Header Ads

রবীন্দ্র জীবনের অন্তিম অধ্যায়

 ছবি, সৌঃ আন্তৰ্জাল
উমা পুরকায়স্থ

রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্তিম অধ্যায় বড় করুণ ও মর্মান্তিক । এতবড় একজন বিশ্ববন্দিত পুরুষ; অসাধারণ যাঁর ব্যক্তিত্ব , অনমনীয় যাঁর দৃঢ়তা; সেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, বার্ধক্যে,পারিবারিক জীবনে এক অতি সাধারণ জরাগ্রস্ত বৃদ্ধের মতোই ব্যবহার পেয়েছেন। সাধারণ মানুষেরও শেষ ইচ্ছা তার সন্তান-সন্ততিরা পূর্ণ করে; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বেলায় তাও হয়নি।

১৯৪০ -এর মাঝামাঝি থেকে কবি প্রায়ই শয্যাশায়ী থাকতেন। নিজের সেবা শুশ্রূষার জন্য কাউকে ভারাক্রান্ত করতে কবি চাইতেন না ; কিন্তু এ ছাড়া উপায়ও ছিল না। দৌহিত্রী 'বুড়ি'র ওপর ছিল তাঁর সেবা -শুশ্রূষার তত্ত্বাবধানের ভার। বুড়িকে খুশি রাখার জন্য ‘দিদিমণি’, ‘চড়ুইপাখি’, ‘নয়নমনি’ ইত্যাদি কত সস্নেহে সম্বোধন করতেন কবি ; কিন্তু তাও অবিশ্রাম নাতনির মুখ ঝামটা সহ্য করতে হতো। কখনো কবির মনে লেগে যেত ; অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিতেন, ‘খাব না’ বলে; আবার আদর করে ডেকে আনতেন আপোষ করতে ।

১৯৪১-এর ১ জানুয়ারি, কবির লেখা, ----" আমার ভ্রমণ এখন এক ঘর থেকে আর এক ঘরে; কখনও ঘর থেকে বারান্দায় ----; সারাদিন কেদারায় বসে বসে তোমাদের সচলতাকে ঈর্ষা করি"----।

৯ জানুয়ারি ১৯৪১ -এ কবির নিজের হাতে লেখা কবিতা । তখন নিজের হাতে লিখতে তাঁর খুব কষ্ট হতো। আঙুলগুলো তাঁর নির্দেশে চলতো না ।
..... "খ্যাতি নিন্দা পারে হয়ে জীবনের এসেছি প্রদোষে

খেয়াতরী অপেক্ষায় বিদায়ের ঘাটে আছি বসে।

নিজের যে দেহটারে নিঃসংশয়ে করেছি বিশ্বাস

জরার সুযোগ পেয়ে নিজেরেই সে করে পরিহাস

সকল কাজেই দেখি ঘটায় বিপর্যয়

আমার কতৃর্ত্ব করে ক্ষয় ।"....

রবীন্দ্রনাথের প্রোষ্টেট গ্ল্যান্ডের উপসর্গ ছিল । প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যেত ; পা ফুলে যেত এবং সঙ্গে থাকতো জ্বর । কবির চিকিৎসকদের মতে অপারেশন ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথেরও তাই মত ; কিন্তু কবি ছিলেন অপারেশনের ঘোর বিরোধী । এ নিয়ে কত মত-বিরোধ। কবি প্রকাশ্যে কোনো প্রতিবাদ করার সাহস এবং মনোবল তখন হারিয়ে ফেলেছেন । তিনি কবিরাজি এবং হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাসী ছিলেন । তাঁর স্নেহধন্যা মৈত্রেয়ীকে তাই একান্তে পেয়ে বলেন , " এ ( অপারেশন ) আমি একবারেই চাইনে। এসেছিলুম গোটা মানুষ, যাবার সময় কি ছেঁড়াখোঁড়া হয়ে যাব? " আবার বলেন , " "যে নিয়মে ঝরে পড়ে শুকনো পাতা , পরিপক্ক ফল ; সেই নিয়মেই আমি জীবনের বৃন্ত থেকে খসে পড়তে চাই। টানা হেঁচড়া করে লাভ কি?"

 মৈত্রেয়ী দেবীও ভাবেন অস্তগামী রবি তাঁর আবর্তন পথে যাবেই ; মিছিমিছি কষ্ট দিয়ে কী লাভ ? তিনি রথীন্দ্রনাথকে কবির মনোভাব জানতে দিলেন; এবং অনেক পীড়াপীড়ি করে কবিরাজি চিকিৎসায় রাজি করালেন।

রবীন্দ্রনাথ যতই বিশ্বকবি, যতই আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন, বিশ্ববরেণ্য হোন না কেন, বার্ধক্যে পারিবারিক জীবনে তিনিও সেই বাঁধা ধরা গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ এক অতি সাধারণ জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ। এক অহেতুক বোঝা!  যাঁর অসামান্য খ্যাতি ঠাকুর পরিবারকে সম্মানের তুঙ্গে নিয়ে তুলেছিল, সেই ঠাকুর পরিবারও বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের প্রতি অনেক ক্ষেত্রেই নির্লিপ্ত ছিল। কাব্যজগতে যিনি রাজাধিরাজ, বিশ্বের দরবারে যাঁর শ্রেষ্ঠআসন; সারা জীবন যিনি পেয়েছেন রাজকীয় মর্যাদা দেশে -বিদেশে; সেই অসাধারণ মনীষীর বার্ধক্যে এমন অবহেলা এবং তাচ্ছিল্য সত্যিই মর্মান্তিক ।
মৈত্রেয়ী দেবীর ভাষায় ...." কিছুদিন থেকেই লক্ষ্য করছি, এ বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেন একজন অসহিষ্ণু রুগ্ন সাধারণ বৃদ্ধ মাত্র! বিশ্ববন্দিত রবীন্দ্রনাথ নন ! রবীন্দ্রনাথ ভৃত্যদের ডেকে পাঠালে ওরা তৎক্ষণাৎ আসা প্রয়োজন মনে করে না; নীচে খাবার ঘরে তুমুল আড্ডা চলছে, তাদের সে খেয়ালই নেই যে রুগ্ন কবি অসহিষ্ণু হচ্ছেন। কবির তদারককারিণী দৌহিত্রী বুড়ির বক্তব্য ....." বৃদ্ধ রুগ্ন ব্যক্তি! অতিব্যস্ত তো হবেনই। তাই বলে কি নৃত্য করতে হবে নাকি?"...... ব্যাপারটা কিছুই না; আত্মীয় স্বজনের কাছে কোনো মহামানবই পুরো সম্মান পেতে পারেন না। আত্মীয় স্বজন তারা যেমন হোক, তাদের অখণ্ড অধিকার আছে, তাদের চেয়ে যে অনেক বড়, তাঁকে ছোট করার, নিগ্রহ করার। কিন্তু আমাদের কাছে তিনি বৃদ্ধ দাদামশাই নন,তিনি রবীন্দ্রনাথ; আমাদের জীবনের ধ্রুবতারা, আমাদের প্রভাতের সূর্য আমাদের গোধূলির অস্তরাগ! অবশ্য এ ভাবটা নানাজন নানাভাবে দেখবে। কিন্তু আমার পক্ষে সহ্য করা কষ্টকর হয়ে উঠেছিল ।" ( স্বর্গের কাছাকাছি , পৃষ্ঠা ২৮)

কবি নিজেও সে অবহেলা অনুভব করতেন মর্মে মর্মে । তাঁর হৃদয়ের তারে তারে চাপা বেদনার সুর গুমরে মরতো।
যে কবি যৌবনের দৃপ্ত প্রাণোচ্ছ্বাসে একদিন গেয়েছিলেন, ..... ' মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর এ ভুবনে ' '.....সেই কবিকে আজ বার্ধক্যের অবহেলা বলতে বাধ্য করায় ......' শেষের গান তো গাইছি , কিন্তু শেষ আসছে কৈ?'...
অভিমানী কবি সুধাকান্তকে ডেকে বলেছিলেন, " আমাকে যারা ভালবাসে, তারা যদি সেই কারণেই এখানে অপমানিত হয়, তাহলে আমি তাদেরে বলে দেব এখানে না আসতে "।

কবি হৃদয়ের পুঞ্জিভূত অভিমান এবং বেদনা ঝরে পড়েছিল কথাগুলোতে । তাঁর ভাললাগা, ভালবাসা, ইচ্ছা অনিচ্ছা,  রুচি, অরুচি নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামায় না; দায় সারা কাজ করে যায় সবাই ।
কবিরাজি চিকিৎসায় রবীন্দ্রনাথের কিছুটা উন্নতি হয়েছিল কিন্তু কবিরাজকে দু'সপ্তাহের বেশি সময় দেওয়া হলো না । মৈত্রেয়ী দেবী কবিরাজকে নিযুক্ত করে মংপু ফিরে যাবার এক সপ্তাহ পরেই ডাঃ বিধান রায় এবং ডাঃ ললিত বাড়ুয্যের পরামর্শে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ রুগ্ন হীনবল কবিকে কলকাতা নিয়ে আসেন অপারেশনের জন্য। কবির মত-অমতের ধারই ধারলেন না ওঁরা, অপারেশনের দিনও ঠিক হয়ে গেল। কাউকে জানানো হলো না কথাটা। যাতে জনসাধারণ কোনো চাপের সৃষ্টি না করে, তাই কোনো প্রচার মাধ্যমে অর্থাৎ রেডিও বা সংবাদপত্র কোনো কিছুতেই এ-খবর দেওয়া হলো না; এমনকি রবীন্দ্রনাথের অকৃত্রিম শুভাকাঙ্ক্ষীরাও যথাসময়ে খবর পাননি যে কবির অপারেশন হচ্ছে; অথবা কবির অবস্থা সংকটজনক । কবি নিশ্চুপ! সারা জীবনই,পারিবারিক সমস্যায় নিজের নীতিবিরোধী, ইচ্ছাবিরোধী অনেক কার্যকলাপ মেনে নিয়েছেন;আবার অন্তর্দ্বন্দ্বেও জর্জরিত হয়েছেন। আজও তাঁর ইচ্ছাবিরোধী এ কষ্টভোগ। কিন্তু কবি নির্বাক;কারণ তিনি জানেন, তিনি অক্ষম,পরমুখাপেক্ষী; তাই তাঁর মত-অমত এখানে তুচ্ছ।
কবিকে অজ্ঞান না-করে অপারেশন করা হয়েছিল, কবি ব্যথা প্রকাশ করেছিলেন; কিন্তু চিকিৎসকরা ওটাকে কাল্পনিক বা আনুমানিক ব্যথা বলেছেন। পরের দিন থেকেই অবস্থা খারাপের দিকে যায়; ৭ আগস্ট ২২ শ্রাবণ কবির মহাপ্রয়াণ
কবির ভক্তসাধিকা মৈত্রেয়ী দেবীর আক্ষেপ, কেন তাঁকে অপারেশনের তারিখ জানানো হলো না; তিনি শেষ দেখা দেখতে পেলেন না।
..."কবিরাজকে তো একমাসও সময় দেওয়া হলো না; এমনই অপারেশন হল,সাতদিনও টিকলেন না! রবীন্দ্রনাথের শরীরের উপর সেই পরীক্ষা চালাবার জন্য দুজন ডাক্তারই বা এত মেতে উঠলেন কেন? কী দরকার ছিল তাঁকে এ কষ্ট দেবার? কেন তাঁর ইচ্ছা বিরোধী কাজ করা হলো?"....... মৈত্রেয়ীর আক্ষেপ থেকে গেল সারাজীবন ।

কবির শেষ ইচ্ছা ছিল, "তুমি যদি আমার সত্যি বন্ধু হও, তাহলে দেখো, আমার যেন কলকাতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে ' জয় বিশ্বকবি কি জয়' ' জয় রবীন্দ্রনাথের জয় ' ' বন্দেমাতরম' ইত্যাদি জয়ধ্বনির মধ্যে সমাপ্তি না ঘটে। আমি যেতে চাই শান্তিনিকেতনের উদার মাঠের মধ্যে উন্মুক্ত আকাশের তলায়, আমার ছেলেমেয়েদের মাঝখানে; যেখানে জয়ধ্বনি থাকবে না, উন্মত্ততা থাকবে না। থাকবে শান্ত,স্তব্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রকৃতিতে মানুষে মিলে দেবে আমাকে শান্তির পাথেয়। আমার দেহ শান্তিনিকেতনের মাটিতে মিশে যাবে, এই আমার আকাঙ্ক্ষা। চিরকাল, জপ করেছি 'শান্তম্'। এখান থেকে বিদায় নেবার আগে যেন সেই ' শান্তম ' মন্ত্রই সার্থক হয়। তোমাকে সব বলে রাখলুম আগে থেকে ।"

[ 'বাইশে শ্রাবণ ' নির্মল কুমারী মহলানবীশ । শ্রোতা এখানে নির্মল কুমারী  (রানীদি)]
 কিন্তু কবির সে ইচ্ছাও পূর্ণ হয়নি ;  এবং এ-ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্য ঠাকুর পরিবারের বা শান্তিনিকেতনের কর্তৃপক্ষের কোনো তৎপরতার উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না। তাছাড়া কবির শেষ ইচ্ছার নিতান্ত বিরুদ্ধে অদম্য জনতার উন্মত্ত কোলাহল এবং জয়ধ্বনির মধ্যেই কলকাতার নিমতলার শ্মশানে  কবিদেহের চিরসমাপ্তি ঘটে। কলকাতার জনসাধারণ সেদিন উন্মত্তবৎ আচরণ করেছিল, কারণ রবীন্দ্রনাথের চূড়ান্ত অসুস্থতা, অপারেশন, সংকটজনক অবস্থা কোন কিছুরই খবর কোনও প্রচারমাধ্যমে দেওয়া হয়নি;তাই আকস্মিক ভাবে মৃত্যুসংবাদ জনতাকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ পিতার মুখাগ্নি করার সুযোগও পাননি।

রবীন্দ্রজীবনের অন্তিম অধ্যায়  তাই অত্যন্ত দুৰ্ভাগ্যজনক,যা এতকাল পরেও মনকে ভারাক্রান্ত করে; প্রশ্ন জাগে ....কেন এ মহাকবির অন্তিম ইচ্ছা পূর্ণ করা হলো না?



সহায়ক পুস্তক: -' স্বর্গের কাছাকাছি ' মৈত্রেয়ীদেবী

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.