এমন একটা দিন যায় না যে দিন বাবাকে মনে পড়ে না !!
বিশ্বদেব
চট্টোপাধ্যায়
আমার মনের মধ্যে বাবার যে ছবি আজও স্পর্শ করার মতোই ধরা আছে সেটা-ই আমার আজও অসংখ্য প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চালিকা শক্তি। অসীম সাহসী বিরাট ব্যক্তিত্ব এবং গান-বাজনা-নাট্য পরিচালনা-লেখা এবং প্রচুর পড়াশোনার মধ্যে থাকা বাবার ধারে কাছে এ জীবনে পৌঁছুতে পারা গেল না বলে দুঃখের চেয়ে লজ্জাটাই বেশি অনুভব করে এসেছি। আমার বাবাকে নিয়ে একাধিক উপন্যাস লেখার সুযোগ থাকলেও সাহসে কুলোয় নি এই আশঙ্কায় যে, বাবাকে ঠিক মতো ধরতে পারবো তো? আশঙ্কা থেকে আজও বেরিয়ে আসা হল না ! বাবার সততাবোধ এবং সাংস্কৃতিক মেধা ও প্রতিভা এমন একটা অন্যরকমের ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছিল যার মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো বিশেষ কাউকে আমি দেখি নি। ফলে সাধারণ মল-মূত্রের জীবনে টাকা রোজগারের নানান ধান্ধায়ে উন্মত্ত থেকে যারা খাওয়া আর ঘুমোনোর ফাঁকে ফাঁকে দলাদলি পরচর্চা পরনিন্দা এবং কাঠিবাজিকেই জীবনের ব্রত বলে মনে করতো তাদের কাছে বাবার জনপ্রিয়তা ছিল না। ফলে ছোটবড় উৎপাত বাবাকে সামলাতে হয়েছে। অত্যন্ত প্রিয় মেরুদণ্ডহীন মুখগুলোও বিষাক্ত হয়ে উঠতে দেখেও স্থিতধী বাবাকে ভেঙে পড়তে দেখি নি। স্বার্থপরতা বিবেকহীনতার বিরুদ্ধে বাবাকে বহু সংঘর্ষ করতে হয়েছে, কিন্তু সে সব বাবাকে কখনো নত হতে দেয় নি বাবার দৃঢ় আপোষহীন কঠোর মানসিকতা।
সন্তান হিসেবে খুব কাছ থেকে প্রতিটি মুহূর্তে জীবনের সুখ-দুঃখের মধ্যেও বাবার
আপোষহীন অবস্থানকে মুগ্ধতার সঙ্গে লক্ষ্য করে গেছি। হয়তো সেই সব মুহূর্তের প্রভাব
আমার জীবনকেও বিশেষভাবে প্রভাবিত করে এসেছে। হয়তো বাবার জীবন ধরণের প্রভাবেই শস্তা
জনপ্রিয়তার নেশা আমার মধ্যে তৈরি হয় নি। অন্যায় মিথ্যাচারের সঙ্গে আপোষ করার
প্রবণতাও আমার ভেতরে বাসা বাঁধতে পারে নি। বাবার সাংস্কৃতিক মেধা ও চেতনারও
যৎসামান্য প্রভাব পড়েছিল বলেই বোধহয় লেখালেখির জীবনে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা
করে যাই।
বাবার বিরুদ্ধে অনেক সন্তানকেই প্রশ্নমুখর হতে দেখেছি। বাবার যা করা উচিত ছিল
বাবা তা করেনি--যা রেখে যাওয়া উচিত ছিল তা রেখে যায় নি--যেমন ভাবে সন্তানদের মানুষ
করা উচিত ছিল তেমনটা করতে পারে নি--অন্যের বাবারা কত কি করে আমার বাবা কিছুই করে
নি--এ ধরণের ক্ষোভ-আক্ষেপ আমি অনেককেই করতে দেখেছি। কিন্তু এসব প্রশ্ন এক
মুহূর্তের জন্যে আমার মনকে অস্থির করে নি। সব সময়ের জন্যে আজও প্রতিটি মুহূর্তে
মনে হয় ভাগ্যিস এই মানুষটিকে আমি আমার জন্মদাতা হিসেবে পেয়েছিলাম--পেয়েছিলাম বলেই
হয়তো এই পৃথিবীটকে স্বচ্ছ দুষ্টিতে দেখার ক্ষমতাটুকু পেয়েছি। মানুষকে চেনার ক্ষমতা
পেয়েছি।
মানসিক দুঃখ-যন্ত্রণার প্রতিটি মুহূর্তে এই মানুষটিকে আমার ভীষণভাবেই মনে
পড়ে--মনে পড়ে বলেই ধীরে ধীরে নিজেকে ফিরে পাই। সব সময়েই যার কথা মনে পড়ে সেই বাবার
জন্যে একটা দিন স্থূল বিবেচনায় হাস্যকর মনে হতেই পারে--কিন্তু এই দিনটি ফেসবুকের
দৌলতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিন। কুলাঙ্গার সন্তানদের মধ্যেই এই দিনটিতে ফেসবুকের
পাতায় পিতৃতর্পণে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায়। সেটাই বা কম কি ! অনেকেই কাষ্ঠহাসি ঠোঁটে
ঝুলিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে পরিত্যক্ত বৃদ্ধ ‘বাবা’র হাতে একটু মিষ্টি কি একটা নতুন জামা-কাপড় দিয়ে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে
পিতৃতর্পণ করেন। তবু তো কিছু করেন--পরিত্যক্ত বৃদ্ধের খসখসে মলিন অধরে আঁকাবাঁকা
এক চিলতে হাসি তো ফোটে ! সদ্য কলেজের
জীবনে ঢুকতে ঢুকতেই আমি বাবাকে হারিয়েছি--অথচ আরও অনেক বছর তাঁকে আমার প্রয়োজন
ছিল। আরও বেশ কিছু বছর বাবা আমার পাশে থাকলে আমি জানি--আমার জীবনের গল্পটা
একেবারেই অন্যরকমভাবে লেখা হতো !!
কোন মন্তব্য নেই