বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
এখনও চব্বিশ ঘন্টা কাটে নি--গতকাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
স্বয়ং তাঁর কয়েকজন (যাদের তাঁর সঙ্গে থাকার প্রয়োজন ছিল) মন্ত্রীকে নিয়ে দুর্গত
অঞ্চল পরিদর্শন করে গেছেন। একটি চপারে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী-রাজ্যপাল এবং রাজ্যের
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য একটি হেলিকপ্টারে ছিলেন প্রতিমন্ত্রী
বাবুল সুপ্রিয়, দেবশ্রী চৌধুরী এবং ক্যাবিনেট মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র
সিং প্রধান। এই দুটি আকাশযানের একটিতেও মমতা ছাড়া তাঁর কোনও মন্ত্রী, কোনো সাংসদ, কোনো দলীয় শীর্ষ
পদাধিকারী ছিলেন না। রাজ্য বিজেপি সভাপতি শ্রীমান দিলীপ ঘোষ সবই দেখেছেন এবং এটাও
শুনছেন--আমফানের বিরুদ্ধে মমতা ও মমতার নেতৃত্বাধীন সরকার ও প্রশাসন যে যথেষ্ট
প্রশংসনীয় কাজ করছে সেটা বার বার প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন। কোনো কপ্টারে
শ্রীমান ঘোষ খুবই সঙ্গত কারণেই জায়গা পান নি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছানুসারেই--মমতার
আপত্তিতে নয়--মমতা আপত্তি জানালে একই চপারে রাজ্যপাল এবং অন্য কপ্টারে
বাবুল-দেবশ্রীরও পরিদর্শন নিয়ে সমস্যা তৈরি হতো--যা হয়নি। মোদী-প্রধান-বাবুল-দেবশ্রী-রাজ্যপালের পরিদর্শনে যথেষ্ট ফাঁক থেকে গেছে বলে
শ্রীমান ঘোষের মনে হতেই পারে। তিনি নিজে তড়িঘড়ি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে যেতেই
পারেন--এই সঙ্কটকালে সেইসব জায়গায় দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পিঠে হাত রাখার
গণতান্ত্রিক অধিকার তাঁর নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে লগ্নটিকে
তিনি বেছে নিয়েছেন তা নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন উঠতে পারে বলে তিনি নিশ্চয়ই ভাবেন নি।
প্রথমতঃ গতকালই যাঁরা বিপর্যস্ত অঞ্চল ঘুরে গেলেন তাদের মধ্যে একমাত্র মমতা ছাড়া
আর কেউ ছিলেন না ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের পক্ষে। প্রশাসনিক বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী
ছাড়াও ছিলেন এ রাজ্যের প্রধান সরকার প্রতিনিধি রাজ্যপাল সহ তিন কেন্দ্রেীয়
মন্ত্রী। সেখানে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য রাখলেন তা শুধু রাজ্যবাসী নয়--গোটা
বিশ্ব শুনেছে। অবশ্যই রাজ্য বিজেপি সভাপতি শ্রীমান দিলীপ ঘোষও শুনেছেন। তবু
বিনিদ্র রাতটুকু কোনরকমে অতিক্রম করে সকাল হতে না হতেই সড়কপথে ছুটে যেতে চাইলেন
দুর্গত এলাকায় মানুষের পিঠে হাত রাখতে। তাঁর এই উচ্চ মানবিকতার মধ্যে যদি গূঢ়
রাজনৈতিক অভিসন্ধি না থাকতো তাহলে কোনো প্রশ্ন উঠতো না। তিনি জানতেন--আজই
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছেন--প্রশাসনিক বৈঠকও করবেন সেখানে।
রাস্তাঘাট এখনও দুর্গম--চতুর্দিকে লণ্ডভন্ড অবস্থা--এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর
কর্মসূচীও মসৃণভাবে চলা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে ঠিক আজই রাজ্য বিজেপি সভাপতির
কনভয় কেন যাত্রা শুরু করলো--এ প্রশ্ন উঠবেই। তাঁদের মিডিয়া মুখপত্র সিএন এটাকে
মারাত্মক ‘গণতন্ত্রবিরোধী
স্বৈরশাসক’-এর অগণতান্ত্রিক
আচরণ হিসেবে সারাদিন দেখাতে থাকবে এবং চিৎকার করে যাবে--করছেও ! রাস্তায় রাজ্য
বিজেপি সভাপতির কনভয় আটকে তাঁকে কী ভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে--তাঁর গণতান্ত্রিক
অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে ইতিত্যাদি যতরকমের জ্বালাময় শব্দপুষ্ট চিৎকার করা
যায়--করা হবে, ‘বিশিষ্ট’দের নিয়ে বৈঠকও হবে।
ওদিকে রাজ্য সভাপতি শ্রীমান ঘোষের কনভয় লক্ষ্য করে শত শত কর্মী সমর্থকরা ছুটে
আসবে--একটা প্রবল ডামাডোলের বাতাবরণ তৈরি হবে--পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও হয়ে যেতে
পারে--কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া লাঠি চার্জ--অল্পবিস্তর রক্তারক্তির ঘটনাও ঘটতে
পারে--যা থেকে এই মুহূর্তে যথেষ্ট রাজনৈতিক মাইলেজ পাওয়ার অঙ্কটা মিলিয়ে দেওয়া
যাবে। আমফান থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে মানুষের চরম
দুর্দশার খোঁজখবর নেওয়ার দায়বদ্ধতার কারণেই মুখ্যমন্ত্রীকে সেখানে যেতে হচ্ছে
প্রশাসনিক টিম সমেত। সকলেরই সেখানে ব্যস্ত থাকার কথা। অন্য কোনও অপ্রত্যাশিত (যা
প্ররোচনার আগুনে যে কোনো সময়ে জ্বলে উঠতে পারে) পরিস্থিতি তৈরি হলে সামলানো কঠিন
হয়ে ওঠা সম্ভব নাও হতে পারে--এমন অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রীসভার একাধিক
সদস্যদের পরিদর্শনের ২৪ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই শ্রীমান দিলীপ ঘোষকে ছুটতে হচ্ছে
কেন? জনসেবার উদ্দেশ্যে? লগ্ন পেরিয়ে যাচ্ছিল? সরকার বা প্রশানের
কাছ থেকে সম্মতিপত্র নিয়ে একদিন পরে যাওয়া যেত না? তাঁর রাজনৈতিক
উদ্দেশ্য সরকার বা প্রশাসন বুঝবে না এটাই বা তিনি ভাবলেন কি করে? বহু আগেই তাঁকে
আটকানো হবে না--এমন নিশ্চয়তা তাঁর কাছেও নিশ্চিতভাবেই ছিল--তবু তিনি ‘ ‘দুর্গম গিরি কান্তার
মরু’ অতিক্রমের দৃঢ়তা
নিয়ে যাত্রা শুরু করে দিলেন। তিনি জানতেন--মানুষ এখন যে অবস্থায় আছে সেখানে
সামান্য প্ররোচনাতেই বিপুল রাজনৈতিক ফায়দা তোলা কঠিন নয় একেবারেই। রাজ্য সরকার
হয়তো তাদের ধারণা মতো তাঁকে পরিদর্শনে সম্মতি দিত না--গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের
প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা নিয়ে তাঁর ‘যুক্তিসঙ্গত’ অভিযোগ রয়েছে--তবু
পরিস্থিতি বিবেচনা করেই এই বিশেষ লগ্নটিকে তাঁর পরিহার করা উচিত ছির না কি? আমার যতদূর
ধারণা--শ্রীমান ঘোষের এই সিদ্ধান্ত তাঁর নিজেরই সিদ্ধান্ত--প্রধানমন্ত্রী তাঁকে
কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এমন জনদরদী ভূমিকায় নামার পরামর্শ দিয়ে যান নি। এই ধরণের
রাজনৈতিক পদক্ষেপ যে দলের ভাবমূর্তিই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় তাই নয়--মানুষের কাছে
রীতিমতো ভুল বার্তাও পৌঁছে দেয়। প্রধানমন্ত্রী যে আবহাওয়া গড়ে দিয়ে গেলেন তা এক
ঝটকায় ২৪ ঘন্টার মধ্যেই লোপাট করে দেওয়ার এই রাজনীতিই পদে পদে বিপাকে ফেলছে
বিজেপিকে--কিন্তু কে কাকে বোঝাবে? মিডিয়াকে ক্রীতদাস বানিয়ে তার সবটুকু আলো নিজের দিকে
ফেলাবার নেশাটা পতনের যে কতবড় কারণ হয়ে উঠতে পারে সেটা যখন মালুম হয় তখন আর কিছুই
করার থাকে না--ফালতু বড় বড় লেকচার দেওয়া ছাড়া !!
কোন মন্তব্য নেই