Header Ads

একুশের আগে বাংলায় মুকুল রায়কে সর্বভারতীয় সাংগঠনিক মর্যাদা বিজেপি’র !!

  


বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

দিন তিনেক আগে আমি লিখেছিলাম--‘মুকুলকে উপযুক্ত মর্যাদা না দিয়ে কোণঠাসা করে দিলীপ ঘোষকে একাই ১০০ করার পরিণামে বাড়া ভাতে ছাই পড়তে চলেছে বিজেপি-র’--এই লেখা দেখে বেশ কযেকজন ‘মোটাভাই টাইপের’ রাজনৈতিক ব্যক্তি আমাকে ফোন করেছিলেন--বেশ কিছু কথাও হয় তাদের সঙ্গে এবং সেদিনই দিলীপ ঘোষের ‘দুর্গ’ হিসেবে বিজেপি-প্রচারিত খড়গপুরে ঘোষবাবুর ‘দক্ষিণহস্ত’ চার-চারজন দলীয় ‘মোটাভাই’ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তৃণমূল শিবিরে দৌড়ে পালালেন ! শুধু এঁরাই নয়--রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বিজেপি থেকে তৃণমূলে যাওয়ার প্রায় প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। তাদের সামনে ঝুলছিল ইস্টম্যান কালারে রঙিন ঝাঁচকচকে কর্পোরেট টোপ (বিজ্ঞাপন)--‘পদ চাই? টিকিট চাই? রাজনৈতিক নেতার পেশায় সামনের সারিতে আসতে চান?--আমরা অপেক্ষা করছি আপনার জন্যে ! অর্থাৎ উজ্জ্বল রাজনৈতিক ভবিষ্যতের টোপ যত চিত্তকর্ষকভাবে নাকের ডগায় ঝুলিয়ে দেওয়া হল ততই শুধু বিজেপি নয়--অন্যান্য দল থেকেও তৃণমূলে নাম লেখানোর ধুম পড়ে গেল ! বঙ্গ বিজেপি’র কূটকচালিতে বিভ্রান্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের আর ভুলভাল বুঝিয়ে মুকুল সম্পর্কে উদাসীন রাখা যাচ্ছিল না। তাঁরা অর্থাৎ দলের কেন্দ্রীয় ‘মোটা ভাই’রা বঙ্গ বিজেপি’র এই ক্ষয়িষ্ণু প্রবণতা দেখে রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন--প্রকাশ্যে মুকুলের গুরুত্ব সেভাবে স্বীকার না করলেও তারা বুঝতে পারছিলেন মুকুলকে সসম্মানে দলে ধরে রাখতে না পারলে বাংলায় পরিবর্তন আনার স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়বে--রাহুল সিনহা তো বটেই--দিলীপ ঘোষের ওপরেও ভরসা করে স্বপ্ন দেখাটা হারাকিরি হয়ে যাবে। সুতরাং মুকুলকে বিজেপি’র মতো সর্বভারতীয় দলের সহসভাপতির পদে বসিয়ে উপযু্ক্ত মর্যাদা দিতে অনেকটা দেরি হয়ে গেলেও আর বেশি সময় নেওয়ার রাজনীতি করার ঝুঁকি নিতে তাঁরা চাইলেন না। বিজেপি’র গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় সহসভাপতির পদটি অন্যান্য অনেক দলের মতো নিছকই আলঙ্কারিক ছেলেভুলানো গিফট্ মাত্র নয়--সুতরাং এটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে--বঙ্গ বিজেপিতে দিলীপ ঘোষের নিরঙ্কুশ আধিপত্য থাকবে না--শুরু হবে বাংলা রাজনীতির ‘চাণক্য’ মুকুলের প্রবল আধিপত্য। ছন্নছাড়া হতে বসা বঙ্গ বিজেপি’র সাংগঠনিক পরিকাঠামোকে ভদ্রস্থ করে তোলা মুকুলের পক্ষে খুব কঠিন কিছু কাজ নয়--উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা পেলে কোথা থেকে কোথায় দলকে তুলে নিয়ে যেতে পারেন সেটা খুব একটা কারুর অজানা নয়। পাশাপাশি এটাও অনেকেই দেখেছেন মর্যাদাহানিকর অসম্মানের উপযুক্ত রাজনৈতিক জবাব দেওয়ার ব্যাপারেও তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত। 

মুকুলকে সঠিকভাবে ব্যবহারের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় মোটাভাইদের সিদ্ধান্তহীনতার পরিণাম যে বিজেপি’র পক্ষে মোটেও সুখকর হবে না--এ কথা আমি বেশ কয়েকবার বঙ্গ রাজনীতির সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলেছি। শেষপর্যন্ত মোটাভাইরা মুকুলের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে করা যেতে পারে। যদিও মুকুলের এই ‘মর্যাদা’ আক্ষরিক অর্থেই মর্যাদা যদি হয় তাহলেই বলতে পারা যাবে এ সিদ্ধান্ত সঠিক। অনেকটাই সঠিক বলে মনে করা যাচ্ছে বঙ্গ বিজেপি’র প্রাক্তন সভাপতি রাহুল সিনহাকে কেন্দ্রীয় সংগঠন থেকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্তটি সামনে আসায়। রাহুল সিনহা কেন্দ্রীয় মোটাভাইদের বিরুদ্ধে বেজায় ক্রোধ জ্ঞাপন করে তাঁদের ১০-১২ দিন সময় দিযেছেন তাঁর প্রতি অবিচারের বিষযটি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভেবে দেখার জন্য--তারপর তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত জানাবেন ! রাহুল মুকুল ঘনিষ্ঠ অনুপম হাজরার দিকেই আঙুল তুলে অভিযোগ করেছেন--তৃণমূলের নেতাকে গুরুত্ব দিতেই তাঁকে বাদ দেওয়া হল ! যদিও তিনি নিজেই খুব সচেতনভাবেই জানেন--কেন তাঁর মতো ‘হাইপ্রোফাইল’ বঙ্গ বিজেপি’র নেতাকে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক পদ থেকে সরানো হল। রাহুল যদি প্রথম থেকেই মোদী-অমিত জমানার সম্পূর্ণ নতুন বিজেপি’র রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করে মুকুলের নেতৃত্ব মেনে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে রাজনীতিটা করতেন বা করাটা কত জরুরি ছিল তা বুঝতেন তাহলে তাঁকে আজ এইভাবে হাহাকার করতে হত না ! যাঁরাই মুকুলের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় মোটাভাইদের কান ভারি করে এসেছেন বা আসবেন তাদের পক্ষে নতুন সর্বভারতীয় সহসভাপতি মুকুল রায়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত ইগো এবং অহমিকা সম্বল করে পাঙ্গা নেওয়ার ফল মোটেও সুখকর হবে না। এটা বুঝতে পারাটা এখন সামান্য সমযের অপেক্ষা মাত্র। যাইহোক, দলে যোগ দেওয়ার প্রায় তিন বছর পর মুকুল রায়ের গুরুত্ব বাড়ানো হল ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের কথা ভেবেই। যদিও রাহুল সিনহা বাদ পড়ায় নতুন করে তাঁকে নিয়ে উদ্বেগ শুরু হল বঙ্গ বিজেপিতে। বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনের আগে যখন বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মুকুল রায়-সহ তিনজনকে পদ দেওয়া হল, তখন দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক রাহুল সিনহাকে কেন বাদ পড়তে হল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে পড়েছে। অন্যান্য কিছু কারণ ছাড়াও--আমার ধারণা, তথাগত রায়ের পক্ষে রাহুলের দাঁড়িয়ে যাওয়াটাই তাঁর বিপদের কারণ হয়েছে। শনিবার বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে রদবদল করেন। নতুন তালিকা প্রকাশের পর দেখা যায় সেই তালিকায় নাম নেই রাহুল সিনহার। কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক পদ থেকে তাঁকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। তার জায়গায় বাংলা থেকে ঢুকেছে মুকুল-ঘনিষ্ঠ অনুপম হাজরার নাম ! মুকুল রায়কে কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি করা হয়েছে বিজেপির। এতদিন অপেক্ষা করার পর বড় পদই পেয়েছেন তিনি। তিনি তৃণমূলেও এই পদে ছিলেন বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আগে। অনুপমকে কেন্দ্রীয় বিজেপির সম্পাদক করা হয়েছে আর রাজু সিং বিস্তকে করা হয়েছে বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র ! স্বভাবতঃই প্রশ্ন উঠেছে রাহুল সিনহাকে নিয়ে। যদি বাংলাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েই থাকে ২০২১-এর নির্বাচনকে লক্ষ্য করে, তাহলে রাহুল সিনহার ডানা ছাঁটা হল কেন। তাঁকে কেন সরিয়ে দেওয়া হল কেন্দ্রীয় পদ থেকে? রাজনৈতিক মহলে তা নিয়ে চর্চা চলছে। রাহুলের গুরুত্ব হ্রাসের পিছনে তাঁর সাম্প্রতিক ভূমিকা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সম্প্রতি রাহুল সিনহা খুল্লামখুল্লা সমর্থন জানিয়ে বসেছিলেন তথাগত রায়কে। তথাগত রায় টুইট করে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী-মুখ হতে চেয়েছিলেন। তখন পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন রাহুল সিনহা। তারপর মেঘালয়ের রাজ্যপালের পদ ছেড়ে বাংলার ফিরে আসতেই বিমানবন্দরে তথাগত রায়কে সাদর সম্ভাষণ জানাতে হাজির হয়েছিলেন রাহুল অনুগামীরা। তাতেই কেন্দ্রীয় বিজেপি ক্ষুণ্ণ হয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, ২০২১-এ আসন্ন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের দিকে চেয়েই এই রদবদলে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিজেপির বঙ্গ নেতৃত্বকে। বিশেষ করে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মুকুল রায়কে। এতদিন মুকুল রায় বিনা পদে কাজ করে গিয়েছেন বিজেপিতে। তাই তাঁকে যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়েছে। তিনি কেন্দ্রীয় পদ পেয়েছেন। তাঁর অনুগামী অনুপম হাজরাও কেন্দ্রীয় পদ পেয়েছেন। তিনি হয়েছেন কেন্দ্রীয় সম্পাদক।

এইসব দেখেশুনে রাজনৈতিক মহলের ধারণা--মুকুল রায় দ্রুত তাঁর এলোমেলো হয়ে যাওয়া ঘুঁটিগুলো সাজিয়ে নিতে পারবেন এবং একদা যে দলটাকে সর্বস্ব পণ করে শূন্য থেকে ১০০-য় তুলেও অপ্রত্যাশিতভাবে কলঙ্কের দায় মাথায় নিয়ে হেনস্থা ও অসম্মানের সঙ্গে দল ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন তীব্র হতাশা ও যন্ত্রণার সঙ্গে তার সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্যেই যে অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কাজ করতে হবে তাকে-এ বিষয়ে কোনরকম সন্দেহ থাকার কথা নয়। 

মুকুলকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি প্রচুর জল্পনা শুরু হয়েছিল--এমন কী গল্পের গরুকে অনায়াসে গাছের মগডালে চড়িয়ে দেওয়াও হচ্ছিল--মনে করা যেতে পারে--এখন এইসব অলীক জল্পনার পরিসমাপ্তি ঘটবে !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.