Header Ads

ভয় আতঙ্ক সচেতনতা ও মনস্তত্ত্ব !!


বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

কোনোরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না--ছিল না কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও--জানা নেই ঝাড়ফুঁক তন্ত্রমন্ত্র--এই রকম চতুর্দিকের কুল কুলপরিস্থিতিতে রাতে শুতে যাওয়ার সময় দেখা গেল কালান্তক যমের মতো এক কালনাগিনী বালিশের পাশে ফণা বিস্তার করে মৃদু মৃদু দুলছে ! সাধারণ মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়ায় তীব্র ভয়ার্ত চীৎকার হৈ-হৈ ছোটাছুটি খুব স্বাভাবিক। আশপাশ থেকে বহু জনসমাগমও স্বাভাবিক। কিন্তু কেউ সাপুড়ে নয়। কালনাগিনীর মৃত্যু ছোবল থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা কারুর নেই। যারা ইতিমধ্যে এই ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে এসেছে তারা কে কিভাবে বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে তা যে যেমনভাবে পেরেছে জানিয়েছে। এখানেও সেই ভাবেই চেষ্টা করা ছাড়া বিকল্প কিছু ছিল না। সকলকে সেই ভাবেই নিজেকে রক্ষা করার জন্য সচেতনতার বার্তাও দেওয়া হচ্ছে। ওদিকে কালান্তক কালনাগিনী কখনো সামনে এগিয়ে আসছে--কখনো বিছানার পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে আওয়াজ উঠছে--ভয় পাবে না--আতঙ্কিত হবে না--সচেতন থাক--সচেতন থাকলেই বেঁচে যাবে। সুতরাং অধিকাংশ মানুষ সচেতনতার শিক্ষা ও চর্চায় মনোনিবেশ করে যথাসম্ভব নিজেকে গুটিয়ে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করতে লাগল। অন্যদিকে বেশ কিছু অকুতোভয় মানুষ যারা ভয় পায় না আতঙ্কিত হয় না--অন্যদের ভয় না পেতে বলে--আতঙ্কিত না হওয়ার নানান যুক্তি তুলে ধরে তারা ঐ বিছানার কাছাকাছি নাচানাচি শুরু করে দেয়। বিছানার ধারে কিনারে বসেও পড়ে--ভীত আতঙ্কিত মানুষদের বোঝাতে চেষ্টা করে--দেখ কালনাগিনী আমার কিছুই করতে পারবে না ! মানুষের মনস্তত্ত্ব স্পষ্টভাবেই এই ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রাথমিকভাবে আড়াআড়ি দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। যারা কালনাগিনীকে নিয়ে বসবাস করে নি--তার চরিত্র তার দ্রুতগামিতা তার বিষের তীব্রতা সম্পর্কে কিচ্ছু জানে না তারা ভীত আতঙ্কিত থেকেই যথাসম্ভব দূরে দূরে থাকার চেষ্টাই করতে লাগল। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভীষণভাবে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিল। যে শত্রুর প্রায় কিছুই জানা নেই তার দংশনের ভয়বহতা সম্পর্কে অচেতন থাকাটাকে তারা সচেতনতা বলে কিছুতেই মনে করতে পারছে না। সুতরাং তারা অকুতোভয় বিজ্ঞ বিশারদদের কথায় কালনাগিনীর বিছানায় বসে নিজেদের সাহস প্রকাশের প্রাজ্ঞতা প্রদর্শনের বিন্দুমাত্র চেষ্টাকেও চরম গর্দভীয় কাণ্ড বলেই বিবেচনা করতে থাকল।
এদিকে কালনাগিনী মাঝে মাঝে বিছানার নানান প্রান্তে আত্মপ্রকাশ করেই ফের অদৃশ্য হয়ে যায়। এইভাবেই সব কিছু চলছিল--বিছানা থেকে বা ঘর থেকে তাকে তাড়ানো যাচ্ছিল না। ঘরের আয়তনের তুলনায় ঘরের তৈজসপত্রের পরিমাণ এতটাই যে ফাঁকা জায়গা বলতে তেমন কিছু ছিল না। দরজার চৌকাঠ থেকেই সমবেত জনতা চিৎকার চেঁচামেচি করে যাচ্ছিল। কিছু অকুতোভয় বিশেষজ্ঞ বিশারদ মানুষ ঘরের মধ্যে এদিক ওদিক হাঁটাচলার পাশাপাশি যথারীতি বুক ফুলিয়ে কালনাগিনীর নাগালের মধ্যেই বিছানার ওপর বসছে--খোশ গপ্পো জুড়ে দিচ্ছে--বিড়িতে টানও দিচ্ছে--জল-বাতাসাও খাচ্ছে--কালনাগিনীর বিষদাঁত কি ভাবে ভাঙ্গা যায় তার শলা-পরামর্শও চলছে। খবর শুনে কিছু সর্প বিশারদসাপুড়ে ওঝাও কালনাগিনীকে কায়দা করার নানান কসরৎ করে গেলেও বিশেষ কিছুই ওস্তাদি দেখাতে না পেরে বলে গেল--ভয় পাবে না--আতঙ্কিত হবে না--উনি সাক্ষাৎ মা-মনসা এবং বাবা ভোলানাথের স্নেহের সন্তান--কাউকে কিচ্ছু করবেন না--সময় হলেই চলে যাবেন! এইসব সময়ে কালনাগিনীকে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছিল না--কখনো তার লেজের অংশ কখনো তার ভয়ঙ্কর চেড়া জিভ দেখা যাচ্ছিল! অকুতোভয় এক বিশেষজ্ঞ হাঁক দিলেন--আমি আজ এই বিছানাতেই রাত কাটাবো--আমার সঙ্গে কে কে থাকবে ! আর যারই অভাব হোক কাণ্ডজ্ঞানহীন মুর্খের অভাব কখনো হয় না। দুচারজন জুটেও গেল। ঘরের মধ্যে ইতস্ততঃ বেশ কিছু খাবার-দাবারও ছিল--সুতরাং তারা ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে নিজের নিজের বাড়িতে গেল প্রস্তুত হয়ে আসার জন্যে। তারা তাদের জামা-প্যান্টের পকেটে যথাসম্ভব নির্ভয়ভরে নিয়ে এল। এই ফাঁকে কালনাগিনী ঘরের মধ্যে রাখা খাবার-দাবারে তার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিল। অকুতোভয় মানুষ--যারা পকেটভর্তি নির্ভয়নিয়ে কালনাগিনীর সঙ্গে রাত কাটাতে এল তাদের প্রচুর কাকুতি মিনতি করল ভীত-আতঙ্কিত লোকজন--হঠকারী দুঃসাহস না দেখিয়ে তাদের নিজের নিজের ঘরের মধ্যেই থাকার জন্যে বার বার অনুরোধ করল--কিন্তু নির্ভীকতা এমনই এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক আবেগ যা নিয়ন্ত্রণে অক্ষম মানুষের জন্যে কালান্তক যম হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তাদের এ তত্ত্ব বোঝানো একেবারেই সহজ কর্ম নয়। বলতে কী--প্রায় অসম্ভব কাজ। সুতরাং অকুতোভয়রা কালনাগিনীর সঙ্গে এক ঘরে রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলো না। ফলে অবধারিতভাবে যা হওয়ার ছিল তাই হলো--সকলেই প্রাণ হারালো--তাদের শরীর ও পোষকের সঙ্গে কালনাগিনীর বিষ বাইরে অনেক কিছুর মধ্যে--এমন কী মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়লো। শুরু হল মৃত্যু মিছিল। এটা সেই বিচিত্র মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধিরই এক মারাত্মক পরিণাম ! ঐ অকুতোভয় মানুষগুলোকে যদি নির্ভীকতার ইঞ্জেকশন না দিয়ে ভয় পাওয়ানো যেত--যদি ঠিকঠাক বোঝানো যেত কালনাগিনীর ক্ষমতা কী ভয়ঙ্কর--তার হাত থেকে বাঁচা ভীষণই কঠিন--তাই তাকে ভয় পেতেই হবে--দূরে থাকতেই হবে--কোনোভাবেই তার নিঃশ্বাসের নাগালের মধ্যে যাওয়া যাবে না--গেলে নিজে তো বটেই জ্ঞাতি-গুষ্টি কেউ বাঁচবে না--হ্যাঁ, ঠিক এইভাবেই ভয়টা দেখানো উচিত ছিল তাদের। মৃত মায়ের পাশে তাকে জাগানোর মরিয়া চেষ্টারত শিশুটির ছবি দেখিয়ে তাদের ভয় দেখানো উচিত ছিল--নির্বোধদের বাঁচাতে হলে ভয় দেখানোর চেয়ে বড় কোন প্রতিষেধক আজপর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নি। সভ্যতার সূচনা থেকে মানুষ আকস্মিক বজ্রপাত, আগুন, জলোচ্ছ্বাস দেখে আমূল শিহরিত হয়েছিল বলেই--তীব্র আতঙ্কে সিটিয়ে গিয়েছিল বলেই তারা নিজেদের সুরক্ষার নানা কৌশল বের করতে পেরেছিল--নিত্য নতুন বিপদ থেকে নিজেদের বাঁচাতে নিত্যনতুন শিক্ষা অর্জন করতে পেরেছিল। ভয়-ই তাদের সচেতন করেছে--নির্বোধ নির্ভয়’-এর বাতেলাবাজি আর যাই পারুক ভয়ঙ্কর কোনো শত্রুর সঙ্গে মুখোমুখি মানুষকে জেতাতে পারে নি। এইচআইভি ইবোলা করোনাকে আমরা ভয় পাব না--ভীত আতঙ্কিত না হয়ে ঢালতলোয়ারহীন আমরা বিশেষজ্ঞ বিশারদসেজে মুখোমুখি দাঁড়াবো? শত্রুর চেহারা চরিত্র সম্পর্কে পুরোপুরি অন্ধকারে থেকে ডোন্ট কেয়ারমানসিকতায় নির্ভীক বীরত্ব দেখাবো কার ভরসায় কোন আশ্বাসে ভাবতে হবে না? ভয় পেলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে--কিন্তু তারা কজন? দুর্বল হওয়া আর নিশ্চিতভাবে মারা যাওয়ার মধ্যে কেনো সীমারেখা নেই? ভয় পেলেই তো মানুষ নিজের নিরাপত্তার কথা ভাববে--বিষয়টা যে একেবারেই ছেলেখেলার নয় সেটা বুঝতে পারবে--সেটা বুঝলে তবেই তো তারা প্রাণপণে দূরে থাকার চেষ্টা করবে !
আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যায় এই তীব্র ভয় মিশ্রিত আতঙ্কটা আছে বলেই তো মানুষ আগুনের ব্যাপারে এত সতর্ক--দূরে থাকার নানান কৌশল সে আয়ত্ত করতে পেরেছে। কিন্তু করোনা সম্পর্কে তারা কি জানে? সেই ওঝা আর সাপুড়েদের মতো আধুনিক চিকিৎসক গবেষকরা যা বলছে মানুষ কি তা সবটা বিশ্বাস করছে? করলে তাদের নির্দেশ মানুষ মানছে না কেন? ‘ভয় পাবেন না--আতঙ্কিত হবেন না’--এই হাস্যকর নির্বোধ প্ররাচনার শিকার হয়ে মানুষ শত্রুর সঙ্গে গলাগলি ঘেঁষাঘেঁষি করছে কেন? কেন হাজারে হাজের শ্মশানের ছবি পেছনে রেখে মানুষকে অপ্রত্যাশিত ভাবে আত্মীয় পরিজন পরিবেষ্টিত এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে? প্রথম থেকেই নির্ভয়ইঞ্জেকশন নয় দরকার ছিল ভয়’-এর ইঞ্জেকশন--যাতে মানুষ কালান্তক যমের মতো দুয়ারে এসে দাঁড়ানো অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে ইয়ার্কি তামাশার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করতে পারে ! মানুষ যদি সত্যি সত্যি ভয় পেত তাহলে আমাদের দেশে অন্ততঃ এই অবস্থা দেখতে হত না। ভয় পায় নি আমেরিকা-ব্রাজিল-ফ্রান্স-স্পেন-বেলজিয়াম-ইরান-রাশিয়া সহ আরও অনেক দেশ--কী ভয়ানক মূল্য তাদের দিতে হচ্ছে ! গোটা বিশ্বের এই ছবি দেখেও যারা রাজনীতিতে বেদম উৎসাহ পাচ্ছেন--নির্ভয় তত্ত্ব নিয়ে মশগুল হয়ে থাকাটই পরিত্রাণের উপায় ভাবছেন--একে অপরকে কামড়াবার ছোবল মারার ‍চেষ্টা করছেন--আমাকে মাপ করবেন--আমি তাদের মানুষ বলে মনে করতে পারি না। মানবসভ্যতার চরম শত্রু বলেই মনে করি। জানি না, কাল কে কোথায় থাকবো--কিন্তু বিশ্বাস করি--এ পৃথিবী থাকবে--তখনও যারা বেঁচেবর্তে থাকবে--আমার বিশ্বাস তারা আজকের এই ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বের ভয়ঙ্কর সব অভিজ্ঞতা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিয়েই নতুন পৃথিবী তৈরি করবেন। স্বার্থান্ধ বিবেকবোধহীন নর্দমার কীটপতঙ্গরা যেন তাদের নতুন পৃথিবীতে মাথা তুলতে না পারে !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.