্গেতো আমরা যথেষ্টই পরিচিত।
রাষ্ট্রনায়কগণ যখন সুপরিকল্পিতভাবে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার কথিত, 'দেশ,রাষ্ট্র, ভাষা,ধর্ম',এর কোন এক বা একাধিক বিষয়কে কেন্দ্র করে সেন্টিমেন্ট সৃষ্টি করে নেশন গড়বার প্রয়াস করেন তখন সেই প্রচেষ্টা সফল হলে একটা রাষ্ট্রকে নেশন স্টেট হিসেবে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
এই নেশন সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দও একই ধারণা পোষণ করতেন---" Race, Religion, Language, Government---all these together make a nation. ( Lectures From Colombo to Almora; Swami Vivekananda; page 214) তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে এ-ও বলেছেন যে, 'হিন্দু সেন্টিমেন্টকে আশ্রয় করেই ভারতীয় নেশন গড়ে উঠবে এবং এর ব্যত্যয় ঘটাবার চেষ্টা গঙ্গাকে মোহনা থেকে উৎসে নিয়ে যাওয়ার মতো বিষয়।' বস্তুত বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নরেন্দ্রনাথ, অরবিন্দ প্রত্যেকেই ভারতীয় নেশন গড়ার জন্য বেদ ও উপনিষদীয় ধর্মকেই কেন্দ্রবিন্দু বা ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সামগ্রিকভাবে এঁদের রচনাবলীই বাঙালি জাতির প্রাণ স্বরূপ।
ভারতবর্ষের এমনই দুর্ভাগ্য যে,১৯৬২ সালে চিনের ভারত আক্রমণের সময় এদেশের বামপন্থীদের একাংশ ঘরশত্রু বিভীষণের মতো ভারতকেই আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করে ভারতীয় গণমানসে চিন বিরোধী সেন্টিমেন্টের ভিত্তিতে জেগে ওঠা নেশনবোধকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে দ্বিধাবোধ করে নি। একই পরিস্থিতি হয়েছে একাধিকবার পাকিস্তানের মতো বহিঃশত্রুর আক্রমণের ক্ষেত্ৰেও। এই শ্রেণির বিভীষণরা কোনদিনই চায় নি যে ভারত নেশন কেন্দ্রিক একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হোক। স্টালিনের মতো তামিল নেতারা আরও ন্যক্কারজনক ভাষায় বলছে--- বেদ ও উপনিষদাশ্রিত হিন্দুধর্ম নাকি ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতো।রাহুল গাঁধীও সম্ভবত নিজের অজান্তেই সেই তালিকায় নাম লেখালেন। স্বাধীনোত্তর কাল থেকে দীর্ঘকাল তাঁর দল শাসনক্ষমতায় থাকলেও দলটি ভারতীয় নেশন গড়ার চেষ্টা কোনদিনই করে নি। বরঞ্চ জওহরলাল নেহরুর মতো পণ্ডিত সম্পর্কে ড০ নারায়ণ ভাস্কর খরে ( ১৮৮৪-১৯৭০)সহ আরও অনেকেই যে মন্তব্য করেছেন তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক, " By education I'm an Englishman,by views an internationalist, by culture a Muslim and Hindu only by accident of birth." শিক্ষায় আমি একজন ইংরেজ, মতবাদের দিক থেকে একজন আন্তর্জাতিকতাবাদী,
সংস্কৃতিগতভাবে মুসলিম আর দুর্ঘটনাক্রমে জন্মগতভাবে হিন্দু। ভারত রাষ্ট্রের একজন রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে এরচেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে? রাহুল গাঁধীও প্রমাণ করছেন যে তিনি তাঁরই উত্তরসূরী!
"একধর্মরাজ্যপাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত
বেঁধে দিব আমি"
(শিবাজী উৎসব; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,পৃঃ ৫ রবীন্দ্র-রচনাবলী, সুঃসং ষোড়শ খণ্ড,পৃ ৫) কবিগুরু,এবং দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের আহ্বানকে সার্থক করে ভারতীয় নেশন গড়বার কাজে শিবাজী বা অন্য কেউ যদি ব্রতী হয় তাতে দোষণীয় কিছু আছে কি? সুতরাং যখনই ধর্ম ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় নেশন গড়ার কোন চেষ্টা হয় তখনই এদেশের দীর্ঘতম সময় শাসনে থাকা রাজনৈতিক দল ও তথাকথিত বামপন্থীরা গেল গেল রব তুলেন,তখন তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না। তারা চায় নেশনহীন দুর্বল ভারত; যাতে ভারতকে আরও টুকরো টুকরো করে নিজের নিজের প্লেটে পরিবেশন করা যায়।
অবশ্য এক্ষেত্রে বঙ্গ বা আজকের পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই স্বতন্ত্র তাই একশ পঁচিশ বছরেরও আগে রবীন্দ্রনাথ যে বলেছিলেন---
"সেদিন এ বঙ্গদেশ উচ্চকিত জাগেনি স্বপনে,
পায়নি সংবাদ---
বাহিরে আসে নি ছুটে ,উঠে নাই তাহার প্রাঙ্গণে
শুভ শঙ্খনাদ--।"
(তদেব পৃঃ ৫) পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্ৰে একথা আজও সমানভাবে প্রযোজ্য। বাঙালি তার মনীষীগণের আহ্বানকে অবজ্ঞা করে কোন অজ্ঞাত কারণে বাকি ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিজাতীয় তত্ত্বকে ভর করে বেঁচে থাকার আত্মঘাতী খেলায় মেতে রয়েছে তা বোধগম্য নয়। একসময়ে এই বালখিল্য আচরণ এতটাই মাত্রা ছাড়িয়েছিল যে,"চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান", এমন শ্লোগানও পশ্চিমবঙ্গেই উঠেছিল।
রাজনৈতিক দল হিসেবে ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো ভারতীয় জনতা পার্টি নেশন গড়বার একটি সচেতন প্রয়াস শুরু করেছে। কুম্ভস্নান উপলক্ষে আয়োজিত মেলাকে পাপ- পুণ্য,বা বিরোধীদের চোখে ধরা পরা তথাকথিত অব্যবস্থা,গঙ্গার দূষিত জল,স্নান কাউকে ভাতের জোগাড় করে দেবে কি না ইত্যাদি অসংখ্য ত্রুটির কথা উপেক্ষা করে সচেতন মহল এই মহা আয়োজনকে ভারতীয় নেশন গড়বার প্রয়াসের অঙ্গ হিসেবেই দেখছেন।
ভারতীয় নেশন গড়ার প্রক্রিয়ায় এদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের বৃহদংশের কাছ থেকে সক্রিয় সহযোগ আশা করা বৃথা। কারণ তাদের কাছে দেশ নয় সর্বাগ্রে ইসলাম এবং যা কিছু ইসলাম সম্মত নয় সে সবকিছুই তাদের জন্য অচ্ছুত,অগ্রহনীয়। তাই রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন, "পৃথিবীতে দুটি ধর্মসম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র---সে হচ্ছে খৃষ্টান আর মুসলমান ধর্ম। তারা নিজের ধর্মকে পালন করেই সন্তুষ্ট নয়,অন্য ধর্মকে সংহার করতে উদ্যত। এইজন্যে তাদের ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলবার অন্য কোন উপায় নেই।" ( রবীন্দ্র-রচনাবলী: সুঃসং দ্বাদশ খণ্ড; পৃঃ ৬২০) বিষয়টি আরও অধিক প্রাঞ্জল ভাবে ব্যক্ত করেছেন শ্রীঅরবিন্দ-র মানসপুত্র নলিনীকান্ত গুপ্ত, তিনি বলেছেন---" ভারতের মুসলমানদের প্রাণ ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে আশ্রয় খুঁজিয়াছে ভারতের বাহিরে। দেশের ভিতরে নয়, দেশের বাহিরে হইতেছে তাহার নাড়ীর টান--ইহাই হইল ভারতের মুসলমানদের বিশেষত্ব।" (রচনাবলী:
নলিনীকান্ত গুপ্ত; ষষ্ঠ খণ্ড পৃঃ ১০৮) বিষয়গুলি ধর্মীয় বিরোধের দিক থেকে নয় বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার্য।
রাজনৈতিক দল হিসেবে ভারতীয় জনতা পার্টির ব্যর্থতার দিকটিও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দেশি তথা আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রদত্ত পরিসংখ্যান যেমন ভারতীয় অর্থনীতির ঔজ্জ্বল্যের দিকটি তুলে ধরেছে তেমনই একথাও অনস্বীকাৰ্য যে, অর্থনীতির এই প্রাগ্রসরতার সুফল প্রান্তিক মানুষের কাছে আনুপাতিক হারে পৌঁছচ্ছে না। সহজ কথায় ধনী ও দরিদ্রের মধ্যেকার ব্যবধান কমা দূরের কথা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সব মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা সমান হবে এমন অবাস্তব মার্ক্সীয় ভাববাদী কথা আমরা বলছি না। তবে হ্যাভ ও হ্যাভনটদের মধ্যেকার ব্যবধান কমানো সম্ভব না হলে এই চরম পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার কুফল মানুষকে একসময় ক্ষিপ্ত করে তুলবেই। প্রধানমন্ত্রীর দফতর ছাড়াও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদের সংখ্যা ভারতবর্ষে অনেক রয়েছ। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ধনী ও দরিদ্র মানুষের মধ্যেকার আর্থিক ব্যবধান কমিয়ে আনতেই হবে। তথাকথিত সাম্যবাদ ও সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদের বাইরে গিয়ে একটি যুক্তিসঙ্গত (rationalize) অর্থব্যবস্থা গড়ে নিতে পারলে ভারত সত্যিকার অর্থেই একটি শক্তিশালী নেশন হিসেবে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। আর তখনই ভারতবর্ষের পক্ষে বিশ্বের কাছে বিশ্বগুরুর মর্যাদা পাওয়া সম্ভব।
নেশনের মূল তত্ব যেহেতু আবেগ বা সেন্টিমেন্ট তাই নেশনবোধও পরিস্থিতির সঙ্গে পরিবর্তনশীল। শ্রীসরকার উল্লেখ করেছেন যে,দুর্নীতিকে ভিত্তি করেও দুটি নেশন সৃষ্টি হতে পারে। একদিকে সমাজের দুর্নীতিপরায়ণ জনগোষ্ঠী ও অন্যদিকে নীতিপরায়ণ মানুষজনের নেশন। বিষয়টি সম্পূৰ্ণ নির্ভর করে নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণের সদিচ্ছার ওপর। মোট কথা বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি একটি শক্তিশালী ভারতীয় নেশন গড়ে তোলার পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল।
কোন মন্তব্য নেই