বাঙালি দের একেক স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বীকৃতি আজও আসেনি
(সুনীল রায়)
নগাঁও, ২১ জানুয়ারি :: ভারতে নবজাগরণ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম এসেছিলো বাঙালির অগ্নিযুগের সংগ্রামী হাত ধরে। আন্দামানের সেলুলার জেলে ৫৮৫ জন বন্দীর মধ্যে ৩৯৮ জন স্বাধীনতা সংগ্রামীই হচ্ছেন বাঙালি। পাঞ্জাবি মাত্র ৭৫ জন ছিলেন। ভারতের প্রতিটি জেলার স্থানীয় জেলা গুলিতেও স্বাধীনতা সংগ্রামীরা বন্দী হওয়ার কথা অস্বীকার করা যায় না। তবে এটা বলা যেতেই পারে, দেশের স্বাধীনতা অর্জনে বাঙালিরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। মাত্র আঠারো বছর বয়সে শহিদ ক্ষুদিরাম বসু ফাঁসিতে নির্দ্ধিধায় ঝুলে ছিলেন। মাষ্টার দা সূর্যসেন বৃটিশের চূড়ান্ত অত্যাচার সহ্য করেও মাথা নত করেন নি। সাঁড়াশি দিয়ে তাঁর দাঁত ও নখ উফরে ফেলে দিয়েছিলো অত্যাচারী বৃটিশ সরকার। কিন্তু আজ সব বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। বাঙালির এই অবদানের কথা স্বীকার করতে লজ্জাবতী গাছের মতো অনেকেই চুপসে যান।
অনুরূপ ভাবে, আজ অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ নিয়ে গগণভেদী সোরগোল পড়তে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রেক্ষিতে গোটা ভারতবর্ষের মধ্যে শুধু অসমেই একপক্ষীয় সংঘর্ষ হয়েছিলো। ভারতের অন্য কোথাও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয় নি তখন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সারা অসম সংখ্যালঘু ছাত্র সংস্থা (আমসু) সামাদ গোষ্ঠী সে বছর সাত ডিসেম্বর অসম বন্ধ ডেকেছিলো। জানামতে, সেদিন বরদোয়া থানের চারপাশে অসংখ্য মুসলিম জনগোষ্ঠী মানুষের জমায়েত হওয়ার কথা জানতে পেরে তদানীন্তন জেলাশাসক জ্যোতিপ্রসাদ শইকীয়া ও পুলিশ সুপার এ পি রাউত সকাল আটটায় তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। অবশ্য বিক্ষিপ্ত কয়েকটি ঘটনা ছাড়া তেমন কিছু হয় নি সেখানে। তবে বরদোয়া থেকে ভেতরের রাস্তা দিয়ে রূপহী যাওয়ার পথে কয়েকজন সন্দেহ জনক ব্যাক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো বলে জানা গেছে।
নগাঁও শহরে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে শতাধিক ধর্মান্ধ ব্যাক্তি শহরের ষ্টেডিয়াম মার্কেট, মিশন মার্কেট, নতুন বাজারের বেছে বেছে দোকান পাট ভাঙচুর করে। অবশ্য কৃষ্ণাহল চারালি এসে ধর্মযোদ্ধারা স্থানীয় মানুষের দ্বারা প্রতিঘাত পেয়েছে বলে জানা গেছে। শোনামতে, নতুন বাজারস্থিত "চূড়ামনি" নামে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারির মৃত্যুও হয়েছিলো। কংগ্রেসের প্রভাবশালী এক প্রাক্তনমন্ত্রী তদানীন্তন এন,এস,ইউ,আই-র হোমড়া চোমড়া কর্মকর্তা এই তাণ্ডবলীলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে নগাঁও শহরের মানুষ আজও বিশ্বাস করেন। অসমের একতরফা এই সংঘর্ষে সরকারি মতে ৬৬ জন হিন্দু বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিলো। বেসরকারি মতে একশো-র বেশি। নগাঁও জেলা ও ধুবড়ি জেলায় উগ্র সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হয়েছিলো। সে বছর আট ডিসেম্বর নগাঁও জেলার তদানীন্তন হোজাই মহকুমার যমুনামুখ বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ডবকা ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম ক্রমে কুর্কুবস্তী, নমাটিগাঁও, নাহরগাঁও, মিকির আটি হাওগাঁও এবং হোজাই বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত পশ্চিম যোগিজান অঞ্চলে শতাব্দীর সবচেয়ে কুখ্যাত ও নিঃষ্ঠুর সংঘর্ষ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সেদিন বেলা দশটায় জেলাশাসক জেপি শইকীয়া ও পুলিশ সুপার এপি রাউত হোজাই যাওয়ার পথে ডবকা শহরে হাজার হাজার মুসলিম মানুষ হিন্দু বাঙালির বাড়ীঘরে সংঘবদ্ধ ভাবে করা আক্রমণ প্রত্যক্ষ করেন। এমনকি, জেলাশাসক স্বয়ং পুলিশের হাত থেকে লাঠি নিয়ে উন্মাদদের পিছু ধাওয়া করেছেন বলে জানা গেছে। জেলাশাসক ডবকা পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে স্থানীয় বিধায়ক কে সেখানে বহাল তবিয়তে বসে থাকতে প্রত্যক্ষ করেন। পুলিশ যাতে ঘটনাস্থলে যেতে না পারে, তার জন্যই ওই বিধায়ক সেখানে ব্যস্ত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিলো। ওদিকে, সংঘর্ষে আহত ব্যাক্তিরা ডবকা প্রাথমিক চিকিৎসালয়ে ভির করলেও ডাক্তারের দেখা মেলে নি। জেলাশাসক তাঁর বাড়ি থেকে ডাক্তারকে ডেকে এনে আহতদের উপযুক্ত চিকিৎসা করার নির্দেশ দিয়ে হোজাই শহরে চলে যান। যদিও ওই ডাক্তার দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে আহতদের চিকিৎসা না করেই শুয়ে পড়েন বলে অভিযোগ উঠেছিলো। সময়ের বিবর্তনে তিনি কংগ্রেসের প্রভাবশালী মন্ত্রীও হন পরবর্তী সময়ে।
ওদিকে, সে বছর ৯ ডিসেম্বর রূপহীহাট বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত পূব সাইদরিয়া, পশ্চিম গড়াজান ও আমরাকান্দা গ্রাম গুলিতে হিন্দু বাঙালির বসতভিটা একের পর এক জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তাঁদের অপরাধ হচ্ছে, প্রায় সত্তর শতাংশ হিন্দু বাঙালি তখন বিজেপি দলকে সমর্থন করতেন। ১৯৯১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বরাক উপত্যকায় নয় জন ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার ধুবড়ি বিধান সভা কেন্দ্রে বিজিপি প্রার্থি নির্বাচিত হন।
সারা অসম বাঙালি যুবছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চিত্তরঞ্জন পালের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল ১৯৯৩ সালের ২৭শে জানুয়ারি নয়াদিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এস বি চ্যবনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই সংঘর্ষে মন্ত্রী বিধায়কেরা জড়িত থাকার তথ্য প্রমাণ সহ হত্যাকাণ্ডের সংগৃহীত বীভৎস ফোটো দেখিয়েছেন। নয়াদিল্লির আই এন এস বিল্ডিঙে থাকা সাংবাদিক শুভেন্দু রায়চৌধুরী, জয়ন্ত ঘোষাল, কল্যাণ বরুয়া সহ বিভিন্ন বাংলা ও ইংরেজি সংবাদ পত্রের সাংবাদিকদের ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের দরুণ ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো তখন। সমগ্র নগাঁও জেলার সংঘর্ষ পীড়িত এলাকা গুলি চিত্তরঞ্জন পাল প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। বস্তুত তাঁর চাপেই নয়াদিল্লির নির্দেশে পাঠক কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয়েছিলেন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত হিতেশ্বর শইকীয়া। এমন কী, রাজ্য সরকারের ঘোষিত পুনর্বাসনের এক লক্ষ টাকাও দিতে বাধ্য হয়েছিলো রাজ্য সরকার।
অসম ভাষিক সংখ্যালঘু উন্নয়ন বোর্ড গঠনের দাবি নিয়ে ১৯৯৫ সালের ২৮ অক্টোবর সিআরপিসি-র স্মারকলিপি নিয়ে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সন্তোষ মোহন দেবের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক চিত্তরঞ্জন পাল সাক্ষাৎ করেন। এক মাস পর নয়াদিল্লি তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত হিতেশ্বর শইকীয়াকে ভাষিক সংখ্যালঘু উন্নয়ন বোর্ড গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলো। সে অনুযায়ী সিআরপিসি-র পনেরো জন সদস্য প্রয়াত শইকীয়ার আমন্ত্রণে ১৯৯৫ সালের ১৫ই নভেম্বর জনতা ভবনে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। সরকারি পর্যায়ে দ্বিতীয় বৈঠক হয় ১৫ ডিসেম্বর এবং তৃতীয় বৈঠক হয় ১৮ই ডিসেম্বর। এই তৃতীয় দিনের বৈঠক শেষে চিত্তরঞ্জন পাল তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীকে ৯২ দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ সাহায্যের বিষয়টি উত্থাপন করেন। রাজ্য সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগের সংশ্লিষ্ট ফাইল নম্বর দেওয়ার পর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শইকীয়া অর্থ আবন্টনের ফাইলে অনুমোদন জানান। ওদিকে, ১৯৯৬ সালের ৮ই মার্চ ভাষিক সংখ্যালঘু উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হয়।
আজ অযোধ্যায় পবিত্র রামমন্দির উদ্বোধনের শুভ সন্ধিক্ষণে বাঙালির রক্ত দেওয়া বাস্তব গল্প গুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বাঙালির ঘাড়ে উঠেই অসমে বিজেপি শাসন ক্ষমতায় এসেছে। যদিও বাঙালিরা আজ ব্রাত্য! বিস্মৃতির কালো অধ্যায়ে যেতে বসেছে। কারণ, ডম্বরুধর পাঠক তাঁর তদন্তের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। যদিও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত হিতেশ্বর শইকীয়া তার প্রকাশ করেন নি। বাঙালি জনগোষ্ঠীর মানুষেরা সম্ভবতঃ আজও বিশ্বাস করেন যে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মা ওই অপ্রকাশিত পাঠক কমিশনের রিপোর্ট জনসমক্ষে আনবেন।
কোন মন্তব্য নেই