হত্যাকাণ্ডের গুণগত বা শ্রেণীগত কোনো পরিচয়ও তৈরি হয় বোধহয় !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
আমি চিরকাল জেনে এসেছি এবং বিশ্বাসও করে এসেছি--যে কোনো হত্যাই হত্যা হিসেবেই
চিহ্নিত হয়ে থাকে। যে কোনো হত্যাই-তা যদি নির্বিচারে হয় তাহলে তা চিরকালই কঠোরভাবে
নিন্দনীয়। সে হত্যা যদি সাঁইবাড়ি-মরিচঝাঁপি-বাণতলা- কামদুনি-নেতাই-নন্দীগ্রাম-এ র গণহত্যা হয় তাহলেও তার নৃশংসতা সবসময়েই কঠোরভাবে নিন্দনীয়।
এমন কী স্রেফ একটা পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যদি শতাধিক মানুষকে নৃশংসভাবে খুন করা হয় তাহলেও সেটা নিন্দনীয়--রাজনৈতিক
মোড়কে মুড়ে তাকে যে ভাবেই পরিবেশন করা হোক না কেন! পাশবিক নৃশংসতা ছাড়া যে
হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় না সেটা নিহতের আত্মাই ভালভাবে বোঝে--যেসব হত্যাকাণ্ডের
পেছনে বিশেষ উদ্দেশ্যে ঠাণ্ডা মাথা কাজ করে সেই সব হত্যাকাণ্ডের পেছনে মানুষের
বিশেষ ধরণের জিঘাংসা ও প্রতিহিংসাপরায়ণ মানসিকতা কাজ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে
কেন্দ্র করে বিশ্বের বড় বড় নেতারা ঠাণ্ডা মাথায় যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিলেন
সেইসব হত্যাকাণ্ডকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক
বিশ্লেষকরা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে জাস্টিফাই করার চেষ্টাও করেছেন--কিন্তু
সাধারণ মানুষ নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে হত্যাকাণ্ড হিসেবেই চিহ্নিত করে এসেছেন। তাই
হিটলার-মুসোলিনি-স্ট্যালিন প্রমুখ বিশদ্বনেতাদের ছবিতে লাল আঁচড় পড়েছে যুগে যুগে।
হিটলারের ইহুদী নিধনের নৃশংসতাই খুব বড় আকারের জাতি বিদ্বেষের ঘটনা হিসেবে মানুষের
সামনে উঠে এসেছিল। তারপর দেশে দেশে যত দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে তার অধিকাংশই বর্ণ-জাতি-ধর্ম
বিদ্বেষের কারণেই হয়েছে--এমনটাই আলোচনায় উঠে এসেছে। বিশেষ করে আমেরিকা ও দক্ষিণ
আফ্রিকায় যত হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে যত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তার সিংহভাগই বর্ণ
বিদ্বেষের কারণেই ঘটেছে বলে বিশেষজ্ঞরা তাঁদের মতামতে সিদ্ধান্ত টেনেছেন। এঁরা
সাধারণতঃ খুবই কম ক্ষেত্রে (এবং খুবই কম সংখ্যায়) এটা বলতে পেরেছেন যে এসব
হত্যাকাণ্ড মানবতাকে হত্যার জন্যেই সংঘটিত হয়েছে। সাদা-কালো
হিন্দু- মুসলিম- খ্রীস্টান হত্যার সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে যখন থেকে হিসেব নিকেশ শুরু হয়ে
গেল তখন থেকেই মানুষ প্রাণপণে খুঁজতে শুরু করল- সাদা- কালো- হিন্দু- মুসলিম- খ্রীস্টান- ইহুদির মৃতদেহ! নৃশংস হত্যাকাণ্ডের আলোচনাগুলো ঘুরপাক
খেতে থাকলো জাতি-বর্ণ বিদ্বেষের প্রেক্ষিতেই!আমেরিকার একজন কৃষাঙ্গ’র গলায় পা দিয়ে পৈশাচিকভাবে যে হত্যা করল--আদতে সে মানুষ কিনা তা নিয়ে যত না
আলোচনা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি আলোচনা হচ্ছে একজন মানবেতর শেতাঙ্গ তাকে ঠাণ্ডা
মাথায় বর্ণ বিদ্বেষের কারণে হত্যা করেছে--এই অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়টাই নিয়ে।
এখানে হত্যাকাণ্ডটি গুরুত্ব পেল সাদা-কালো বর্ণবাদ হিসেবেই--রাজনৈতিক বিদ্বেষ বা
অপরাধ ও অপরাধীর কোনো ভূমিকা আছে কিনা তা নিয়ে কোনোরকম বিতর্ক তৈরি হল না। অথচ
একজনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রপতিকে হুমকি দিতে হল--তিনি
সেনা নামিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবেন ! আমাদের দেশে ট্রেনের চাকায় ১৪/১৫ জন ঘুমন্ত
মানুষ মারা গেলে--কিংবা পঞ্চায়েত নির্বাচনে শতাধিক মানুষ নৃশংসের মতো খুন
হলে--কিংবা কামদুনির কিশোরীকে দু’পা চিড়ে খুন করা হলে--দিল্লির নির্ভয়া
মর্মান্তিকভাবে খুন হলে--দেশের যত্রতত্র গণধোলাইয়ে মানুষের প্রাণ গেলে গোটা দেশ তো
দূরের কথা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলেও আমেরিকার মতো প্রবল কম্পন তৈরি হয় না। এগুলো কি
হত্যাকাণ্ড নয়? ধর্মবিদ্বেষের কারণে এ দেশে হত্যাকাণ্ড
ঘটলে প্রবল আলোড়ন তৈরি হয় মানবতার হত্যার জন্যে নয়--স্রেফ রাজনৈতিক মুনাফা লোটার
উদ্দেশ্যে। আমেরিকায়
সাদা-কালো বা বর্ণবিদ্বেষের ইতিহাস নতুন নয়--মাঝে মাঝেই হয়--বিশেষ করে
রিপাব্লিকানরা ক্ষমতায় এলে এ প্রবণতা বাড়ে। আমেরিকার গত নির্বাচন নিয়ে আমি
অনেকগুলো পোস্ট আপলোড করেছিলাম--যারা পড়েছেন তাদের মনে থাকার কথা--আমি ট্রাম্পকে
মানসিক ভারসাম্যহীন দানব হিসেবেই চিহ্নিত করে এসেছি। তার যুক্তিসঙ্গত কারণও
ছিল--ট্রাম্পের ব্যক্তিজীবনের যেসব তথ্য-ইতিহাস প্রকাশ্যে এসেছিল তাতে তাকে
আমেরিকার মতো একটা রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল খোদ
মার্কিনীদেরই--কিন্তু তবু বিস্ময়করভাবেই ট্রাম্প হিলারিকে হারিয়ে সে দেশের
প্রেসিডেন্ট হয়ে বসলেন। নিরবিচ্ছিন্নভাবে নিজের অযোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে চলেছেন আজও।
ট্রাম্প নিজে একজন বর্ণবিদ্বেষী মানুষ--সেদেশের কৃষাঙ্গরা তা জানতেন বলেই তাদের
ভোট তিনি সামান্যই পেয়েছেন। আমার আশঙ্কা ছিল বর্ণবিদ্বেষী দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রচুর
পরিমাণে ঘটতে থাকবে। প্রচুর না হলেও ইতস্ততঃ হয়ে চলেছে। কিন্তু পুলিশের হাতে (এর
আগেও কয়েকটি ক্ষেত্রে হয়েছে) এত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের চলমান ছবি দুনিয়ার সামনে
সেভাবে আসে নি। ফলে মানবতাবাদী (বিশেষ করে যাঁরা হত্যাকাণ্ডের গুণগত ও শ্রেণীগত
মান নিয়ে বিচার করতে অভ্যস্ত) লোকজন সামাজিক মাধ্যমে নৃশংসতার চেয়েও বর্ণবাদীতার
বীভৎসতা নিয়ে বিপুল পরিমাণে সোচ্চার হয়ে উঠলেন। নিঃসন্দেহে এখানে মানবতাকেই
নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ নৃশংসতায় মানুষমাত্রেরই বিচলিত হওয়া শিউড়ে ওঠা
স্বাভাবিক। আমিও ঐ ঘটনা দেখার পর থেকে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারি নি।
তবু আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পেরও কিছু রাষ্ট্রনায়ক বন্ধু থাকবেন--কূটনৈতিক
প্রয়োজনের কারণেই। কিন্তু যে মুহূর্তে আমেরিকানরা ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে ছুঁড়ে
ফেলে দেবে সেই মুহূর্ত থেকেই ট্রাম্প বিশ্বের নিঃসঙ্গতম নিন্দনীয় মানুষ হিসেবে
চিহ্নিত হবেন সন্দেহ নেই! এর মধ্যেই আর একটি
বীভৎস হত্যাকাণ্ড আমাকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছে। এক গর্ভবতী হাতিকে আনারসের মধ্যে বোম
দিয়ে যে শিক্ষিত মানুষ মারতে পারে--দুঃস্বপ্নেও এটা ভাবা যায় কি? আমি জানি না হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে কিনা! দু’টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে কোন্ হত্যাকাণ্ডটি বীভৎসতর সেটা বুঝে ওঠার ক্ষমতা আমার
নেই। হাতি হত্যার বিবরণ পড়তে পড়তে আমার চোখে অবিরল জল নেমে এসেছিল। হাজার হোক
মানুষ তো--অন্তর্দাহকে চেপে রাখার অমানবীয় শক্তি তো আমার নেই। এত মারাত্মক
যন্ত্রণা ইদানীংকালে আমি অনুভব করি নি। আমেরিকায় সাদা-কালো বিদ্বেষের ফলে যত
হত্যাকাণ্ড তার চেয়ে অনেক বেশি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে আমাদের চারপাশে--এবং
এখনও যে কোনো হত্যাকাণ্ডকে হত্যাকাণ্ড হিসেবেই দেখে থাকি। আমেরিকার যে পুলিশ কর্মী
এক কৃষ্ণাঙ্গকে গলায় পা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করল তার প্রতি তীব্র ঘৃণা ও
ধিক্কার না জানালে নিজেকে মানুষ বলে দাবি করতে পারব না। ঠিক তেমনই কথায় কথায় আমার
দেশেও যে ভাবে নিয়মিত বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে সেইসব হত্যাকাণ্ডের হত্যাকারীদের
প্রতিও আমার সমান ঘৃণা ও ধিক্কার থাকছেই। কারণ,
যে কোনো হত্যাকাণ্ডকেই আমি
মানবতার হত্যা বলেই মনে করি- এর মধ্যে সাদা- কালো- হিন্দু- মুসলিম - খ্রীস্টান- ইহুদী হত্যা বলে মনে করি না- কারণআমি রাজনৈতিক বা
সাম্প্রদায়িক ব্যবসায়ী নই-তাদের অনুগত ভৃত্যও নই !!
কোন মন্তব্য নেই