Header Ads

ডাক্তারদের সামনে কঠিন পরীক্ষা : কার চিকিৎসা আগে !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

‘ট্রিএজ’ শব্দটি ফ্রেঞ্চ ট্রিয়ার থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘বাছাই করা’। এই ধারণা জনপ্রিয় হয়েছিল সতেরো শতকে ফরাসি বিপ্লবের সময়। যখন নেপোলিয়ান বোনাপার্ট মিসর ও সিরিয়ায় অভিযানের সময় বিপুলসংখ্যক সৈনিক আহত হয়েছিল।
ফ্রেঞ্চ মিলিটারির একজন সার্জন ডমিনিক জেন ল্যারি সে সময় হতাহতের বাছাই করার ধারণা (চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই টার্ম দ্বারা কাকে আগে চিকিৎসা করা হবে সেটি বোঝানো হয়) নিয়ে সামনে এলেন। এই কাজ করা হয় সৈনিকদের আঘাত ও পদমর্যাদার ভিত্তিতে।

দুই শতাব্দী পরও জরুরি চিকিৎসার ক্ষেত্রে ট্রিএজের লক্ষ্য
একই থাকে : সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তির জন্য সর্বাধিক ভালো
করা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশে এখনও করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিতরা কীভাবে ওই নীতিতে স্থির থাকতে পারবেন তা নিয়ে সংগ্রাম চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ১৮-টি স্টেটকে হোয়াইট হাউজ টাস্ক ফোর্স দ্বারা বর্তমানে ‘রেড জোন’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ গত সপ্তাহে প্রতি এক লাখ মানুষে ১০০ জন মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। পাশাপাশি ১৪টি স্টেটে বর্তমানে আইসিইউ ধারণক্ষমতা ৭০ শতাংশের বেশি হয়ে গেছে।
টেক্সাস তাদের কোন হাসপাতালে রোগীর ধারণক্ষমতা পার হয়ে গেছে তা জানানো বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এই চিহ্নগুলো আমাদের জানায় অতিরিক্ত সংক্রমণের কথা। হিউসটনের একটি শিশু হাসপাতাল এখন বয়স্ক রোগীদের ভর্তি করাচ্ছে এবং ইউএস মিলিটারি সরকারি ডাক্তারদের সহায়তায় মেডিকেল স্টাফ পাঠিয়েছে। এই সপ্তাহে টেক্সাসের একটি কাউন্টি ঘোষণা করে জানিয়েছে, তাদের কভিড-১৯ ইউনিট রোগীতে পূর্ণ হয়ে গেছে এবং অন্যান্য উপচে পড়া হাসপাতালে স্থানান্তর করাও কঠিন হয়ে পড়েছিল। স্টার কাউন্টি মেমোরিয়াল হাসপাতালের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিতে বলা হয়, আমাদের ডাক্তারদের এ সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে যে কে চিকিৎসা পাবে এবং কাদের প্রিয়জনদের পাশে মৃত্যুর জন্য বাড়িতে পাঠানো হবে।
অ্যারিজোনার আইসিউইর বেড ৯০ শতাংশ ভর্তি হয়ে গেছে, মর্গগুলোতে আর জায়গা নেই এবং কাউন্টিগুলো রেফ্রিজারেটেড ট্রাক অর্ডার দিচ্ছে বাড়তি লাশ সংরক্ষণের জন্য। তবে এ সংকটের মাঝেও অ্যারিজোনা প্রথম স্টেট যারা ক্রাইস কেয়ার স্ট্যান্ডার্ডসের বিধান জারি করে। এটা করা হয় যখন স্বাস্থ্যসেবা সিস্টেমগুলো এমন এক বিপর্যয়ে পড়ে যখন তারা রোগীদের সাধারণ সেবা পর্যন্ত দিতে পারে না।
এ অবস্থা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্থান ঘটায়, কীভাবে রোগীর সেরা সেবা দেয়া যায় যখন যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ থাকে না এবং ট্রিএজের সিদ্ধান্তই বা কে নেবে।
ভারসাম্যপূর্ণ কাজ---
জ্যাকসন ইনস্টিটিউট অব গ্লোবাল অ্যাফায়ার্সের লেকচারার নাথানিয়াল রেমন্ড বলেন, ট্রিএজ হচ্ছে ভারসাম্য রক্ষার ফলাফল সম্পর্কিত বিষয়। তার মতে, ট্রিএজের ভয়ংকর বাস্তবতা হচ্ছে, সিদ্ধান্তগুলো শূন্যের সমষ্টি। একজন মানুষের চিকিৎসা করার অর্থ হচ্ছে অন্য মানুষকে চিকিৎসা না করা। তাই এটা গুরুত্বপূর্ণ যে জরুরি অবস্থার আগে মেডিকেল কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে কীভাবে নেবে সে বিষয়ে একমত হতে হবে এবং সেই নির্দেশনাগুলো স্বচ্ছতার সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী এবং জনগণকে জানাবে।
ট্রিএজের প্রধান মূলনীতি হচ্ছে নৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া। রেমন্ড ১৯৮২ সালের সিনেমায় দেখানো একজন স্টারশিপ অফিসারের উদাহরণ দেন। যেখানে তাকে একজন ব্যক্তির প্রয়োজন এবং অনেকের প্রয়োজনের মাঝে বাছাই করতে হয়।
রেমন্ড বলেন, যেকোনো সেটিংয়ে নীতিশাস্ত্র বিশেষ করে ট্রিএজে বিরোধগুলো চিহ্নিত করতে একটি উদ্দেশ্য উপস্থিত থাকে। নীতিশাস্ত্র ট্র্যাজেডিকে দূর করে না। কিছু ক্ষেত্রে নীতিশাস্ত্রের প্রয়োগ এতে অবদান রাখবে।
মহামারীকালে মেডিকেল স্টাফরা চেষ্টা করছেন দ্রুত হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য। সেজন্য আলাদা ব্যবস্থাও নিতে হচ্ছে কভিড-১৯ ওয়ার্ডে নেগেটিভ প্রেশার তৈরির জন্য। যদিও তা পর্যাপ্ত হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হেলি প্রেসকোট বলেন, ভালোভাবে কাজ করার জন্য ট্রিএজ পরিকল্পনা অবশ্যই আগে থেকে করা উচিত এবং এটি অনুশীলন করে দেখা উচিত। নয়তো ক্লিনিক্যাল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের অনেক চাপের মধ্যে থাকতে হবে।
মার্চে মিশিগানে কেস সংখ্যা বাড়তে শুরু করলে প্রেসকোট তখন ট্রিএজ দলের সদস্য ছিলেন। যারা প্রয়োজন দেখা দিলে দুর্লভ সংস্থান বরাদ্দের জন্য দায়িত্বশীল ছিল। দলটি সে রকম পরিস্থিতির একটা চিত্র তৈরি করে পরীক্ষা চালায়। যেমন ভেন্টিলেটর শেষ হয়ে যাওয়া এবং সিস্টেমকে প্রস্তুত করা ক্রাইসিস স্ট্যান্ডার্ড অব কেয়ার সক্রিয় করতে। সৌভাগ্যবশত তাদের তেমন কিছু এখনো করতে হয়নি।
তিনি বলেন, একটি পরিবারকে পরিস্থিতির কারণে এটা বলা যে আপনাদের রোগী আর চিকিৎসা নিতে সক্ষম নন। এই আলাপগুলো চিন্তা করার অর্থ হলো সংকট এড়ানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করার অনুপ্রেরণা।
অন্ধকার মুহূর্তের পরিকল্পনা---
প্রেসকোট জানতেন যে মিশিগানে তাদের হাসপাতাল কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীতে উপচে পড়ার সম্ভাবনা আছে এবং স্টাফদের এটা জানা প্রয়োজন যে কীভাবে এ সিদ্ধান্ত নেবে, কে আগে চিকিৎসা পাবে। যুক্তরাষ্ট্রে একটি পদ্ধতি অনুসারে রোগীদের তিনটি ক্যাটাগরিতে বাছাই করা হয়। সেটা করা হয় রোগের তীব্রতা, প্রতি বিভাগে রোগীদের কী প্রয়োজন তা মূল্যায়ন করা এবং জীবন বাঁচানোর জন্য হস্তক্ষেপ করার ভিত্তিতে। পক্ষপাতিত্ব দূরীকরণে সহায়তা করার জন্য প্রেসকোটের হাসপাতাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে রোগীরা কোন ক্যাটাগরিতে থাকবে সেজন্য একটি স্কোর পাবে। তবে প্রতিটি বিভাগে লটারির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হবে। তিনি বলেন, ট্রিএজ দল চেষ্টা করে নিয়ম ও জটিলতার ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব স্থির থাকার। তাহলে সবাই ন্যায্যভাবে চিকিৎসা পাবে।
তবে পরিকল্পনা ঠিক থাকলেও রোগীদের মাঝে বাছাইয়ের এ প্রক্রিয়া ডাক্তারদের মাঝে নৈতিক উদ্বেগ তৈরি করে। ক্রমবর্ধমান সংকটে অনেকে এরই মধ্যে লড়াই করছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর অভাবও অনুভূত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ডেনা কেলি কোস্টা বলেন, দক্ষ আইসিইউ নার্স তৈরির চেয়ে ভেন্টিলেটর তৈরি করা সহজ। ডিগ্রি শেষ করতে দু-বছর লাগে, এরপর দক্ষ হতে আরো ছয় মাসের অভিজ্ঞতা। এটা অনেক দীর্ঘ সময়। এই সংকটগুলো সরাসরি রোগীর যত্নকে প্রভাবিত করে। তবে এসবের সংকট মেনে নিয়েও এখন সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো কঠিন কাজটি করতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.