Header Ads

ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন আগে না স্কুল আগে সেটা মা-বাবা ও পরিবারকেই ভাবতে হবে !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় 
 
প্রতিদিন এখন যেভাবে সংক্রমণের সংখ্যা বেড়ে চলেছে তাতে এখনও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না এই বৃদ্ধির প্রবণতা কবে কমবে--থামার কথা তো এই মুহূর্তে ভাবাই যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে স্কুল খোলার বিষয়টি নিয়ে জোর কদমে আলোচনা চলছে উচ্চমার্গীয় শিক্ষাদরদী তথা শিক্ষাবিদদের মধ্যে। আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে অভিভাবকদের মধ্যে। নিজেদের সন্তানসন্ততিদের জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার প্রশ্নে তাঁরা এখন রীতিমতো উদ্বিগ্ন।
 
 ‘শিক্ষাদরদী শিক্ষাবিদরা’--যাদের মধ্যে দু’চারজন প্রধানশিক্ষক শিক্ষক ও স্কুল পরিচালন কমিটির সদস্যও রয়েছেন--প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি নানান বিষয় নিয়ে পড়াশোনা গবেষণা করলেও বিশ্বব্যাপী স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত পড়াশোনা প্রায় করেন না বললেই চলে। পড়াশোনা করলে তারা কি কি জানতে পারতেন সে কথায় যাওয়ার আগে বিশেষ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় একটু দেখে নিতে হবে। 
 
কেন্দ্রীয় সরকারের সুস্পষ্ট নিষেধ সত্ত্বেও গুরগাঁওয়ের একটি স্কুলের শিক্ষক ও স্কুল পরিচালন কমিটির সদস্যরা স্কুল চালু করে দিয়েছিলেন। স্কুল চালুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ৬৪ জন ছাত্র-ছাত্রী করোনা সংক্রমিত হয়ে পড়ে। স্কুলও সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিতে হয়। এই ৬৪ জনের মাধ্যমে চেইন সিস্টেমে কতজন সংক্রমিত হলেন সে খবর এখনও জানা যায় নি। গুরগাঁওয়ের ঘটনায় উজ্জীবিত হয়ে কিনা জানি না, গতকালই দেখলাম মেদিনীপুরের এক শিক্ষাদরদী শিক্ষাবিদ তথা প্রধানশিক্ষক ঢাকঢোল পিটিয়ে স্কুল চালু করে দিলেন ! জানি না তাঁর এই স্কুল চালুর অতি আগ্রহের পেছনে ‘শিক্ষারত্ন’-এর হাতছানি ছিল কিনা। রাজনৈতিক প্রগতিশীলতা প্রমাণেরও তাগিদ থাকা অসম্ভব নয় অবশ্য। কারণ যাই হোক, এই প্রধানশিক্ষক তাঁর সহশিক্ষক ও পরিচালন কমিটির সদস্যরা অনেক কিছুই জানেন নিশ্চয়ই--কিন্তু গোটা বিশ্বে স্কুল খোলার পরিণাম সম্পর্কে যে বিন্দুবিসর্গ খোঁজখবর রাখেন নি সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই। ফলে তাঁরা একদিনের জন্যে হলেও স্কুল খুলে কতজন ছাত্রছাত্রীকে সংকমিত করতে সাহায্য করলেন তা ততক্ষণ বোঝা যাবে না যতক্ষণ না তাদের সকলের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু ভীষণভাবে জরুরি এই নমুনা পরীক্ষা কি আদৌ করা হবে? স্কুল শিক্ষকদেরও নমুনা পরীক্ষাটা সমানভাবেই জরুরি।
ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ স্কুল খুলতে গিয়ে প্রচুর ছাত্র-ছাত্রীকে সংক্রমণের আওতায় নিয়ে এসে স্কুল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। যদিও ঐ সব দেশে আক্রান্তের হার অনেকটাই কমের দিকে। এখানে আমেরিকার খবরটা খুবই প্রাসঙ্গিক--তাই উল্লেখ করা দরকার মনে হচ্ছে আমার।
করোনার কারণে সবকিছুর পাশাপাশি থমকে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। পুরো বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থায় নেমে এসেছে স্থবিরতা। তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে করোনা সংকটের মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে পুনরায় স্কুল খোলার অনুমতি দেয় ট্রাম্প প্রশাসন। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের স্কুল চালুও হয়েছে। রিপোর্ট বলছে, মাত্র দু-সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ১ লাখ শিশু করোনায় আক্রান্ত হয়েছে।
আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, স্কুল পুনরায় চালুর পর থেকে মাত্র দু-সপ্তাহের মধ্যে এক লাখের কাছাকাছি শিশুর কোভিড টেস্ট রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। সমীক্ষা অনুযায়ী, কোভিড আক্রান্ত পড়ুয়ার সংখ্যা ৯৭ হাজার ছাড়িয়েছে। জুলাইয়ের শেষ দু-সপ্তাহের মধ্যে এই ৯৭ হাজার শিশুর করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। স্কুলে যাতায়াতের পথেই যে সংক্রমণ, রিপোর্টে তা নিশ্চিত করে বলা হয়েছে।
আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্সের রিপোর্ট আরও দাবি করে, জুলাইয়ের ওই দু-সপ্তাহে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কমপক্ষে ২৫ শিশুর মৃত্যুও হয়েছে। শিশুদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রবণতা কম বলে যে দাবি এতদিন করা হচ্ছিল, আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্সের সমীক্ষা রিপোর্ট তা নস্যাৎ করে দেয়।
মাত্র দু-সপ্তাহে যদি প্রায় এক লক্ষ শিশু কোভিডে সংক্রামিত হতে পারে, তা হলে স্কুল চালু রাখলে, সংখ্যাটা গিয়ে কোথায় পৌঁছবে, তা নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। অভিভাবকেরা কি এর পরেও প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন? ট্রাম্প প্রশাসন অবশ্য এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য এখনও পর্যন্ত করেনি। স্কুলগুলোও যে পুনরায় বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে, এমনও শোনা যাচ্ছে না। আমেরিকায় এই ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অস্থিরতার পেছনে কাজ করছে রাজনীতি। নভেম্বরেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা। সব কিছুই প্রায় স্বাভাবিক এটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরার রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার সামনে ট্রাম্প হাঁটু মুড়ে বসেই পড়েছেন। তাঁর কাছে মার্কিনবাসীরা এখন শুধুই ভোটারসংখ্যা মাত্র, অন্যকিছু নয়--তাই কোনো আবেগ উৎকণ্ঠা অনিশ্চয়তা নিয়ে মার্কিন প্রশাসন ভাবতে চাইছে না।
ভারতবর্ষে আমরাও অনেকাংশেই ঐ একই রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছি। আমাদেরও নির্বাচন আছে--আছে ভোটার সংখ্যা নিয়ে নিয়মিত অঙ্ক কষে যাওয়ার দায়বদ্ধতা--সবকিছু স্বাভাবিক প্রমাণের মরিয়া প্রয়াস--সবকিছু প্রায় স্বাভাবিক প্রমাণ করতে না পারলে নির্বাচনের ক্ষীর ঠেঁটের কাছাকাছি থেকেও অনেক দূরে সরে যেতে পারে। সুতরাং স্কুল-কলেজ খুলতে হবে বৈকি ! আমরা সবাই জানি, তুলনামূলকভাবে শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি বলে তাদের জীবনহানির সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়--কিন্তু উপসর্গহীন শিশুদের করোনা ভাইরাসের বহনের ক্ষমতা ও তা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে কি আমরা সর্বশেষ আপডেট সম্পর্কে খোঁজখবর রাখছি? আমরা কি ভাবতে পারছি--সংক্রমণ বৃদ্ধির এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে ছাত্র-ছাত্রীদের বাইরে পা রাখতে দিলে কতটা কী হতে পারে? এই প্রসঙ্গেই দেখে নেওয়া যাক স্কুলগুলিতে ছাত্র-ছ্রাত্রীদের নিরাপদে থাকার জন্যে কতটা কি ব্যবস্থা রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ এক যৌথ প্রতিবেদনে বলছে, বিশ্বে অন্তত ৮০ কোটি শিশুর জন্য স্কুলে হাত ধোয়ার কোনো ব্যবস্থাই নেই। সেখানে বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পরিসর কতটুকু?
তবু কভিড-১৯ মহামারীর মধ্যেই বিশ্বব্যাপী স্কুল খুলে দেওয়ার তোরজোর চলছে। অনেক দেশে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সীমিত আকারে ক্লাস শুরু করে মহড়াও চলছে। এ সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ নিজেদের উদ্যোগে স্কুলগুলোর জন্য কিছু স্বাস্থ্যবিধি পালনের সুপারিশও করেছে। নিয়মিত হাত ধোয়া, একজন আরেকজনের চেয়ে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বসা, মাস্ক পরা সহ ইত্যাদি। এসব সুপারিশ করা হয়েছে যাতে ভাইরাসটির বিস্তার রোধ করা যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে বাঁধন হারা শিশুদের চরিত্র সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম জ্ঞানগম্যি আছে তাঁরা জানেন, দশটা শিশু একত্রিত হলে তারা পরস্পরের সঙ্গে সেঁটে থাকাতেই পছন্দ করে। খাবার শেয়ার করা, একই বোতল থেকে জল খাওয়া, মাস্ক ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে তীব্র কলকাকলিতে মেতে ওঠার চিরন্তন প্রবণতা থেকে তাদের কে দূরে রাখবে? কতজনকে ঠিকঠাক দূরত্ব পালনে বাধ্য করা সম্ভব?
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘৬০টি দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলোতে কভিড-১৯ এর কারণে উচ্চ স্বাস্থ্য ঝুঁকি আর মানবিক সংকট তৈরি হতে পারে। মহামারীর শুরুর দিকে দেখা যায়, বিশ্বে দুটি স্কুলের মধ্যে একটিতে জল ও টয়লেট সুবিধার অভাব আর চারটির মধ্যে তিনটিতেই হাত ধোয়ার সুব্যবস্থা নেই।’ বিষয়টা কি অনুভূতির গোড়ায় একটুও ধোঁয়া দিতে পারছে? ভেবে দেখুন একবার, বিশ্বব্যাপী ৮১ কোটি ৮০ লাখ শিশু স্কুলে হাত ধোয়ার মতো মৌলিক জল পায় না। এর মধ্যে ৩৫ কোটি ৫০ লাখ শিশু স্কুলে জল পেলেও সাবান পায় না। বাকি ৪৬ কোটি ২০ লাখ শিশু স্কুলে হাত ধোয়ার কেনো সুযোগই পায় না ! প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ৭০ শতাংশ স্কুলেই মৌলিক খাওয়ার জলের ব্যবস্থা রয়েছে, তারপরও বিশ্বব্যাপী স্কুলে মৌলিক খাওয়ার জল পায় না ৫৮ কোটি ৪০ লাখ শিশু ! প্রায় ৭০ কোটি শিশু স্কুলে মৌলিক স্যানিটেশন থেকে বঞ্চিত এবং ২০ শতাংশ কিংবা ৩৫ কোটিরও বেশি শিশু স্কুলে কোনো ধরনের স্যানিটেশন সেবাই পায় না ! এইসব সমস্যার মধ্যে হাইফাই ঝাঁ-চকচকে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলিকে ধরলে হবে না। বৃহত্তর ছাত্রছাত্রীদের কথাই ভাবতে হবে এ ক্ষেত্রে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব ড. টেড্রোস আধানোম গেব্রেইসাস বলেন, ‘পর্যাপ্ত জল, স্যানিটেশন আর স্বাস্থ্যসেবা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত কার্যকর করা দরকার। চলমান কভিড-১৯ মহামারীর সময় নিরাপদে স্কুল খুলে দিতে সরকারগুলোকে কৌশল প্রণয়নে এসব বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতেই হবে।’
২০২০ সালের জুন মাসে ‘হ্যান্ড হাইজিন ফর অল’ কমূর্সচি হাতে নিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ। এটি কভিড-১৯কে সামনে রেখে শিশুসহ সবার জন্যই প্রযোজ্য। বারবার হাত ধোয়া, যথাযথ দূরত্ব মেনে চলা ও মাস্ক পরার পরামর্শের মাধ্যমে স্কুল চত্বরে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে কি স্কুল কর্তৃপক্ষগুলি? স্কুলের ওপরেও নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা ও জীবাণুমুক্তকরণের দায়িত্ব রয়েছে তাদের ওপরেই। পাশাপাশি, শিক্ষকদের জন্য রয়েছে বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষার পরিষেবাও--যেটা স্কুল খোলার আগে ভীষণভাবে আবশ্যিক।
একটি ক্লাসের সব শিক্ষার্থী আগের মতো একসাথে পড়তে পারবেন না। এর পরিবর্তে, ছোট ছোট দল বা ‘কোহোর্ট’ করে তাদের পড়ানো হবে স্কুলে। এছাড়াও, অনলাইন ক্লাসের সুবিধা থাকবে তাদের জন্যেও। কিন্তু অনলাইনে পড়াশোনা তখনই হবে যদি কোনো স্কুলে কোহোর্টে ভাগ করে পড়ানোর মতো যথেষ্ট সংখ্যায় শিক্ষক না পাওয়া যায়।
আমাদের দেশের ৯০% অভিভাবকই জানেন, স্কুলের নামে তাদের আদরের কচি-কাঁচাদের ঠিক কোথায় পাঠাতে বাধ্য হন। দিনের দীর্ঘক্ষণ সময় তারা কোথায় কি ভাবে কাটায়। জানলেও কিছুই করার নেই তাদের--ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের চিন্তাটাই তাদের বাধ্য করে শিশুদের স্কুলে পাঠাতে। কিন্তু প্রাণঘাতী এই সঙ্কটের মুহূর্তে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেও কতটা ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব? তাই খুব সঙ্গত কারণেই সেই গুরুতর প্রশ্ন সামনে উঠে আসছেই--ছেলেমেয়েদের জীবন আগে না ভবিষ্যতের ভাবনা আগে !
যতক্ষণ না টিকা আসছে--সংক্রমণের ঝুঁকি শেষ হয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ শিশুদের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেওয়ার কথা অনেকেই ভাবতে পারছেন না। কারণ তাদের সন্তানসন্ততি তাদের কাছে স্রেফ ভোটার সংখ্যামাত্র নয়--জীবনের যা কিছু স্বপ্ন-ভাবনা-চিন্তা সবই তো তাদের ঘিরেই--তাদের জীবনকে বাজি রেখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা সত্যি সত্যি কতটা ভাবা যায় !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.