Header Ads

‘সুপারস্প্রেডিং’ ইভেন্ট কীভাবে সংক্রমণের বিস্তৃতি ঘটায় !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় 
 
ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ১৭৫ জন এক্সিকিউটিভ বোস্টনে আসেন বায়োটেকনোলজি কোম্পানি বায়েগেনের লিডারশিপ কনফারেন্সে অংশ নিতে। দুদিন ধরে তারা একে অন্যের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, কথা বলেছে এবং খাবারও ভাগাভাগি করেছে। এই উপস্থিতির মাঝে নভেল করোনা ভাইরাসও ছিল। এই ইভেন্টে উপস্থিত অনেকেই নিজের অজান্তে কভিড-১৯-এ সংক্রমিত হয়ে পড়ে। ফলে এটি দ্রুতই অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে যায়, যা তারা বাড়ি পর্যন্ত বহন করে নিয়ে যায়। কেবল ম্যাসাচুসেটসেই ৯৯ জনের অসুস্থ হওয়ার খবর আসে।
 
একই সময়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে এক’শর বেশি মানুষের মাঝে, যারা আলবানিতে একটি শেষকৃত্যে অংশ নিয়েছিল। পরের মাসে ওয়াশিংটনে একটি সংগীত অনুশীলনে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে কেবল একজন ব্যক্তি ৫২ জনকে সংক্রমিত করে। দুজন মৃত্যুবরণ করে। আরকানসাসে একজন সংক্রামক যাজক ও তার স্ত্রী চার্চে উপস্থিত ৩০ জনের বেশি প্রার্থনাকারীর মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে দেন। যাদের তিনজন মৃত্যুবরণ করেন। এরপর সেখান থেকে নতুন ২৬ জনের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে অন্তত একজন মৃত্যুবরণ করে।
এরপর বিজ্ঞানীরা কভিড-১৯ নিয়ে যতই জানতে পারলেন ততই সামনে আসতে থাকে ‘সুপারস্প্রেডার’ বিষয়টি। এ প্রক্রিয়ায় একজন ব্যক্তি অসংখ্য মানুষকে আক্রান্ত করে থাকে। যা কিনা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে বেশ বড় ভূমিকা পালন করেছে। বোস্টন কনফারেন্স ও জর্জিয়ার শেষকৃত্য তেমনই সুপারস্প্রেডার ইভেন্ট হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। সিডিসির মতে, যুক্তরাষ্ট্রে শুরুতে কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এসব ঘটনার দায় রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ করোনার বিস্তারের জন্য মাত্র ১০ থেকে ২০ জন সংক্রমিত ব্যক্তি দায়ী।
নেটওয়ার্ক সায়েন্টিস্ট স্যামুয়েল স্কেরপিনো বলেন, এ ধরনের সুপারস্প্রেডার ইভেন্টগুলো আটকানো গেলে কভিড-১৯-এর বিস্তৃতিকেও কমানো যেত। বিজ্ঞানীরা এমন কারণগুলো শনাক্ত করেছেন, যা কিনা বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। যার মধ্যে এমন বড় ভিড় এবং মানুষে মানুষে নৈকট্যসহ বেশকিছু কারণ রয়েছে। সাম্প্রতিক প্রমাণগুলো বলছে, বেশির ভাগ পরিস্থিতিতে স্বতন্ত্র প্রজাতির জৈবিক অবস্থার চেয়ে এসব কারণই বেশি দায়ী নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তৃতির জন্য।
যখন কীভাবে সার্স-কোভ-২ ভাইরাস বিস্তৃত হয় তা ব্যাখ্যা করা হয়, তখন এডিডেমিওলজিস্টরা কেবল একজন ব্যক্তি গড়ে কজনকে সংক্রমিত করছে, সেটাই ব্যবহার করেন না, বরং ডিসপারসন ফ্যাক্টরের (বিস্তৃত এলাকায় কোনো কিছুর ছড়িয়ে পড়া বোঝায়) মূল্যমানও ব্যবহার করা হয়; যাকে বলা হয় ‘শ’। এই সংখ্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয় রোগ কতটা বিস্তৃত সেটা। হংকংয়ের গবেষকরা ১ হাজার কভিড-১৯ কেস হিসাব করে দেখিয়েছেন যে এখানে ‘শ’ এর মান ০.৪৫। যা কিনা সার্স অথবা মার্সের চেয়ে অনেক বেশি। তবে ১৯১৮ সালের ফ্লু মহামারীর চেয়ে কম।
নভেল করোনাভাইরাস প্রাথমিকভাবে ছড়ায় শ্বাসতন্ত্র থেকে নির্গত ড্রপলেটের মাধ্যমে। যা কিনা আক্রান্তের হাঁচি, কাশি কিংবা নিঃশ্বাস থেকে নির্গত হয়। এরপর অন্য ব্যক্তি সেটা নাক বা মুখের মাধ্যমে নিজের কাছে টেনে নেয়। যদি এর ফলে কোনো ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়ে তবে তাকে নিজের ঘরে আলাদা থাকতে হয়। যাতে করে এটা আর না ছড়ায়। তবে কভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে উপসর্গ দেখা যাওয়ার আগেই অনেক ক্ষেত্রে রোগ ছড়িয়ে পড়ে। সিডিসি বলছে, ৪০ শতাংশ সংক্রমণ ছড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে কোনো ধরনের লক্ষণ দেখা যাওয়ার আগেই। অনেক ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখা দিতেই
ছ-দিন লাগতে পারে। এটিই আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুযোগ করে দেয় রোগ ছড়ানোর জন্য। সে সঙ্গে সুপারস্প্রেডিংয়ের মতো ইভেন্টে উপস্থিত হওয়ারও।
গবেষকরা এমন কিছু কারণ খুঁজে বের করেছেন, যা সুপারস্প্রেডিংকে সহজ করে দিয়েছে। যার কিছু হচ্ছে পরিবেশগত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাতাস চলাচলের দুর্বল জায়গাগুলোকে সাধারণত ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্য দায়ী করা হয়। জাপানে ১১০টি কভিড-১৯ কেস নিয়ে এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বদ্ধ পরিবেশে জীবাণু সংক্রমণ খোলা জায়গার চেয়ে ১৮ গুণ বেশি। মূলত আবদ্ধ স্থানগুলো সুপারস্প্রেডার ইভেন্টগুলোকে আরো বেশি উৎসাহ প্রদান করে। এছাড়া আরো কিছু গবেষণা বলছে, বড় বড় সংক্রমণের ঘটনা মূলত বদ্ধ জায়গা থেকেই ছড়িয়েছে। বিশেষ করে নার্সিং হোম, চার্চ, ফুড প্রসেসিং প্লান্টস, স্কুল, শপিং সেন্টার, শ্রমিকদের ডরমিটরি, জেল ও জাহাজ থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর ঘটনা বেশি ঘটেছে।
এছাড়া এই সুপারস্প্রেডিংয়ের ঘটনাগুলোয় আরেকটি মিল রয়েছে। সেটা হলো এখানে সবগুলো জায়গায় প্রচুর লোকের সমাগম ঘটে। আপনি একটি জায়গায় যত বেশি ব্যক্তির আগমন নিশ্চিত করবেন, সেটি করোনার বিস্তার ঘটাতে তত বেশি উপযোগী হয়ে উঠবে। আবার কতক্ষণ জমায়েত অবস্থান করবে তার ওপরও বিস্তার নির্ভর করে। যত বেশি সময় জমায়েত উপস্থিত থাকবে, সংক্রমণও তত বেশি ছড়াবে। এছাড়া উপস্থিত ব্যক্তির কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করে ভাইরাস কতটা ছড়াবে সেটি।
(তথ্য সূত্র : সায়েন্টিফিক আমেরিকান)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.