Header Ads

শিক্ষক দিবস বিশেষঃ শিক্ষাবিদ বাবার প্রতি বিনীত স্মৃতি তর্পণ


লিখেছেন কবিতা সেনগুপ্ত। তিনি শিলচরের পাবলিক উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্ৰিন্সিপাল। এই লেখার মাধ্যমে তিনি তাঁর বাবা দক্ষিণ আসামের বরাক উপত্যকার প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ প্রয়াত কল্যাণ কুমার সেনগুপ্তের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

‘আমার বাবা সেরা’- আমরা আমাদের শৈশবকালে যা বলতাম বা লিখতাম আমার বাবা সম্পৰ্কে তা খুবই কম বলা হয়েছে বলে আমি মনে করি এবং এর চেয়ে কম কিছু আমরা বলেছি, আমরা এই কথাটি বলার ৫০ বছর পর কথাটি হৃদয় দিয়ে অনুভব করছি।

আমার বাবা প্ৰয়াত কল্যাণ কুমার সেনগুপ্ত প্রতিযোগিতার অনুভূতি নিয়ে প্রতিদিন জেগেছিলেন, গতকালের চেয়ে তার চেয়ে ভাল মানুষ হওয়ার চ্যালেঞ্জ ছিল তাঁর মনে। তাঁর এই বৈশিষ্ট্যই তাঁকে আধ্যাত্মিক বাবা হিসাবে গড়ে তুলেছিল এবং সেইভাবে তিনি নিজেকে বাধ্য পুত্র, সহায়ক ভাই, প্রেমময় স্বামী, একজন নিবেদিত পেশাদার, সহানুভূতিশীল শিক্ষিক, পরিবারের একজন দায়িত্বশীল মানুষ হওয়ার সর্বোচ্চ মান অৰ্জন করতে পেরেছিলেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে তিনি একজন সৎ ও সম্মানিত ব্যক্তি। 

অবিভক্ত বাংলার পূর্ব অংশে একজন মুক্তিযোদ্ধা প্ৰয়াত কালী প্রসন্ন সেনগুপ্তের পরিবারে জন্মগ্রহণ করা, আমার বাবার শিরায় শিরায় একজন মুক্তি যোদ্ধার রক্ত ছিল। বাবার শৈশবকালে আমার দাদা-দাদি বরাক উপত্যকার জয়পুর গ্রামে পাড়ি জমান। আমার বাবা একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন, অ্যাকাডেমিক এবং কো-কারিকুলার ক্রিয়াকলাপে দক্ষ ছিলেন। আমার ঠাকুরদার প্ৰভাব আমার বাবার ওপর পড়েছিল। তিনি অৰ্থাৎ আমার বাবা সবসময় জাতির সেবা এবং সুরক্ষা করতে চেয়েছিলেন। আইএসসি শেষ করার পর তিনি আম্বালায় ভারতীয় বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু মনে হচ্ছিল তাঁর ভাগ্যটি যেন ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছিল। তখন আকস্মাৎ আমার ঠাকুরদা পরলোক গমন করেন। আট ভাইবোনের মধ্যে আমার বাবা সবার বড় ছিলেন। সেই পরিস্থিতিতে পরিবার প্ৰতিপালনের দায়িত্বভার পড়ে আমার বাবার ওপর। তখন বাবাকে চাকরি ছেড়ে পরিবারের সদস্যদের দেখতে নিজের শহরে ফিরে আসতে হয়। বাবা স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরিতে যোগ দিলেন এবং পাশাপাশি নিজের পড়াশুনোও চালিয়ে গেলেন। তিনি প্ৰথমে স্নাতক এবং পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে অৰ্থ উপাৰ্জন করে নিজের ভাইবোনদের পড়াশুনাও চালিয়ে গেছেন, পরিবার প্ৰতিপালন করেছেন। আমার বাবা অন্য পুরুষদের মতো ছিলেন না, তিনি খুব নিষ্ঠা সহকারে নিজের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর ভেতরে একটি সহানুভূতিশীল মনও ছিল। তিনি বিনামূল্যে ছাত্ৰছাত্ৰীদের পড়াশুনা করাতেন, গ্ৰামের মানুষের ছেলেমেয়েদের জীবন যাত্ৰার মান উন্নতি করেছিলেন। তিনি প্ৰত্যেকদিন বিটি পড়ার জন্য নাইট ক্লাসে যোগ দিতে শিলচর থেকে জয়পুর ৮০ কিলোমিটার পথ সাইকেলে যাতায়াত করতেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি এক দুর্দান্ত সন্ধ্যায়, আমার মা আর বাবার সাক্ষাৎ হয়। তাঁদের জুটি স্বৰ্গেই ঠিক হয়েছিল। সেই থেকেই শেষ দিন পৰ্যন্ত মা দীপিতা সেনগুপ্ত আমার বাবার পাশে ছিলেন। দুজনে হাতে হাত ধরে জীবনের সমস্ত উত্থান পতন সামাল দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের প্ৰখ্যাত শিক্ষাবিদ সুরেন্দ্ৰ লাল রায়ের কনিষ্ঠা কন্যা আমার মা। তিনি বিয়ের আগে শিলিগুড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। আটজন ভাইবোনের সবার বড় জনের সঙ্গে বিয়ের অৰ্থ ছিল তিনি আটজনের একজন মা য়ের মতো ছিলেন। পরিবারকে একসূত্ৰে বেঁধে রাখতে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন চাকড়ি ছেড়ে পুরো সময় গৃহকৰ্মী হিসেবে থাকবেন। পরিবারের জন্য মা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। দেশ থেকে ব্ৰিটিশদের তাড়িয়ে দেওয়াই যেন আমার ঠাকুরদার মূল লক্ষ্য ছিল। বিৰ্টিশরা চলে গেল আর আমার ঠাকুরদারও যেন লক্ষ্য পূৰ্ণ হয়ে গেল। ব্ৰিটিশরা চলে গেল কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া ভাষা আমার বাবা খুব সুন্দর রপ্ত করেছিলেন। একজন ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে আমার বাবা সৰ্বত্ৰ প্ৰশংসা অৰ্জন করেছিলেন।     
‘স্টার্ট-আপ’ শব্দটি তৈরি হওয়ার কয়েক দশক আগেই আমার বাবা একজন চাকরি স্রষ্টার গুরুত্ব এবং ছোট ব্যবসার মূল্য বুঝতে পেরেছিলেন।
 তিনি ‘ওরিয়েন্টাল প্রিন্টারস’ এবং ‘উষা পাবলিকেশন’ (তাঁর মা শিলচর মহাকুমা পরিষদের প্রথম মহিলা প্রতিনিধি উষাবতী সেনগুপ্তের নামে) একটি ছাপাখানা বসিয়েছিলেন। যেখানে বেশ কয়েকজনের নিযুক্তি হয়েছিল। সমাজের বিভিন্ন প্ৰত্যাহ্বান কখনও আমার বাবার নজর এড়িয়ে যায় নি। তিনি খুব লড়াকু ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর সামান্য যতটুকু সম্পত্তি ছিল সমাজের কল্যাণের কাজে ব্যবহার করেছেন। গোটা সমাজই ছিল তাঁর পরিবার। প্ৰত্যাহ্বানে ভরা জীবন বাবাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল। তিনি রাজ শিক্ষক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। অবসর গ্ৰহণের পর শিক্ষকতার প্ৰতি তাঁর অনুরাগ অব্যাহত ছিল। তিনি প্ৰথমে বিএড কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন। তারপর তিনি শহরের বেশ কয়েকটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি সাহিত্যিক মনোভাবাপন্ন ছিলেন। লিখতে ভালোবাসতেন, এলাকার বেশ কয়েকটি স্কুলে গান লিখেছিলেন। তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং দূরদর্শনেরও একজন সহযোগী ছিলেন। আমার মনে আছে সেই সন্ধ্যা যখন তিনি তাঁর হারমোনিয়ামের সাথে বসে তাঁর প্রিয় গানটি করেছিলেন "ক্লান্তি আমার খোমা কোরো প্রভু" ঠাকুরের, যার অনুবাদ "এই ক্লান্তি আমাকে ক্ষমা করুন ওহ আমার প্রভু"। পিছনে ফিরে তাকালে, আমি বিশ্বাস করি আমার বাবা তাঁর সময়ের আগেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আজকের দিন ও যুগে যখন আমরা পুরুষতন্ত্রের শেকল ভাঙা পুরুষদের প্রতিটি ছোট্ট অঙ্গভঙ্গি উদযাপন করি (যা আমাদের যথার্থই হওয়া উচিত) অর্ধ শতাব্দী আগে আমার বাবা এই ভাইবোনদের জন্য সমান শিক্ষা নিশ্চিত করেছিলেন। দুই কন্যার জনক, আমি কখনই তাঁকে পুত্র না হওয়ার ব্যপারে   অভিযোগ করতে দেখিনি। কীভাবে তিনি তাঁর উভয় কন্যাকে পুত্ৰসম ভালোবাসা দিয়েছেন। এটা তাঁর উদারনৈতিক মানসিকতার পরিচয় ছিল। আমরা বড় হওয়ার পরে এবং সমাজ সম্পর্কে আরও জানার পরে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে আমাদের স্বাভাবিকটি সামাজিক ছিল না। মোটকথা বলতে গেলে আমার বাবার গল্পটি আত্মপ্রেমের নয়, আত্মবিশ্বাসের। তাই তো গৰ্ব করে বলি-  হ্যাঁ, ‘আমার বাবা সেরা’।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.