অরূপ বৈশ্যের লেখা: যাদবপুর ও পরবর্তী
কলকাতা : বাংলার রাজনীতিতে ভদ্দরলোক আধিপত্য নিপীড়িত বঞ্চিতদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিয়েছে। বিজেপি দল সচেতনভাবে এই বিচ্ছিন্নতাকে সম্বোধন করছে এক প্রতিক্রিয়াশীল পথে। এই প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার হলো হিন্দুত্ববাদের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের এক আধুনিক রূপান্তর যার রাজনৈতিক বয়ান নির্মাণ করতে পারে উপরের শ্রেণি-বর্ণ, কিন্তু নিম্নবর্ণীয়দের আকৃষ্ট করে তার অভ্যন্তরে নিজেকে স্থান করে নিতে। এই স্থান তারা খুঁজে নেয় প্রতিক্রিয়াশীল ঐতিহ্য থেকে প্রাপ্ত মনোগত ধারণার উৎস থেকে। শোষণমূলক ব্যবস্থা যতক্ষণ এক চ্যালেঞ্জের মুখে না দাঁড়াচ্ছে, ততক্ষণ এই প্রতিক্রিয়াশীল পথে সামিল হওয়া স্বাভাবিক। আধিপত্যবাদী পরিসরে নিম্নবর্গীয় মানুষ প্রতিক্রিয়াশীল পথকেই নিজেদের পথ বলে ভাবতে শুরু করে।
রাজনৈতিক পরিসরে আমরা যাকে ‘অসভ্য’ ‘কুরুচিকর’ বয়ান বলে মনে করি বাংলার বিজেপি নেতৃত্ব সচেতনভাবে এধরনের রাজনৈতিক বয়ান নির্মাণ করে চলেছে যাতে নিপীড়িত বঞ্চিতরা যে ভাষাশৈলীতে অভ্যস্ত সেই ভাষা শৈলীর সাথে খাপ খায় এবং তারা একে ‘এলিটিজমের’ বিরুদ্ধে জেহাদ হিসাবে ভাবতে পারে এবং একাত্মতা অনুভব করে। নিপীড়িত বঞ্চিতদের সমর্থন পেতে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির এটাই প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক বয়ান নির্মাণ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে টার্গেট করে নেওয়ার পেছনে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের এই রণনীতি ও রণকৌশল কাজ করেছে। প্রগতিশীল রাজনীতিবিদরা যাতে এই ট্র্যাপে পা দিয়ে ‘অসভ্য-বর্বর’ ‘রুচি-কুরুচির’ বায়নারিতে আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে এটাই সঙ্ঘ পরিবার চাইছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে গণ-আওয়াজ উঠেছে তার প্রগতিশীল পুনঃনির্মাণ জরুরি।
মনে রাখতে হবে গতবাঁধা সংরক্ষণ রাজনীতির মাধ্যমে দলিত মানসকে আকৃষ্ট করার পর্যায় ভারতীয় রাজনীতিতে অতিক্রান্ত হয়েছে। দলিত-নিষ্পেষিত বহু জনগোষ্ঠী থেকে যে নতুন শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত শ্রেণি উঠে এসেছে, প্রগতিশীল রাজনীতির কোনো বিকল্প খুঁজে না পেয়ে নিজেদের ‘উচ্চকোটির’ বৌদ্ধিক সমাজের সমকক্ষ হিসাবে জাহির করতে সর্বভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির এক প্রচণ্ড ক্ষমতাবান সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তির কাছে তাঁরা আশ্রয় নিচ্ছেন, যাদের কাছে ‘ভারতমাতাই’ প্রধান, যা আধিপত্যকে বজায় রেখে কিংবা একে আরও সুদৃঢ় করে এক কাল্পনিক সমতার স্তরে মানুষকে নিয়ে যেতে পারে, একইসাথে ‘হিন্দু অস্মিতার’ নামে স্থানীয়ভাবে দুর্বল শত্রুও খুঁজে পায়।
সুতরাং সঙ্ঘ পরিবারের এই রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে জরুরি শ্রমিক শ্রেণিকে পথে নামানো। বাংলায় এই প্রগতিশীল রাজনীতির ঐতিহ্য রয়েছে, প্রয়োজন তার পুনঃনির্মাণ। কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক নীতি শ্রমিক-কৃষকের মধ্যে নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করে দিচ্ছে, কিন্তু বাংলায় এনিয়ে কোনো ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতি নেই। গণতন্ত্র, নাগরিকত্বের আন্দোলনের সাথে এই শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি, জরুরি দ্রুততার সাথে একাজ করা।
যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলনে যখন বিজেপি দল সর্বশক্তি নিয়ে নেমেছে, তখন আশ্চর্যজনকভাবে আমরা দেখলাম গণতন্ত্রের এই প্রশ্নে অন্য কোনো দল তাদের ইউনিয়নগুলিকে পথে নামালো না। ছাত্রদের পক্ষে শ্রমিকদের নামালে প্রগতিশীল রাজনীতি যেমনি এক ভিন্ন মাত্রা পেতো, ঠিক তেমনি ছাত্র-চেতনায়ও রেডিক্যাল রাজনীতির উন্মেষ ঘটার সুযোগ পেতো।
মমতা বন্দোপাধ্যায় কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে সৌজন্যমূলক আচরণ করতে থাকুন, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি যদি ভেবে থাকেন বিজেপি শিবিরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের ভূমিকা নিয়ে হিন্দু জনগণের কাছে বার্তা পাঠিয়ে তার ভোট বেস ধরে রাখবেন তাহলে তিনি ভুল করবেন। বেসরকারিকরণ, শ্রমিক ছাঁটাই, এনরেগার কাজ ও ফাণ্ড ইত্যাদি প্রশ্নে কেন্দ্র-বিরোধী ব্যাপক আন্দোলনের সাথে সাথে, নাগরিকত্ব-রাজ্যের হাতে ক্ষমতা ইত্যাদি গণতান্ত্রিক ইস্যুতে ব্যাপক আন্দোলন না করে বাংলায় বিজেপির উত্থান রুখে দেওয়া সম্ভব নয়।
প্রগতিশীল বামপন্থীরা কী এপথ মাড়াবেন, না তারাও ‘ছাত্ররা বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে’ বলে ভদ্দরলোকী বয়ানবাজী করবেন এবং মমতার দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিবৃতি না দিয়ে সকালে চায়ের কাপ মুখে তুলবেন না? মনে রাখতে হবে বাংলার তৃণমূল দুর্নীতি অসমের দুর্নীতির সামনে শিশু, কিন্তু অসমে তো এই বামেরা এরকম বয়ানবাজী করেন না। দুর্নীতিরও এক শ্রেণি মাত্রা থাকে, শ্রেণি রাজনীতিটাই প্রধান, সেই রাজনীতিতে বাংলায় গণ-জোয়ার আসুক, সেই সম্ভাবনা সেখানে রয়েছে। আমরা অপেক্ষায় রইলাম, বাংলা ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করার পথ দেখাবে।
কোন মন্তব্য নেই