কাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন শুভেন্দু, নতুন দল তৈরির চেষ্টা করছেন কিনা তা নিয়েই নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে জল্পনায় যবনিকাপাতের সময় এখনও আসেনি। তাই শুধু নতুন অফিস করেই ক্ষান্ত নন তিনি। সর্বদাই রহস্যে মুড়ে রাখছেন নিজেকে। নিজেকে ধরে রাখছেন রহস্যের মোড়কে। সাংবাদিকদের ধরাছোঁওয়া দিচ্ছেন না। আবার তারই মধ্যে তিনি একাধিক নেতার সঙ্গে বৈঠকও করছেন বলে নানান সূত্রের খবর। ফলে গুঞ্জ পিছু ছাড়ছেই না !
মমতার সভা চলাকালীন কাঁথির বাড়ি থেকে বেরিয়ে শুভেন্দু কলকাতা রওনা দিয়েছিলেন। তারপর তাঁর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে গিয়েও তিনি নামেননি। সাংবাদিকদের দেখেই তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে চলে আসেন কোলাঘাট। আর শুভেন্দু যখন সুকিয়া স্ট্রিটে গিয়েছিলেন তার আগে সেখানে নাকি এক কংগ্রেস বিধায়ককেও দেখা গিয়েছিল।
শুভেন্দু কোলাঘাটে ফিরে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের গেস্ট হাউসে এক গোপন বৈঠক করেন বলেও খবর। এখন জল্পনা সেই বৈঠকে কে ছিলেন। সেখানে কি আগে থেকেই কংগ্রেস বিধায়ক বা দলের অন্য কোনও বিদ্রোহী সদস্য ছিলেন? শুভেন্দু কি তৃণমূল ছাড়ার আগে দল তৈরি করতে চাইছেন? তারপর একসঙ্গে কোনও পরিকল্পনা তৈরি তাঁর উদ্দেশ্য?
কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের গেস্ট হাউসে শুভেন্দুকে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করতে দেখা গিয়েছে। তবে কাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি ব্যস্ত ছিলেন, তা জানা যায়নি। ওই বৈঠকে কারা ছিলেন তা নিয়ে খোঁজ শুরু করেছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কোনও একজন, নাকি একাধিক নেতা ছিলেন বৈঠকে, তাও স্পষ্ট নয়।
এর আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় তৃণমূলের আর এক বিদ্রোহী বিধায়ক-মন্ত্রী রাজীবের সঙ্গে শুভেন্দুর বৈঠক হয়েছে বলে রটনা শুরু হয়ে যায়। যদিও তার কোনও সত্যতা পাওয়া যায়নি। কোনও পক্ষই তা স্বীকারও করেননি। উভয় রাজনীতিবিদের অনুগামীরাই তা উড়িয়ে দেন। ফলে ফেরার পথে কার বা কাদের সঙ্গে শুভেন্দু বৈঠক করলেন, তা অস্পষ্টই রয়ে যায়।
শুভেন্দু অধিকারী মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করেছেন প্রায় দু-সপ্তাহ অতিক্রান্ত। তারপরও তিনি স্পষ্ট করেননি তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। শুভেন্দু তৃণমূলের সঙ্গে প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায়ের উদ্যোগে বৈঠকেও বসেছিলেন। তারপরও ফেরার রাস্তা পরিষ্কার হয়নি। বরং তাঁর তৃণমূল ছাড়ার সম্ভাবনাই সুস্পষ্ট হয়েছে। তবে তৃণমূল ছেড়ে কার সাথে পা মেলাবেন তা সম্ভবত চূড়ান্ত হয়নি এখনও।
শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূলে ছেড়ে দিতে চলেছেন, এটা প্রায় পাকা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তিনি তৃণমূল ছেড়ে কোথায় যাবেন তা এখনও অস্পষ্ট রয়ে গিয়েছে। তবে এরই মধ্যে বিজেপির সর্বভারতীয় সহসভাপতি মুকুল রায় জল্পনা বাড়ালেন শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বার্তায়।
মুকুল রায় বিজেপিতে যাওয়ার পর থেকেই শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে জল্পনার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। যদিও শুভেন্দুর কোনওদিনও মুকুল রায়ের সঙ্গে তেমন গভীর সখ্যতা ছিল না। তা সত্ত্বেও শুভেন্দুকে দলে টানতে তৎপর ছিল বিজেপি। তারপর তিন বছরেরও বেশি সময় কেটে গেলেও শুভেন্দু তৃণমূলেই রয়ে গিয়েছেন।
সম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেসে রদবদলের পর থেকেই শুভেন্দু দলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে শুরু করেছেন। প্রশান্ত কিশোরের এন্ট্রি তিনি ভালোভাবে নেননি। সেখান থেকেই ফাটল তৈরি। তা বাড়তে বাড়তে এখন ভাঙনের শেষ সীমায় এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মন্ত্রীত্ব ছেড়েছেন শুভেন্দু। প্রাতিষ্ঠানিক সমস্ত পদ থেকেই প্রায় ইস্তফা দিয়েছেন তিনি।
তৃণমূল শেষ চেষ্টা করেও ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে শুভেন্দুকে। এমতাবস্থায় শুভেন্দুর গতিবিধি নিয়ে নানা গুঞ্জন ছড়াচ্ছে। শুভেন্দু একা নয়, তিনি বেঁকে বসতেই তৃণমূলে আরও কিছু নেতা-মন্ত্রী-বিধায়ক সরব হতে শুরু করেছেন। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় তার মধ্যে অন্যতম। মুকুল-ঘনিষ্ঠ বিধায়ক শীলভদ্র দত্তকেও মাঝেমধ্যে উল্টো সুর গাইতে শোনা যাচ্ছে।
এরই মধ্যে রটে যায় ব্যারাকপুরের তৃণমূল বিধায়ক শীলভদ্র দত্ত গিয়েছেন মুকুল রায়ের বাড়িতে। এ প্রসঙ্গে মুকুল রায় যা বললেন, তাতে চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার জোগাড়। মুকুল প্রথমে শীলভদ্র সম্পর্কে বলেন, ও তো প্রায়ই আসে আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমার সঙ্গে গল্প করে যায়। তবে এদিন আসেনি শীলভদ্র। আমার সঙ্গে দেখাও হয়নি।
মুকুল বোমাটা ফাটান তারপরেই। মুকুল বলেন, কীসের জল্পনা--বেশ কিছু বিধায়ক শুভেন্দুর সঙ্গে আছে। শীলভদ্রও তাদের সঙ্গেই আছে। এটুকু আমি জানি। এর বাইরে আমার কিছু জানা নেই। শুভেন্দু বিধায়ক হয়ে আছে তো কি হয়েছে, এই যে অনেক বাম-কংগ্রেস বিধায়ক তৃণমূলের জায়গায় বসছে, তারা কি কেউ বিধায়ক পদ ছেডে়ছে?
মুকুল রায় বলেন, শুভেন্দু অধিকারী বিধায়ক পদ না ছাড়লেও মন্ত্রিত্ব ছেড়েছে, এটা স্পষ্ট--শুভেন্দু একজন গণ আন্দোলনের ফসল। আমার বিশ্বাস শুভেন্দু গণ আন্দোলনকে সম্মান জানিয়েই নিজের সিদ্ধান্ত নেবে। তৃণমূল বলে কিছু নেই এখন। পার্টিতে যারা দল তৈরি করেছে, দলের জন্য রক্ত দিয়েছে, তারা উপেক্ষিত--তাদের সিংহভাগই হারিয়ে গেছে। যেদিন দল ছেড়েছিলাম, বলেছিলাম শেষের শুরু, এখনও বলছি শেষের শুরু হয়ে গিয়েছে তৃণমূলে।
মুকুল রায়ের এই কথায় অনেকটাই স্পষ্ট যে তৃণমূল ভাঙতে চলেছে। এবং শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূলের বিক্ষুব্ধদের নিয়ে একটা দল তৈরি করছেন। সেই দলে মুকুল ঘনিষ্ঠ তৃণমূল বিধায়করাও রয়েছেন। ফলে একুশের আগে অন্য সমীকরণের গন্ধও থাকছে এই বার্তায়। হয় শুভেন্দু সদলবলে বিজেপিতে যোগ দেবেন, নতুবা শুভেন্দু দল তৈরি করবেন এবং সেখানে মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠরাও থাকছেন। অর্থাওৎ মুকুল রায়ের জ্ঞাতসারেই ঘটছে সবকিছু !
এদিকে শুভেন্দু অধিকারী সোমবার গাড়ি ছুটিয়ে কলকাতা ভ্রমণের পর থেকেই জল্পনার পারদ চড়েছিল। মঙ্গলবার বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডার কলকাতায় আসার খবরে শুভেন্দুর বিজেপিতে যোগদানের জল্পনা আরও তীব্র হয়েছে। শুভেন্দু সাংবাদিক এড়াতে কলকাতায় নিজের ফ্ল্যাটে গাড়ি থেকে না নামাতেই চর্চা শুরু হয়ে যায়--তবে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গড় থেকেই শুভেন্দুকে দলে বরণ করে নেবেন নাড্ডা?
বিজেপি সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা শহরে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী ক্ষেত্রে ‘আর নয় অন্যায়' কর্মসূচির প্রচারে। আর তার আগে শুভেন্দু ঘনিষ্ঠ কনিষ্ক পণ্ডা দাবি করেছিলে্ন শুভেন্দু অধিকারী দক্ষিণ কলকাতার কোনও এক জায়গা থেকে নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ স্পষ্ট করবেন।
তার ফলেই জল্পনার পারদ চড়েছে অনেকটাই, তিনি ঐ দিনই ঘোষণা করবেন তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ? পাশাপাশি প্রশ্ন উঠছে, শুভেন্দু কি সেই দিনই বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিতে পারেন? কেননা শুভেন্দু বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিয়েই পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছিলেন। রাজনৈতিক মহলের জল্পনা, এমনও হতে পারে নাড্ডার উপস্থিতিতে তিনি বিজেপিতে যোগ দিলেন। তবে তা হবেই এখনও এমন কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত এখনও মেলেনি।
বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা মমতা বন্দ্যোরপাধ্যায়ের গড় ভবানিপুরে আসার কথা ছিল মঙ্গলবার--তার সেই কর্মসূচী দু’দিন পিছিয়ে আগামী ১০ তারিখ বৃহস্পতিবার হতে চলেছে বলে খবর। শুভেন্দুর অনুগামী নেতার কথা, শুভেন্দুর কলকাতায় আসা, তারপর বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী ক্ষেত্রে কর্মসূচির প্রচার--এই সবকিছু মিলে যেতেই জল্পনার পারদ চড়তে শুরু করেছে।
সোমবার মমতার সভা চলাকালীন শুভেন্দু কলকাতায় আসার পর থেকেই জল্পনা শুরু হয়ে যায়। সাংবাদিকরা তাঁর পিছু নেয়। যে কোনও মুহূর্তে বড় কোনও পদক্ষেপ বা রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঘোষণা করতে পারেন শুভেন্দু, চর্চা শুরু হয়ে যায় রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। প্রশ্ন ওঠে শুভেন্দু কেন হঠাৎ কলকাতায় এলেন নাড্ডার সফরের আগে?
শুভেন্দু অধিকারী বিগত তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলছেন। শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে আলোচনার টেবিলে সমস্যা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। ফলে তাঁর তৃণমূলে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। একুশের আগে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল ছেড়ে কোন পথে পাড়ি দেন, সেদিকেই নজর রাজনৈতিক মহলের।
অনেকেই মনে করছেন তিনি যদি ১০ তারিখে জে পি নাড্ডার হাত থেকে বিজেপির পতাকা গ্রহণ করেন তাহলে একা করবেন না তাঁর সঙ্গে আরও জনা চারেক বিশিষ্ট বিক্ষুব্ধ নেতাও বিজেপিতে যোগ দেবেন !!
কোন মন্তব্য নেই