Header Ads

মূল্য বোধের পাঠ নিতে বেলুড় মঠের দ্বারস্থ চীনা কমিউ নিস্ট পার্টির নেতারা

মূল্যবোধের পাঠ নিতে বেলুড় মঠের দ্বারস্থ চিন 

চিনের কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে কলকাতায় চিনের কনসাল জেনেরাল ঝা লিউ সম্প্রতি গিয়েছিলেন বেলুড় মঠে। প্রযুক্তিগত উন্নতি ও বস্তুতান্ত্রিক সাফল্য সত্ত্বেও চিনের সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় এখন বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। চিন উপলব্ধি করেছে, সামাজিক অবক্ষয় কাটাতে হলে ছাত্র ও যুব সমাজকে মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে।  বেজিং চায় চিনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির জন্যে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সঙ্গে এই উদ্দেশ্যে যৌথ কর্মসূচি গড়ে তুলতে। সরিষা রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের শতবার্ষিকী উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানের  উদ্বোধনী অধিবেশনে শুক্রবার সভাপতির ভাষণে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সাধারণ সম্পাদক স্বামী সুবীরানন্দজি মহারাজ এই কথা জানান। প্রচলিত ধারনা ভেঙে দিয়ে তিনি বলেন, চিনা কনসাল জেনেরাল নিজেই জানিয়েছেন, কার্ল মার্ক্স নয়, সমাজতন্ত্রের পাঠ চিন গ্রহণ করেছে স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ অনুসরণ করে। সুবীরানন্দজি বলেন, খুবই আশার কথা যে বিবেকানন্দ তরঙ্গ অবশেষে চিনকেও স্পর্শ করেছে।  

অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে এদিনের অধিবেশনের বিষয় ছিল, "সবার জন্যে শিক্ষার প্রসারে রামকৃষ্ণ মিশনের ভূমিকা"। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কানপুর রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী আত্মশ্রদ্ধানন্দ।  তিনি বলেন, অন্যের কল্যাণের জন্যে, সমাজের কল্যাণের জন্যে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে বলেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। স্বার্থপরতা বিবেকানন্দের দৃষ্টিতে ছিল বিশ্বাসঘাতকতার সমতুল। তাই রামকৃষ্ণ মিশনের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি মূল্যবোধ এবং ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার প্রতি যত্ন নেওয়া হয়। আধুনিক সমাজে ক্ষুদ্রতা এবং স্বার্থপরতা যখন গভীর সমস্যার সৃষ্টি করছে তখন রামকৃষ্ণ মিশনের শিক্ষার আদর্শ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।  

অনুষ্ঠানের অপর বক্তা মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমের প্রেসিডেন্ট স্বামী শুদ্ধিদানন্দজি মহারাজ  বিগত ১২৫ বছরে রামকৃষ্ণ মিশনের অবদানের কথা তুলে ধরেন।  তিনি বলেন, গবেষণামূলক ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক জ্ঞানের শিক্ষাও দিয়ে চলেছে রামকৃষ্ণ মিশন।  ভারতীয় ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে ভারতে প্রচলিত ছিল গুরুকুল। মৌলিক শিক্ষা সম্পন্ন করার পরে যোগ্য শিক্ষার্থীদের স্থান হত বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্বের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ভারতেই। তক্ষশীলা, বিক্রমশীলা বা নালন্দার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে সমগ্র বিশ্ব থেকে শিক্ষার্থীরা আসত বিদ্যার্জনের জন্যে। একদিকে আফগানিস্তান অন্যদিকে মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা এবং নেপাল সহ সাবেক ভারতবর্ষই ছিল সারা বিশ্বের 'এডুকেশন হাব' বা আন্তর্জাতিক শিক্ষাকেন্দ্র। তখন শিক্ষা ছিল মূলত মন্দির-কেন্দ্রিক। ভারতের সেই শিক্ষার সমৃদ্ধ কাঠামো ভাঙতে শুরু করে ইসলামিক আক্রমণ এবং পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পরিপ্রেক্ষিতে। স্বাধীনতার সময় দেশের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১২ শতাংশ। শুদ্ধিদানন্দজি বলেন, বিদ্যাভূমি থেকে অবিদ্যাভূমিতে ভারতের এই অবনমনের সমস্যা উপলব্ধি করে স্বামী বিবেকানন্দ ভারতে আবার গুরুকুল প্রথা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন।  "ভারতের ভবিষ্যৎ" শীর্ষক মাদ্রাজ ভাষণে বিবেকানন্দ আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুস্পষ্ট রূপরেখা তুলে ধরেন। একই সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেও তিনি বলেছিলেন, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী সঙ্ঘের উদ্দেশ্যই হবে -- অন্নদানম, প্রাণদানম এবং বিদ্যাদানম। বিবেকানন্দের সেই আদর্শ অনুযায়ী রামকৃষ্ণ মিশন নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ত্রাণ, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং শিক্ষালয় স্থাপনের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নয়নের যে চেষ্টা করে চলেছে সে কথাও তিনি তুলে ধরেন। বিবেকানন্দের আদর্শ ও লক্ষ্য অনুযায়ী মুর্শিদাবাদের সারগাছিতে প্রথম রামকৃষ্ণ মিশনের সেবাব্রতের সূচনা থেকে শুরু করে একে একে মাদ্রাজ স্টুডেন্টস হোম, কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত ও হরিজন বালকদের জন্যে ত্রিচূর আশ্রম স্টুডেন্টস হোম, আদিবাসী শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্যে মেঘালয়ের শিলং, অরুণাচলের অ্যালং, ত্রিপুরার আগরতলা কিংবা সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্যে মহীশূর ও কোয়েম্বাটুরে শিক্ষালয় গড়ে তোলার পিছনে যে একমাত্র সম্বল ছিল সন্ন্যাসীদের প্রবল উদ্যম এবং জাতীয় সত্ত্বা প্রতিষ্ঠার তাগিদ সে কথাও তাঁর ভাষণ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন শুদ্ধিদানন্দজি মহারাজ।    

কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক রত্নেশ্বর ভট্টাচার্য তাঁর ভাষণে বলেন, ১৮৯৭ সালে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার সময় স্বামী বিবেকানন্দ সঙ্ঘের প্রথম এবং প্রধানতম উদ্দেশ্য হিসেবে সকলের জন্যে শিক্ষা এবং আধ্যাত্মিক চেতনা প্রসারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি বলেন, সর্বশিক্ষা অভিযানের যে নীতি ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক স্তরে গৃহীত হয়েছে এবং ভারত সহ বিভিন্ন দেশে তা কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার মূল ভাব উচ্চারিত হয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণের বাণীতে -- "যাবৎ বাঁচি, তাবৎ শিখি।" জীবনভর সর্বজনীন শিক্ষার এই আধুনিক বার্তা বহু যুগ আগেই প্রকাশিত হয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশনের অন্তরে। 

শতবর্ষে উপনীত সরিষা রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের অধ্যক্ষ স্বামী প্রাণানন্দজি মহারাজ এই আশ্রম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাধারণ এক ব্রহ্মচারী সৎচৈতন্য যিনি পরবর্তীকালে সন্ন্যাসী হিসেবে স্বামী গণেশানন্দ হিসেবে পরিচিতি পান তাঁর অসামান্য উদ্যোগের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। স্বামী গণেশানন্দ ছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম প্রেসিডেন্ট স্বামী ব্রহ্মানন্দের শিষ্য। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। সেই সময় সরিষা ছিল এক ছোট্ট গ্রাম।  সেখানে রামকৃষ্ণ আন্দোলন প্রাথমিক ভাবে শুরু হলেও পরে তার রেশ মিলিয়ে যায়। গণেশানন্দ মহারাজ স্বামী ব্রহ্মানন্দের অনুমতি নিয়ে সরিষায় আশ্রম স্থাপনের সূচনা করেছিলেন ১৯২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর সামান্য এক পরিত্যক্ত কামারশালার একটি ঘর সম্বল করে। নিবেদিতা প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় ছাড়া সরিষাতেই প্রথম গড়ে উঠেছিল নারীশিক্ষার কেন্দ্র। নারী স্বাধীনতা এবং নারী প্রতিভার বিকাশে গণেশানন্দের বিরাট অবদানের কথা সাহিত্যিক লীলা মজুমদারের স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়। গণেশানন্দের পরে পূর্বাশ্রমে দুই স্বদেশী বিপ্লবী স্বামী নিৰ্মোহানন্দজি এবং স্বামী যজ্ঞানন্দজিকে আধুনিক সরিষা আশ্রমের আদি রূপকার হিসেবেও বর্ণনা করেন প্রাণানন্দজি। 

উৎসবের অঙ্গ হিসেবেই আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম পার্ষদ স্বামী অদ্ভুতানন্দ বা লাটু মহারাজের জন্মতিথিতে সরিষা আশ্রমের শতবর্ষ ভবনটির দ্বারোদ্ঘাটন করবেন মঠ ও মিশনের অন্যতম সহাধ্যক্ষ স্বামী গিরিশানন্দজি মহারাজ। বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান এমপাওয়ারমেন্ট ওই ভবন থেকেই তার কার্যধারা প্রসারিত করবে।(মানস চৌধরী র সৌজন্যে)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.