মধ্য অসমের লামডিং রেল শহর আজ ক্লান্ত, মূল্যবোধ সাংস্কৃতিক মনস্ক মন হারিয়ে গেছে
অমল গুপ্ত, গুয়াহাটি : মধ্যে অসমের অন্যতম রেল শহর লামডিং শহর ঘেঁষা কার্বি আংলং জেলার ৪৫ হাজার হেক্টর এলাকার মারাট লংরী অভয়ারণ্য। অপরদিকে, নগাঁও জেলা ঘেঁষা ধানসিঁড়ি লামডিং এলিফেন্ট রিজার্ভ ফরেস্ট, ২২৩ হেক্টরের আজ অস্তিত্ব আছে কি? বনাঞ্চল পাহাড়, সমতল, হাজার বন্যপ্রাণী, বিভিন্ন প্রজাতির পাখ পাখালীর মাঝে ঠান্ডা, বৃষ্টিস্নাত ছায়াঘন দেড়শো বছরের সাংস্কৃতিক মনস্ক রেল শহর আমাকে একদিন মুগ্ধ করেছিল। সেই ছায়াঘেরা, বাঁশ-টিনের ঘরগুলোর আশপাশে নানা অজানা পাখিদের কুহ কলতান, ট্রেনের বাঁশি, পাহাড় লাইনের হাজার হাজার হেক্টর বাঁশের জঙ্গলের মাদকতা, আমাকে কোনো দিন ক্লান্ত হতে দেয়নি। পাহাড় লাইনের প্লাটফর্মে নাগা টি স্টল, সবসময় জল নয়, কাপ ফুটছে, কাপগুলোকে স্যানিটাইজ করা হয় করোনার সংক্রমণের বহু বছর আগে থেকেই। দেশে কোথাও আছে কিনা জানা নেই, প্রাচীন শহরের ঐতিহ্যবাহী কালীবাড়ির প্রাচীন বেল গাছটি সম্ভবত আজও দাঁড়িয়ে। কিন্তু বৌদ্ধ মন্দিরের প্রাচীন বট গাছটিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। সুখ শান্তির পায়রাগুলো সব উড়ে গেছে। আমাদের বন্ধু ভান্তেজিও চলে গেছেন। জলহীন শহরে ভুগৰ্ভস্থের জল খুঁজতে ব্রজেন সরকার, স্বপন দাস, বাকিদের নাম মনে পড়ছে না। আমরা লাইনে কিলো দুয়েক হেঁটে এক জলাশয়কে বেছে ছিলাম, পাইপের মাধ্যমে শহরে জল আনার জন্য। গৌতম রায় পি এইচ ই মন্ত্রী থাকাকালীন ডিমা হাসাও জেলার পাহাড়ি নদী থেকে ২২ কিলোমিটার দূর থেকে জল আনার ব্যবস্থার কি গতি হল? কেউ জানেনা। আমরা লিটল স্টার একাডেমির উদ্যোগে জাতীয় পর্যায়ে এক সেমিনারের আয়োজন করেছিলাম। একাডেমির অধ্যক্ষ জয়শ্রী আচার্য্য ও আমরা রাখাল দাশগুপ্ত, প্রফুল্ল মহন্ত ডাক্তার মন্ত্রী অর্ধেন্দু কুমার দে, জয়শ্রী মহন্ত প্রমুখদের এক প্লাটফর্মে হাজির করিয়ে লামডিঙের জল সমস্যা সম্পর্কে জাতীয় পর্যায়ে এক বার্তা দিতে চেয়েছিলাম। নগাঁও জেলার প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক ঐকতান আমরা প্রকাশ করেছিলাম। আমার সম্পদনায় প্রকাশিত সংবাদপত্রে স্বপন দাস, আশীষ চক্রবর্তী, হিমাদ্ৰী সরকার প্রমুখ রাতদিন এক করে কাজ করেছিলাম। ডাক্তার অর্ধেন্দু কুমার দে তিনবারের মন্ত্রী, আমাদের ক্ষুদ্র কাগজে তিনি প্রথম কলম ধরেন। আজ প্রতিষ্ঠিত অথচ হিমাদ্রি সরকার লামডিং শহরের বাইরে গিয়ে সাধারণ এক দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন কোনোমতে। পাশে কেউ নেই। লামডিঙের স্বাভিমান, অহংকার ছিলেন, সবার প্রিয় বিজন দা, বগলে এক ফলিও ব্যাগ, চায়ের দোকানে দোকানে তুমুল আলোচনা বিশ্বের নানা ঘটনা প্রবাহ নিয়ে সঙ্গে অবশ্যই নেতাজি, জানুয়ারি মাসে কালীবাড়ি মাঠে বাঁশ পড়তো, আজ মন খুশিতে ভরে উঠত। নেতাজি আসছেন, ভুপাল দার ক্যামেরা রেডি থাকতো, ক্লিক ক্লিক ক্লিক, জীবন থেমে থাকে না। অসমের বাঙালিদের মাথা উঁচু করার এক কাজ করেছিলেন, বিধানসভার অধ্যক্ষ দেবেশ চক্রবর্তী, বিধানসভা যে চন্দ্রমোহন পাটোয়ারী, জয় নাথ প্রমুখ বাঙালিদের সম্পর্কে খুবই আপত্তিকর মন্তব্য করে দেবেশ বাবুকে হেনস্থা করার চেষ্টা করেছিলেন। পরের দিন বাঙালির ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে অপমানের জবাব দিয়েছিলেন। বিধানসভাতে উপস্থিত ছিলাম, গর্বে বুক ভরে উঠেছিল। আজ লামডিং গর্ব করার কিছু আছে কি? হাতে কলম ধরে সমাজের উন্নয়নে কাজ করা সাংবাদিকের ভূমিকা যে কি ন্যাক্কারজনক হতে পারে তা লামডিঙের একাংশ সাংবাদিকের ভূমিকা তা প্রমাণ করছে। তেল, কয়লা, মদ, বাঁশ, কাঠ প্রভৃতি থেকে অর্থ সংগ্রহ করা প্রথম কাজ। সরকারি স্বীকৃতিবিহীন এই সাংবাদিকদের সঙ্গে ৮০ দশকের ঐকতানের সাংবাদিকদের তুলনা করতে ইচ্ছা করছে, দিনভর খবর সংগ্রহ, পেটে খিদে, ট্রেন ভাড়ার পয়সা নেই, বিনা ভাড়াতে হোজাইয়ের প্রেসে যেতে হত। মাঝে মধ্যে লাল চা আর খবর নিয়ে আড্ডা। আজ সেই শহরে শুধুই মদ আর তাস গাঁজার আড্ডার রমরমা। জঙ্গল, বাঁশ ধ্বংস, জীবজন্তু নিধন, তেল চুরি, চাল চুরি, রেল ওয়াগন ভেঙে লুট আর লুট। আমরা, স্বপনরা সেই সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি, আজ কম বেশি প্রতিষ্ঠিত। সেই স্নিগ্ধ ছায়াঘন লামডিংকে ফিরে পাওয়া যাবে না? সেই শিয়াল ডাকা জোঁনাক জ্বলা দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেল। (চলবে ... ...)
কোন মন্তব্য নেই