Header Ads

শিলঙের 'নিখিলদা'র আসাম বুক এজেন্সির বই পড়ার কথা

 -জোনাকী স্বামী-

"একটি বই বিশ্বের একটি সংস্করণ। আপনি যদি এটি পছন্দ না করেন তবে এটিকে উপেক্ষা করুন বা বিনিময়ে আপনার নিজস্ব সংস্করণ সরবরাহ করুন।" - সালমান রুশদি

বই পড়া এক নতুন দিগন্তের দিশারী। যা আমাদেরকে এক নুতন পৃথিবী ও সময়কালে নিয়ে যায়। বই আমাদের স্মৃতি রোমন্থন করার আনন্দ দেয়। বই পড়া আপনার মন এবং আত্মাকে সন্তুষ্টি যোগায় । বই পড়ার মাধ্যমে শব্দভাণ্ডার তৈরি থেকে শুরু করে স্ট্রেস হ্রাস, বয়সের সাথে সম্পর্কিত স্মৃতিশক্তি অবনতি রোধ করা এবং সহানুভূতির ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে।
বই পড়ার এ দিকগুলির সংমিশ্রণ মেঘালয়ের মনমুগ্ধকর রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে আইকনিক বইয়ের দোকান 'অসম বুক এজেন্সি' সম্পর্কে আমাদের নস্টালজিক করে তোলে। প্রয়াত নিখিল চন্দ্র দত্ত চৌধুরী  জেল রোডে ১৯৫৬ সালের ১ জানুযারী  এ বইয়ের দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেন।

তিনি ছিলেন সদা হাস্যময় এক  পরিশ্রমী ব্যক্তিত্ব। সর্বোপরি পুরোপুরি নিপাট এক  ভদ্রলোক। এ স্টলটি নির্ভরযোগ্য বই সরবরাহের কেন্দ্র হিসাবে হাজার হাজার উদ্বিগ্ন পাঠকের চাহিদা পূরণ করেছে।

বইয়ের স্টলটি শিলংয়ের এক বৌদ্ধিক কেন্দ্র হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছিল যেখানে  নিয়মিতভাবে রাজনৈতিক থেকে শুরু করে শিক্ষাগত বিভিন্ন বিষয়ে বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা হতো । সমাজের দৈনন্দিন বিষয় নিয়েও চলতো বৌদ্ধিক আলোচনা । শিক্ষক, অধ্যাপক, আইনজীবি, সরকারী আমলা এবং সমাজ সংস্কারকসহ অনেকই এই বুক স্টলের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন।
নিখিল চন্দ্র দত্ত চৌধুরী, বইয়ের দোকান মালিক, ছিলেন শিক্ষার এক প্রবল অনুরাগী। তিনি ছিলেন এক সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা এক উদ্যমী লোক । শিক্ষার প্রতি তাঁর থাকা আবেগ তাকে অল্প বয়সে থেকেই  সমাজের কল্যাণের জন্য এক বুক ষ্টল প্রতিষ্টা করতে অনুপ্রাণিত করেছিল । বইয়ের সরবরাহকারী হিসাবে জ্ঞানশিক্ষার প্রসার করতে সে সময়ের শিলংয়ের কমপক্ষে দুই প্রজন্মকে সহায়তা করেছিলেন।

সর্বস্তরের লোকদের, বিশেষত সমাজের নিম্নবিত্তদের সহায়তা করার তিনি সর্বদা যত্নশীল ছিলেন। এক পরোপকারী মনোভাবের সাথে, তিনি কোনও বিনিময়ের প্রত্যাশা ছাড়াই, একেবারে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক এবং অন্যান্য রেফারেন্স বই দিয়ে অনেককে সহায়তা করেছিলেন। তিনি বহু দুস্থ বিদ্যার্থীদের স্কুলে পরীক্ষার জন্য ফি প্রদান করেছিলেন দরিদ্র নারায়ণের সেবা ভেবে। শিলংয়ের অনেক পরিবার তার এরূপ উদারতা এখনও স্বীকার করে।
   
তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে একজন বিদ্যানুরাগী। মনীষীদের জীবনী থেকে মূল্যবান কথাগুলো নিজের জীবনে প্রয়োগ করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। তিনি কিছু বইও রচনা করেছিলেন, বিশেষত ব্যাকরণও বেসিক গণিতের উপর যেগুলো ছিল খুব জনপ্রিয় । এ বইগুলি শিলং এর আশেপাশের অনেকগুলি সরকারী এবং বেসরকারী বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে বহুল প্রচলিত ছিল ।
দত্ত চৌধুরী প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড শিলংয়ের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পরিচালনা কমিটির সদস্য হিসাবে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি প্রয়াত হন ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০০১।
চৌধুরির পুত্র ডিজিটাল যুগে বই পড়ার অভ্যাসের অবক্ষয় থাকা সত্ত্বেও উত্তরাধিকার সূত্রেপ্রাপ্ত প্রতিষ্টানটি চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। দত্ত চৌধুরীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত পাঠকদের মন চিত্তাকর্ষক বইয়ের দোকানটির স্মৃতি কখনই ম্লান হবে না, যিনি শিলংয়ের লোকদের কাছে অতি আপন 'নিখিলদা' নামে পরিচিত।
ডিজিটাল যুগে বই পড়ার অভ্যাসটি বিপদের সম্মুখীন। বই পড়ার আর ধ্রুপদী অভ্যাসের নয়। বরং, আঙুলের ডগায় ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সহজে অ্যাক্সেসের করা ই-বুকের বেশি জনপ্রিয়। আক্রান্ত আজ বই পড়ার অভ্যাস ।
বই পড়ার অভ্যাস যে কোনও প্রজন্মের সামগ্রিক বৌদ্ধিক বিকাশ প্রক্রিয়ার প্রধান উপাদান। এ অভ্যাসটি জ্ঞান অর্জন ও নিজের মনকে বিনোদন করার এক অন্যতম মাধ্যম ।
বই পড়া মনকে কল্পনার জগৎকে প্রসারিত করে করে। এ ধ্রুপদী অভ্যাসকে ডিজিটাল যুগে বাঁচিয়ে রাখা এক বৃহৎ চ্যালেঞ্জ।
মানুষের বুদ্ধি এবং জ্ঞানের পিপাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের 'নিখিলদা'র মতো বই পড়ার পিছনের দর্শনের প্রচার ও অনুশীলন করা অতি প্রয়োজন। বই পড়ার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের চেতনা তাঁর চিরন্তন আত্মার সাথে আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকুক।

[লেখক প্রয়াত এন সি দত্ত চৌধুরী-র কনিষ্ঠ কন্যা। তিনি বিবাহসূত্রে শিলচর নিবাসী ও একজন বিজ্ঞান শিক্ষিকা।]

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.