৯/১১ নিউইয়র্ক হামলা: ভারতীয় চিত্রসাংবাদিক কমল শর্মার বয়ান
অতনু দাস, দেরাদুন
নিউইয়র্কে ৯/১১/২০১১ তারিখে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলা মানব ইতিহাসে নথিভুক্ত সবচেয়ে বড় হামলা যা আমাদের সুন্দর পৃথিবীকে চিরতরে বদলে দিয়েছে। দিল্লির চিত্র সাংবাদিক কমল শর্মা, জাতীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ও ইউএস ওপেন টেনিস কভার করতে আমেরিকা গিয়েছিলেন। ৯ সেপ্টেম্বর টেনিস শেষ হওয়ার পর, ১০ সেপ্টেম্বর, নিউইয়র্কে, বিশেষ করে ম্যানহাটানর ছবি ক্যামেরায় বন্দী করতে থাকেন। ফটোগ্রাফির কেন্দ্রবিন্দু ছিল টুইন টাওয়ার যা বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্র ছিল। নিচে তার বয়ান তুলে ধরা হল।
বিশ্ব
বিখ্যাত নিউইয়র্কের আকাশরেখা রাতে হাডসনের অপর প্রান্তের ব্রুকলিন এলাকা থেকে
সবচেয়ে সুন্দর দেখাচ্ছিল। কারণ আকাশরেখার সাথে ব্রুকলিন সেতুর ছবি সৌন্দর্য
বৃদ্ধি করছিল। তাই, রাত ১১-১২টা পর্যন্ত ফটোগ্রাফি
চলেছিল। সেই সময় ক্যামেরাটির ব্যবহার পদ্ধতি সহজ ছিল, ডিজিটাল ফটোগ্রাফির হ্যাপা ছিল না।
সে সময়ে ফিল্ম রোল ব্যবহার হত। তখন ক্যামেরার স্ট্যান্ডও ছিল না, তাই রাতের বেলা ছবি তোলা ছিল এক
বড় চ্যালেঞ্জ।আমি জানতাম না পৃথিবীতে যে টুইন টাওয়ারের ছবি কোটি কোটি মানুষ
তুলেছে তার শেষ ছবি আমার ক্যামেরায় বন্দি হবে। ঐ দিন রাত দুটায় বোনের বাড়িতে
পৌঁছে ছিলাম।সকালে ভগ্নিপতি ঘুম থেকে জাগিয়ে বলেছিলেন যে টুইন টাওয়ারের ছবি
ক্লিক করেছিলে তার একটির সাথে বিমান ধাক্কা খেয়েছে। এ একটি দুর্ঘটনা ভেবে গাড়ি
থেকে ফোটো তোলার জন্য আমরা বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু গাড়ির রেডিওতেই শুনতে পাই যে
বিমানটি দ্বিতীয় টাওয়ারেও আঘাত হেনেছে এবং এটি একটি দুর্ঘটনা নয় বরং একটি সুপরিকল্পিত
সন্ত্রাসী হামলা। ভগ্নিপতি বললেন আমাদের বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত। এটা খুবই বিপদজনক
অবস্থা।একজন চিত্রসাংবাদিক হিসেবে, আমি অনুভব করেছি যে আমাকে এই সন্ত্রাসী হামলাটি কভার
করতে হবে। কারণ ঘটনাস্থলের খুব কাছাকাছি আমরা ছিলাম।
ম্যানহাটনে
পৌঁছতে হলে সেতু পার হতে হয়। সেই ব্রিজ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেরিয়ে আসছিল।
কিন্তু ম্যানহাটনের দিকে যাওয়ার রাস্তায় একজনও ছিল না, মাত্র ২ জন পুলিশ। দৃশ্যটি ছিল
খুবই ভীতিকর। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছিল। কিন্তু আমি এটা দেখে অবাক হয়েছি যে, লোকদের শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে বের করা
হচ্ছে, কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। আমিও একবার
ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু সাহসের সাথে আমরা ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে গেলাম। ম্যানহাটন, যেখানে সবসময় ভিড় থাকতো, সম্পূর্ণ ফাঁকা ছিল। যেখানে
যানবাহনের ভিড় লেগে থাকতো, সেখানে দূর-দূর পর্যন্ত একটি গাড়িও
দেখা যায়নি ।
ঘটনাস্থলের
কাছেই সাইরেন বাজছিল ফায়ার ডিপার্টমেন্ট, পুলিশ, মিডিয়া এবং অ্যাম্বুলেন্সের। ভয়াবহ পরিস্থিতি।
সত্যি কথা বলতে, সেই সময় কেউ কেউ বলছিল ৫,০০০ মানুষ মারা গেছে। এটা শুনে
প্রাথমিকভাবে মানসিকরূপে বিধ্বস্ত হয়েছিলাম। ভীষণ খারাপ লাগছিল, শুধু আঙুলই ক্যামেরার বোতাম টিপে
ছবিটি ক্লিক করছিল। আমার হৃদয় কেঁদে উঠেছিল মানবতার এত বড় অপূরণীয় ক্ষতির কথা
ভেবে। বিল্ডিং ভেঙে ধুলো এবং ধোঁয়ার মেঘে চর্তুদিক মেঘাচ্ছন্ন। মানুষ তাদের জীবন
বাঁচাতে ছুটে চলেছে, প্রিয়জনকে খুঁজছে তাদের দেখে মনে
হচ্ছিল যে জীবনে কোনদিন কল্পনাও করিনি য়ে একদিন এইরকম দৃশ্য কেমেরাবন্দি করতে
হবে।এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের
জন্য ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা আমাদের সর্বোচ্চ কর্তব্য। এমন কঠিন সময়েও আমেরিকান
পুলিশ, অগ্নিনির্বাপক, ডাক্তার, পাবলিক মিডিয়ার লোকদের আচরণ
যথেষ্ট প্রশংসনীয় ছিল। কেউ আমাকে বাধা দেয়নি। সমস্ত আমেরিকানরা সেদিন তাদের
দেশের জন্য ঐক্যবদ্ধ ছিল।
ঘটনার
পরপরবর্তী দিন, ১২ তারিখ আমার জন্মদিন ছিল কিন্তু
আমার মন খুবই খারাপ ছিল। কেক কাটাতো দূরের কথা, কোনো কেক দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা হচ্ছিল না । ১৪
সেপ্টেম্বর আমাদের রিটার্ন টিকিট ছিল। কিন্তু বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া কিছু
দিন পর ফেরত দেশে এলাম।
ফিরে আসার
পর ফিরোজশাহ কোটলায় এক টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। টেস্ট ম্যাচ চলাকালীন বন্ধুদের
দেখানোর জন্য আমি আমার ক্যামেরার ব্যাগে 9/11 এর সন্ত্রাসী হামলার কিছু ফটো রাখতাম। ব্যাপারটা
কোনোরকম শচীন টেন্ডুলকর, অনিল কুম্বলে জানতে পেরেছিলেন। তাই
আমাকে ছবিগুলি দেখানোর জন্য ভারতীয় দলের ড্রেসিং রুমে ডাকা হয়েছিল। পুরো দল
ফটোগ্রাফি এবং সাহসের জন্য আমার অনেক প্রশংসা করেছিল। শচীন এবং কুম্বলে আমাকে দুটো
টি ছবি আরও বড় করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। পর দিন, যখন বড় ছবি দিলাম, শচীন বললেন যে এইটার মধ্যে আপনি সই
করুন। আমি ভেবেছিলাম আমার সাথে হয়ত ঠাট্টা করছেন। কিন্তু কুম্বলে এবং শচীন আমাকে
বলেছিলেন আপনার এই বিরল ছবি প্রদর্শন করা উচিত এবং একটি বই লেখা উচিত। সেদিন আমি
আমার তোলা টুইন টাওয়ারের শেষ ছবিগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলাম।
আমার
ভাতৃপ্রতিম বন্ধু সুনীল শর্মার সহযোগিতায়, ভারতের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল
সেন্টার ফর আর্টসে প্রথম ছবি প্রদর্শনী লেগেছিল যা দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র
এবং টিভি চ্যানেলে প্রসারিত হয়েছিল। প্রদর্শনীতে টুইন টাওয়ারের শেষ ছবিগুলো
সমাদৃত হয়েছিল। যদিও ৫০০ ওয়ানডে, টেস্ট ম্যাচ
এবং রঞ্জি ট্রফি ম্যাচ কভার করা ছাড়াও, দুবাইতে ইউরোপীয় ট্যুর গল্ফের সাথে অফিসিয়াল
ফটোগ্রাফার হওয়া এবং টাইগার উডস এবং সমস্ত শীর্ষ গল্ফারদের কভার করাও আমার কাছে একটা বিরল সম্মানের
বিষয়।
কোন মন্তব্য নেই