বিশ্ব চড়াই দিবস পালিত হচ্ছে
বিশ্ব চড়াই দিবস
নাসিরুদ্দিন আহমেদ
সালটা ১৯৫৮। চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং সকালে উঠে রাস্তায় পায়চারী করছিলেন। চোখে পড়ল রাস্তার পাশে ধান শুকোতে দেওয়া আছে, আর সেই ধান খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে একদল চড়াই পাখি। দৃশ্যের মধ্যে অবাক করা কিছু ছিলনা, এরকমটাই তো হয়ে থাকে। কিন্তু মাও এর মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। বেশ কিছুদিন ধরেই চীনের নানা প্রান্ত থেকে খবর আসছিল যে চাষীরা নানা অছিলায় চীন সরকারকে ফসল নির্ধারিত দামে বেচতে চাইছে না। সরকারী শস্য ভান্ডারে টান পড়েছে শস্যের। এর মাঝে এই চড়াইপাখি ধান খেয়ে এইভাবে শস্য নষ্ট করছে! মাও রুষ্ট চিত্তে নিজের অফিসে ফিরে গেলেন, ডাক পড়ল একান্ত সচিবের।
শুরু হল চীনের কুখ্যাত "স্ম্যাশ স্প্যারো" প্রোগ্রাম। হুকুম গেল যে যেখানেই চড়াই দেখবে, মেরে ফেল। মৃত চড়াইপাখি দেখালে মিলবে সরকারী ইনাম। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল সরকারী মদতে বেচারা চড়াই পাখীর নিধনযজ্ঞ। গুলতি, তীর ধনুক, এয়ার গান, ছররা গুলি যে যা দিয়ে পারে, চড়াই মারতে শুরু করল। পরের তিন মাসের মধ্যে চীন হল চড়াই শূন্য। আনুমানিক ৬০ কোটি চড়াই পাখীকে খুব ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছিল।
কিন্তু মাও যেটা জানতেন না যে চড়াইপাখী শুধু শস্যই খায় তা নয়, তার সাথে খায় অনেক পোকামাকড়, পোকামাকড়ের ডিম, লার্ভা - বিশেষ করে পঙ্গপালের। আর এই পোকারা শস্যের আসল ভক্ষক। তার মানে চড়ুই যদি মাসে এক কেজি শস্য খায় তার বিনিময়ে সে পঞ্চাশ কেজি শস্য বাঁচায় পোকা খেয়ে।
প্রকৃতি কাউকে ক্ষমা করে না। এই চড়ুই মারার ফল মিলল হাতে গরম। চীনের ক্ষেতে খামারে পোকা বেড়ে গেল অসম্ভব রকম। বিশেষ করে পঙ্গপালের উৎপাতে ফসল টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়ল। কারণ চীনের শেষ চড়াই পাখিটিকেও মেরে ফেলা হয়েছে। কে খাবে পোকা, কে বাঁচাবে ফসল? পরের দুটো বছরে চীন মুখোমুখি হল চীনের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ভিক্ষের। চারিদিকে জমল না খেতে পাওয়া মানুষের লাশের পাহাড়। প্রায় দেড় কোটি লোক (বেসরকারি মতে সাড়ে চার কোটি) অনাহারে মারা যায়। শুরু হয় মাও এর ওপর দেশবাসীর ক্ষোভ। দূর্জনে বলে যে এই বিক্ষোভের ওপর থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর জন্যই মাও ১৯৬২ তে ভারত আক্রমণ করেন।
যাক গে। এর পরের কথায় আসি। মানুষের ক্ষিদে বড় নির্মম জিনিস। চাল ডাল শূন্য দেশে চীনেরা ঢুকে পড়ল বনে, শুরু হল বনের প্রাণী মেরে খাওয়া। কিছুই বাদ পড়ল না। চীনের সরকার বাধা দিল না। এই করে করে চলল বন্যপ্রাণ নিধন মহোৎসব। এবং প্রথাটি চালু রইল বছরের পর বছর ধরে। এখন বুঝতে পারলেন তো যে চীনের লোকজন এরকম সর্বভুক কেন? এর ফল হিসেবে বনের প্রাণীর দেহের জীবাণুরা মানুষের দেহে বাসা বানানোর একটা সুযোগ পেল। শুরু হল আঞ্চলিক ভাবে কিছু অজানা অসুখে চিনেদের মৃত্যু। যেহেতু তখনও এত প্লেনে করে যাতায়াত চালু ছিল না, মহামারী হিসেবে সেগুলো অন্য দেশে, বা চীনের অন্য অংশে ছড়াতে পারে নি। ১৯৮৮ সালে চীন দেশের Wildlife Protection Act এ আনলো বিরাট পরিবর্তন। এসে গেল Wild Animal Farming এর সরকারী অনুমোদন। এতে বলা হল “The state shall encourage the domestication and breeding of wildlife.” ব্যাস আর কি! শুরু হয়ে গেল সরকারী মদতে বন্যপ্রাণ ভক্ষণ ও তার ফার্মিং। চালু হল Wet Markets - যেখানে মিলবে পাখি, ভাম, বাদুড়, সাপ, গোসাপ, কুকুর, শিয়াল, ইঁদুর, বিড়াল সক্কলের মাংস। উহান Wet Market এরকমই আরেকটি বাজার, যেখানে বিক্রি হওয়া বাদুড় থেকেই নাকি মনুষ্য সমাজে, গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে এই প্রাণঘাতী Covid 19 ভাইরাস। কার্যত অচল হয়ে গেছে পৃথিবী প্রায় দু বছর ধরে, মারা গেছেন ৬০ লাখের ওপর মানুষ। অর্থনৈতিক কারণে আরো কত কোটি লোক মারা গেছেন না যাবেন তার কোন ইয়ত্তা নেই।
আমি যদি বলি যে চীনের ওই ৬০ কোটি চড়াই হত্যার পাপ আমাদের পিছু এখনও ছাড়ে নি, সেটা কি খুব ভুল বলা হবে? প্রকৃতি বোঝে না দেশ বা প্রদেশের বিভাগ রেখা। সেই কারণে এক অর্ধউন্মাদ কমিউনিস্ট একনায়ক ১৯৫৮ সালে যে পাপ করেছিল তার মূল্য আজও আমাদের চোকাতে হচ্ছে।
২০ মার্চ ছিল বিশ্ব চড়াই দিবস। ওদের একটু ভালবাসুন, একটু জায়গা দিন বাসা বানানোর জন্য। ওরা ভালো থাকলেই আমরা ভালো থাকব।
কোন মন্তব্য নেই