Header Ads

ভারতকেশরী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে আজ জাতি স্মরণ করেছে

অধ্যাপক প্রশান্ত চক্রবর্তী

ভারতকেশরী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে আজ জাতি স্মরণ করেছে। ৬ জুলাই তাঁর পবিত্র জন্মদিন। 
   ড. শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে নানা স্তরে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কনিষ্ঠ উপাচার্য রূপে তাঁর ভূমিকাটি স্মর্তব্য। তিনি তাঁর স্বনামধন্য পিতা স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। 
    আজকের দিনে বাংলা ভাষাচর্চাকারীরা গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করতে বাধ্য। কেননা~আজ যে আধুনিক বাংলা বানান আমরা ব্যবহার করি~এর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ড. শ্যামাপ্রসাদের উদ্যোগেই হয়েছিল। 
    ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে(আমি 'খ্রিষ্ট' বানেনের পক্ষে। কেননা এটি বাংলা শব্দ। ইংরেজি নয়) কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথকে পার্ট টাইম প্রফেসর হিসেবে পাঠদান করার আমন্ত্রণ জানায়। ওই পদটি ছিল " রামতনু লাহিড়ি অধ্যাপক"। এম এ স্তরে কবি কিছু বক্তৃতা দেবেন~আর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যয়ন গবেষণা-চর্চার ক্ষেত্রে সাহায্য করবেন পরামর্শ দেবেন। এই সময় ড. শ্যামাপ্রসাদ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী সেনেট/সিন্ডিকেট সদস্য। স্যার আশুতোষের অকস্মাৎ প্রয়াণের পর পিতার শূন্যস্থানে তাঁকে নেওয়া হয়। তবে তার আগেই তিনি ফেলো নির্বাচিত হন। আশুতোষের প্রয়াণের বছরখানেকের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে শ্যামাপ্রসাদের গভীর অংশগ্রহণে মুগ্ধ হয়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তাঁকে লিখেছিলেন~"Universityর সাধারণ কাজে তুমি দেখি বাপকা বেটা হইয়াছ। কেননা এত অক্লান্ত পরিশ্রম ও স্বার্থত্যাগ কেহই করিতে রাজী নয়।" 
   রবীন্দ্রনাথকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়~সেটারও মুখ্য উদ্যোগী তিনিই ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। 
   আসলে "রামতনু লাহিড়ি অধ্যাপক" পদ থেকে দীনেশচন্দ্র সেন অবসর গ্রহণ করায় ১৯৩২-এর ১১ জুলাই উপাচার্যের সভাপতিত্বে সিলেকশন কমিটির মিটিং বসে। উপাচার্য "বাগীশ্বরী"-অধ্যাপক স্যার হাসান সুরাবর্দি। ইনি কলকাতা দাঙ্গার মূল হোতা ও মৌলবাদী মুসলিম লিগ নেতা কুখ্যাত হোসেন সুরাবর্দির অগ্রজ। ওই কমিটির মূল সদস্য ড. শ্যামাপ্রসাদ। অন্যদের মধ্যে প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সেন, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ। কমিটি সিদ্ধান্তটি ছিল এরকম~"The Commitee feels that in the interest of the University and of the promotion of the study of Bengali Language and Literature, it would be eminently desirable to associate Dr. Rabindranath Tagore with the University as Professor on special terms. The Committee understands that it would be possible to set apart out of Ramtanu Lahiri Fund a sum of Rs. 5000 per year to be paid Dr. Tagore as honorarium."
    ১৯৩২-এর ১ আগস্ট থেকে দুবছরের জন্য এটি কার্যকরী হয়।
    রবীন্দ্রনাথ অধ্যাপকের দায়িত্ব গ্রহণ করেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বড় রিসার্স প্রজেক্টের প্রস্তাব দেন। ১. বাংলা বানানের জটিলতা দূর করে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি এবং ২. বাংলায় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা নির্মাণ ও সংকলন করা।   
   বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হাসান সুরাবর্দি পুরো বিষয়টিতে ড. শ্যামাপ্রসাদের ওপরই নির্ভর করেছিলেন। কেননা~এই বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে শ্যামাপ্রসাদ সুযোগ্য ছিলেন সবদিক থেকে। শ্যামাপ্রসাদ ইংরেজি অনার্সের ছাত্র ছিলেন। বিএ-তে তিনি ইংলিশ অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে সর্বোচ্চ স্থান দখল করেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে~তিনি আইএ এবং বিএ~দুই পরীক্ষাতেই বাংলা বিষয়ে প্রথম স্থান অর্জন করে বঙ্কিমচন্দ্রের নামাঙ্কিত রৌপ্য ও স্বর্ণপদক পারিতোষিক পেয়েছিলেন। 
    বিশ্ববিদ্যালয় কবির প্রস্তাব অনুমোদন করে। "বাংলা বানানচিন্তার বিবর্তন" বইয়ে ড. মিতালি ভট্টাচার্য লিখছেন~ "শ্যামাপ্রসাদ তখনও উপাচার্য না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ তিনিই পরিচালনা করেন। রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবও তিনি অনুমোদন করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এ কাজের প্রাথমিক দায়িত্ব গ্রহণের জন্য রবীন্দ্রনাথকেই অনুরোধ করেন।"(পৃ. ১৪৩)
    যা হোক, কবির বয়স তখন একাত্তর। তাই শান্তিনিকেতনে এই প্রজেক্টের সহায়ক রূপে বাংলা ভাষা-সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে এম এ পাশ ছাত্র বিজনবিহারী ভট্টাচার্যকে নিযুক্ত করা হয়।
    ১৯৩৪-এর ১ আগস্ট কবির সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তি শেষ হয়। আর ৮ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রূপে দায়িত্ব গ্রহণ করেন~ড. শ্যামাপ্রসাদ। বয়স মাত্র ৩৩। সারা বিশ্বে এটি তখন একটি রেকর্ড। এত কম বয়সে কেউ তখনও উপাচার্য হননি। 
    উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়েই শ্যামাপ্রসাদ বাংলা বানান ও পরিভাষা সমিতি  গঠন করেন ১৯৩৫-এ। স্বনামধন্য রসসাহিত্যি 'পরশুরাম' রাজশেখর বসু ছিলেন সমিতির সভাপতি। ১৯৩৬-এ (৮ মে) এই সমিতির বানান নীতির প্রথম খসড়া প্রকাশিত হয়। এরপর দুটো সংশোধনের মধ্য দিয়ে ১৯৩৭-এর ২০ মে তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ প্রথম সই করেন। এরপর ভাষাচার্য সুনীতিকুমার, শরৎচন্দ্র প্রমুখ বিখ্যাত মানুষ সম্মতি প্রদান করে স্বাক্ষর করেন। এখনও বিভিন্ন বাংলা অভিধানের পেছনে এই নিয়ম ছাপা হয়। সেদিন যদি ড. শ্যামাপ্রসাদ উদ্যোগী না-হতেন~তাহলে বাংলা বানান ও পরিভাষার এই নীতিনির্ধারণ অনেকটাই পিছিয়ে যেত~এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই তো বলেছি~বাঙালি জাতি ড. শ্যামাপ্রসাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে যুগ যুগ। 
•••
   রবীন্দ্রনাথকে এর পরেও ১৯৩৭-এ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে ভাষণ দানের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কবি শর্ত দিলেন~তিনি বাংলায় ভাষণ দেবেন। শ্যামাপ্রসাদ কবির এই শক্ত মেনে ইতিহাসসৃষ্টি করেছিলেন। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়~ওই সমাবর্তন বর্জন করেছিল মুসলমান ছাত্ররা। এতে কবির প্রতি চরম অসৌজন্য তৈরি হয়। (দ্র. "শ্যামাপ্রসাদ : বঙ্গবিভাগ ও পশ্চিমবঙ্গ"~ড. দীনেশচন্দ্র সিংহ, পৃ. ৫১)। কিন্তু উপাচার্য তো স্বয়ং বাঘের বাচ্চা শ্যামাপ্রসাদ। ১৯৩৭-এর ১৭ ফেব্রুয়ারি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীক্ষান্ত ভাষণ বাংলায় প্রদান করেন রবীন্দ্রনাথ।
    মুসলমান ছাত্ররা কেন ওই সমাবর্তন বর্জন করেছিল~তার কারণটিও ভারতীয় সাম্প্রদায়িক ছাত্ররাজনীতির বীজ রূপে গণ্য হবে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীকচিহ্নটি ব্রিটিশ রাজশক্তির দম্ভ ও ঔদ্ধত্যের নমুনা ছিল বলেই ওটা পাল্টানোর দাবি ওঠে তখন। অনেক আলোচনা~ সভাসমিতি~বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে পদ্মফুলের ওপর বাংলায় 'শ্রী' অক্ষর লেখা একটি প্রতীক গৃহীত হয়। এবং সেটি প্রচলিতও হয়। শরিয়তি মোল্লাপার্টি মুসলিম লিগের তখন চূড়ান্ত বাড়বাড়ন্ত(নইলে কি আর ছেচল্লিশের দাঙ্গা হয়!)। এই গোঁড়া ইসলামিরা প্রবল আপত্তি তোলে~পদ্মফুল আর 'শ্রী' নাকি ইসলামবিরোধী। এতে নাকি পৌত্তলিকতার গন্ধ আছে। সেই সময় এরাই 'বন্দেমাতরম' নিয়েও একই অভিযোগ তুলেছিল (দুর্ভাগ্যের বিষয়~আজও হায়দরাবাদী মৌলবাদী ওয়েইসির মতো লোকেরা বন্দেমাতরম বা ভারতমাতা-র মধ্যে পৌত্তলিকতার গন্ধ শোঁকে! )। কিন্তু ওই মৌলবাদীরা ভুলে গেছিল~পদ্মফুল ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক~চিন্তাচেতনার দ্যোতক। মধ্যযুগের সমন্বয়বাদী ইসলামি ঘরানা সেটা স্বীকারও করেছিল। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ~নবাব হোসেন শাহর আমলে নির্মিত বিখ্যাত সোনা মসজিদে মূল প্রবেশ পথের অলঙ্করণে পদ্মপাতায় আরবি ভাষায় 'আল্লাহ' শব্দটি লেখা হয়েছিল।(দ্র. 'হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি'~গোলাম মুরশিদ, পৃ. ৪১)। আজকেও ভারতে যারা পদ্মফুল দেখলেই ক্ষেপে যায়~তাদেরও উচিত এই তথ্যটি মনে রাখা।
   যা হোক~ড. শ্যামাপ্রসাদের উপাচার্য হিসেবে তখন শেষ সময়। ১৯৩৮-এ তিনি উপাচার্যের দায়িত্ব থেকে অবসর নেন~এবং ক্রমশ প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। আর তাঁর অবসরের সুযোগ নিয়ে তোয়াজ ও তোষণের নীতিও শুরু হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে স্থিরতা আনার স্বার্থে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদ্মফুলে 'শ্রী' প্রতীকটি অপসৃত হয়। 
•••
আমার বিশ্বাস~মৌলবাদের অমন জঘন্য রূপ আর তোয়াজ-তোষণের অমন ঘৃণনীয় কাণ্ডগুলোই পরবর্তীকালে জননেতা ভারতকেশরী শ্যামাপ্রসাদের জন্ম দিয়েছিল।
•••
তথ্যঋণ~
১. "মহাজীবন শ্যামাপ্রসাদ"~অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায়। 
২. "শ্যামাপ্রসাদ : বঙ্গবিভাগ ও পশ্চিমবঙ্গ"~ড. দীনেশচন্দ্র সিংহ।
৩. "বাংলা বানানচিন্তার বিবর্তন"~ড. মিতালি ভট্টাচার্য।
৪. "শতবর্ষের আলোয় শ্যামাপ্রসাদ"~সংকলন ও সম্পাদনা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি স্মারক সমিতি।
৫. "বাংলা পরিভাষা : ইতিহাস ও সমস্যা"~মনসুর মুসা।
৬. "বানান বিতর্ক"~সংকলন ও সম্পাদনা~নেপাল মজুমদার।
৭. "প্রবন্ধ পঞ্চাশৎ : প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ"~অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য।
৮. "হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি"~গোলাম মুরশিদ।
•••
কটন বিশ্ববিদ্যালয়,
গুয়াহাটি
৬-৭-২০

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.