Header Ads

বিদেশিনির ভারত জয়

#Prabir_Bose -এর টাইমলাইন থেকে নেওয়া,,,

সন ১৯২৯, জেনেভা সুইজারল্যান্ড। আল্পস পর্বতমালার কোলে ছবির মতো শহর আর সেখানেই এক আবাসিক স্কুলে পড়তো মেয়েটি। নামটা একটু খটোমটো, তাই আর বাংলায় লিখলাম না....Eve Yvonne Maday de Maros. বাবা হাঙ্গেরির বাসিন্দা, মা রাশিয়ান। উচ্ছল মেয়েটা প্রকৃতি ভালোবাসতো আর শখ ছিলো ছবি আঁকার। সময় পেলেই ইজেল কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়তো শহরের সীমানা ছাড়িয়ে.....!

বিক্রম রামজী খানোলকর, নাম শোনেননি আশা করি। ধনী ও সম্ভ্রান্ত মারাঠি পরিবারের সন্তান, ঘোড়সওয়ারি ও পোলো খেলায় ছিলেন ওস্তাদ। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে বিলেত গিয়ে ভর্তি হলেন Royal Military Academy তে। খ্রীষ্টমাসের ছুটিতে বেড়াতে গেলেন সুইজারল্যান্ড আর সেখানেই একদিন দেখা পেলেন নির্জন উপত্যকার কোলে আপনমনে ছবি আঁকছে এক স্বর্ণকেশী।

ছুটি শেষে বিক্রম ফিরে গেলো ইংল্যান্ড কিন্তু আলোড়ন তুলে গেলো ঐ ষোড়শীর হৃদয়ে। মেয়েটির বাবা শুনেই মহা খাপ্পা, তার আদরের দুলালী কিনা বিয়ে করবে কয়েক হাজার মাইল দুরের এক কালা আদমীকে ! কভি নেহি। মেয়েটি কিন্তু ভুলতে পারলো না তার কিশোরী হৃদয়ের প্রথম প্রেমকে, আঠারো বছর বয়স হতেই চলে এলো লখনোউ। বিয়ে করলো তার স্বপ্নের রাজকুমার কে। সময়টা ১৯৩২। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি থেকে নতুন নাম রাখা হলো সাবিত্রী, সাবিত্রী বাঈ খানোলকর।

পতিদেবতাটি ততদিনে সেনাবাহিনীর কমিশন্ড অফিসার, তার বদলির সাথে সাথে সাবিত্রী ও ঘুরতে লাগলো ভারতের নানান শহরে। নতুন করে প্রেমে পড়লো এদেশের বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিক পশ্চাদপট এবং বিশেষ করে সংস্কৃত ভাষার। পাশ্চাত্য পরিবেশে বড় হওয়া মেয়েটি এদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে এমনভাবে গ্রহণ করলো, অচিরেই সে হয়ে উঠলো পরিবারের আদরের 'বহু'! ছেড়ে দিলেন মাছ মাংস খাওয়া। পড়তে লাগলেন সংস্কৃত পুঁথি, মারাঠি, হিন্দিতে কথা বলাও শিখে গেলেন। ধীরে ধীরে ধ্রুপদী সঙ্গীত ও শিল্পকলায় হয়ে উঠলেন পারঙ্গম। কেউ মেমসাহেব বললে রেগে যেতেন, বলতেন "আমার আত্মা বিশুদ্ধ ভারতীয়, ভুল করে ইউরোপে জন্মেছি !" বেদ পুরানের কাহিনী যেকোন সাধারণ ভারতীয়র থেকে বেশি জেনে নিলেন।

এলো ১৯৪৭, স্বাধীন হলো দেশ। সেনাবাহিনীতে তার এই ভারত প্রেমের কথা তখন এক রূপকথার মতো। কথাটা গেল তৎকালীন মেজর জেনারেল হীরালাল অটলের কানে। ততদিনে ভারত পাকিস্তান প্রথম লড়াই শেষ হয়েছে, শহীদ হয়েছেন অনেক সেনা। অনেকদিন থেকেই ওনার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল বৃটিশ আর্মির সর্বোচ্চ শৌর্য পদক "ভিক্টোরিয়া ক্রস" এর আদলে এদেশে কোন পদক চালু করা যায় কিনা!

সাবিত্রী দেবীর জ্ঞান ও শিল্পকলার পারদর্শিতা দেখে একদিন তাঁকে ডেকে পাঠালেন জেনারেল, দিলেন এই পদক ডিজাইন করার ভার। নামটা অবশ্য তিনিই ঠিক করেছিলেন.......  পরমবীর চক্র, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ শৌর্য পুরস্কার!
দায়িত্ব নিয়ে সাবিত্রী প্রথমেই যেটা ভেবেছিলেন, নকশাটিতে যেন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতিফলন হয়। পুরাণের দধিচী মুনির কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। বৃত্রাসুরকে মারবার জন্য দেবরাজ ইন্দ্র চেয়ে নিয়েছিলেন তাঁর অস্থি, তাতেই তৈরি হয়েছিল বজ্রায়ুধ। স‍ংহার হয়েছিল অজেয় সেই দৈত্য! অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এক ঋষির বলিদানের অমর কাহিনী! ‌

পৌরাণিক সেই কাহিনীর স্মরণে পদকের নকশায় আনলেন চারটি বজ্রের প্রতিকৃতি, মাঝে অশোক চক্র। ঢালাই হলো সেটি ব্রোঞ্জের ওপর, শেষে ঝুলিয়ে দেয়া হলো খয়েরী রিবনের সাথে। জীবন কে বাজী রেখে যারা একদিন যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয়েছেন, তাদের জন্য এর থেকে ভালো পুরস্কার আর কি হতে পারে ? নকশাটি নেহেরুজীর অনুমোদন পেতে মহাবীরচক্র, বীরচক্র ও অশোকচক্রের মতো শৌর্য পদকের ডিজাইন তিনিই করেন।

পরমবীর চক্র পাবার তালিকায় প্রথম নামটি হলো মেজর সোমনাথ শর্মা। ৩রা নভেম্বর ১৯৪৭ এ পাক হানাদার বাহিনীর সাথে লড়াইয়ে শহীদ হন ৪নং কুমায়ুন রেজিমেন্টের এই মেজর। মাত্র দেড়শো সেনা নিয়ে রুখে দেন সাতশো দুর্ধর্ষ আফ্রিদি হানাদার। তাঁকে মরণোত্তর সম্মাননা দেয়া হয় ২৬শে জানুয়ারি ১৯৫০, দেশের প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসে। ঘটনাচক্রে মেজর ছিলেন সাবিত্রী দেবীর মেয়ের দেওর!

ওনার পতিদেব বিক্রম খানোলকর মেজর জেনারেল পদে থেকে অবসর গ্রহণ করেন, এবং কিছুদিন পরেই মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর সাবিত্রী তাঁর সমস্ত সম্পত্তি রামকৃষ্ণ মিশনে দান করে একরকম সন্ন্যাসিনীর জীবন যাপন করতে থাকেন। ১৯৯০ সালে নিভে যায় তাঁর জীবন দীপ। জন্মসূত্রে বিদেশি কিন্তু অন্তরে পুরোপুরি ভারতীয় এই মহীয়সীকে ভুলে যাবে না আমাদের দেশ, অন্তত যতদিন ভারতীয় সেনা সীমান্তে জীবনের সবটুকু দিয়ে ঠেকিয়ে রাখবে শত্রুর আগ্রাসন! ‌এদেশের জন্য ওনার কুরবানীও কি কিছু কম ?

সংগৃহীত ।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.