Header Ads

ওদালবাক্রায় করোনায় মৃত বাবার সৎকার হয়ে গেল, জানলই না ছেলেরা


অরিজিৎ আদিত্য, গুয়াহাটি : টিভিতে শুনেছেন তাঁদের বাবা মারা গেছেন। শুনেছেন হিমন্তবিশ্ব শর্মা নাকি বুধবার সকালে টুইট করে জানিয়েছেন মঙ্গলবার রাত দুটো থেকে বুধবার সকাল পাঁচটার মধ্যে গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজের কোভিড ওয়ার্ডে চারজনের মৃত্যু হয়েছে, এর  মধ্যে তাঁদের বাবাও রয়েছেন। কিন্তু বুধবার পেরিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল হরি প্রসাদ মণ্ডলের ছেলেদের এখনও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছুই জানানো হয়নি। তার চেয়েও ভয়ংকর খবর, কামরূপ মেট্রোর অতিরিক্ত জেলাশাসককে ফোন করলে তিনি বলেছেন, হরি প্রসাদবাবুকে বুধবার সকালেই দাহ করা হয়ে গেছে।  বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গুয়াহাটির ওদালবাক্রা লিংক রোডের বাড়ি থেকে মোবাইলে  এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হরি প্রসাদের ছোট ছেলে সুরজিত বলেন, আমাদের বাবার মৃতদেহ আমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হোক। প্রশাসন কেন চুপ করে রয়েছে, কারা আমাদের বাবাকে দাহ করেছে, আমরা তাও জানতে পারব না? 
রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী হরিপ্রসাদ মণ্ডলের বেশ কিছুদিন ধরেই বুকে কফ, শ্বাসকষ্টও ছিল। এক জুলাই লালগণেশ এলাকার সেন্টারে তাঁর সোয়াব টেস্ট করানো হয়। দুদিন পর তাঁর অবস্থার আরও অবনতি হয়। কিন্তু সোয়াব টেস্টের রিপোর্ট তখনও আসেনি। উপায় না দেখে তাঁর দুই ছেলে উৎপল ও সুরজিত তাঁকে একটি নার্সিং হোমে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে হরি প্রসাদকে ভর্তি করা হয়নি। নার্সিং হোম থেকে বলা হয় কোভিড টেস্ট না করিয়ে আনলে ভর্তি করা যাবে না। তিন জুলাই সুরজিতরা তাঁদের বাবাকে জিএমসি-তে নিয়ে যান। সেখানে তাঁর ইনস্ট্যান্ট রেপিড টেস্ট করানো হয়। রিপোর্ট নেগেটিভ। সুরজিতরা ফের নার্সিং হোমে নিয়ে যান হরিপ্রসাদবাবুকে। কিন্তু তাঁর অবস্থা দেখে এবারও নার্সিং হোম তাঁকে ভর্তি করতে রাজি হয়নি। উপায়ান্তর না দেখে ছয় জুলাই সুরজিতরা তাদের বাবাকে ফের মেডিক্যালে নিয়ে আসেন। হরিপ্রসাদবাবুর ফের কোভিড টেস্ট হয় এবং এবারও রিপোর্ট নেগেটিভ। নিউমোনিয়ার রোগী হিসেবে তাঁকে এবার জেনারেল ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।
সুরজিত জানান, এরপর থেকেই শুরু হয় নাটক। সাত জুলাই তিনি যখন বাবার সঙ্গে  মেডিক্যালে তখন লোকাল থানা থেকে ফোন করে জানানো হয়, হরিপ্রসাদ মণ্ডলের সোয়াব টেস্টের ফল পজিটিভ এসেছে, তাঁকে মেডিক্যালের কোভিড ওয়ার্ডে ভর্তি করাতে হবে। থানাকে জানানো হয় যে হরিপ্রসাদ এখন জিএমসিতেই আছেন। সাত জুলাই রাতেই হরি প্রসাদবাবুকে কোভিড ওয়ার্ডে শিফট করা হয়। সুরজিতের দাবি, ঝুঁকি নিয়ে তিনি নিজেও বাবার সঙ্গে কোভিড ওয়ার্ডে ঢুকেছিলেন, রাত বারোটা অবধি সেখানে ছিলেনও। হরি প্রসাদবাবু নিজে হেঁটে টয়লেটেও গেছেন। রাত বারোটা নাগাদ বাড়ি ফেরার আগে বাবার হাতে মোবাইল গুঁজে দিয়ে এসেছিলেন।
পরদিন বুধবার সকালে এক আত্মীয় ফোন করে জানান, টিভিতে দেখাচ্ছে হরিপ্রসাদ মণ্ডল মারা গেছেন। স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী টুইট করে জানিয়েছেন। আকাশ ভেঙে পড়ে উতপল- সুরজিতদের বাড়িতে। ততক্ষণে ওদালবাক্রা লিংক রোড কনটেনমেন্ট জোন হয়ে গেছে, ফলে বেরোতেও পারছেন না। বাবার মোবাইলে বারবার ফোন করা হয়। সুইচড অফ। জিএমসি সুপার অভিজিৎ শর্মাকে ফোন করা হয়। সুরজিতের দাবি, তিনি ফোন ধরেননি। শেষমেশ বিকেল নাগাদ নম্বর জোগাড় করে এডিসি (স্বাস্থ্য) বিপুল দাসকে ফোন করেন সুরজিত। কিন্তু এডিসির ভাষ্য শুনে তাঁদের পায়ের নিচের মাটিই যেন সরে যায়৷ এডিসি জানান, হরি প্রসাদ মণ্ডলকে ইতিমধ্যেই দাহ করা হয়ে গেছে। 
তাঁদের কেন জানানো হল না, সুরজিতদের এ প্রশ্নের উত্তরে এডিসি দাস জানান, এই দায়িত্ব জিএমসির। 
বৃহস্পতিবার সুরজিত বলেন, পুরো বিষয়টি আমাদের বুদ্ধির বাইরে। তাঁর কথায়, "আমাদের বাবার বয়স হয়েছিল, তিনি অসুস্থ ছিলেন, যদিও মঙ্গলবার রাত অবধি হাঁটাচলা করেছেন তিনি। তবু ধরে নিচ্ছি, নিউমোনিয়া হয়েছিল, কোভিডও ধরা পড়েছিল, তিনি মারা যেতে পারেন৷ এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রশাসন তাঁর মৃত্যুর খবর পরিবারকেও জানাবে না, এটা হয় না কি?"
সুরজিতের প্রশ্ন, কারা আমার বাবাকে দাহ করল? কোথায় দাহ করা হলো? দাহ করা হয়েছে, না কি কবর দেওয়া হয়েছে? কেন আাবার মোবাইলের সুইচ অফ? কেন প্রশাসন কিছু জানাচ্ছে না আমাদের? রেপিড টেস্টের রিপোর্ট দু দুবার নেগেটিভ আসার পর ছয় দিন আগে নেওয়া টেস্টের ফল কীভাবে পজিটিভ আসে? তাহলে কি রেপিড টেস্টের রিপোর্ট ভুল ছিল?
বাবার মৃত্যুর কোনও খবর আনুষ্ঠানিকভাবে পাননি, দাহ হয়েছে কি না, সেটাও প্রশাসন  জানায়নি। এই অবস্থায় শাস্ত্র অনুযায়ী অশৌচও পালন করতে পারছেন না তাঁরা। কনটেনমেন্ট জোন, ফলে বাড়ি থেকে বেরোতেও পারছেন না।
সুরজিত বলেন, আমরা কিছু জানি না, আমাদের বাবা যদি মারাই গিয়ে থাকেন তাহলে দেহ আমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হোক। অন্তত সরকার কিছু তো একটা জানাক আমাদের যে আমাদের বাবার আসলে হয়েছেটা কী!
এডিসি বিপুল দাস ও জিএমসি সুপারকে পত্রিকার পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার বারবার ফোন করা হয়েছে। ম্যাসেজ পাঠানো হয়েছে। তাঁরা তা দেখেছেন। টুইটে বিষয়টি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মাকেও জানানো হয়েছে। রাত অবধি কোনও জবাব পাওয়া যায়নি। 
সরকারের জবাবের প্রতীক্ষায় হরিপ্রসাদের গৃহবন্দি ছেলেরাও। দুদিন পেরিয়ে গেছে, অশৌচপালনই এখনও অবধি শুরু করতে পারেননি তাঁরা।

দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গের সৌজন্যে

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.