Header Ads

পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি : সংশয় সম্ভাবনা !

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় : প্রতিবেশী রাজ্য অসমে যত সহজে এনআরসি (অসংখ্য ভুল-ভ্রান্তি পূর্ণ হলেও) করা গেছে পশ্চিমবঙ্গে তত সহজে তো নয়-ই, আদৌ করা যাবে কিনা তা নিয়ে ঘোরতর সংশয় থাকছেই। রাজ্যর চলতি বিধানসভা অধিবেশনে এনআরসি’র বিরুদ্ধে যে প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে তাতে বিজেপি’র জনা কয়েক বিধায়ক ছাড়া বাকি সমস্ত বিধায়ক ঐ প্রস্তাবের পক্ষে থেকেছেন--অর্থাৎ রাজ্য বিধানসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্যে এনআরসি’র বিপক্ষে আনা প্রস্তাব পাশ হয়েছে। রাজ্য বিধানসভা তথা রাজ্যসরকার না চাইলে কোন রাজ্যে এনআরসি করা যাবে না--সুপ্রিম কোর্টও বিধানসভা তথা রাজ্যসরকারের অসম্মতিতে এনআরসি জোর করে করাতে পারে না। 
অসমে পারা গিয়েছিল, তার কারণ, অসম সরকার এনআরসি চেয়েছিল। চেয়েছিল বিশেষ একটি কারণে। শুধুমাত্র অনুপ্রবেশ সমস্যায় জেরবার হওয়ার জন্যেই নয়--ভাষা ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অসমভাষীরা কালক্রমে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে--এই আশঙ্কা থেকেই এনআরসি’র মাধ্যমে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের নাগরিকত্ব নির্ণয় করে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে উদ্বেগমুক্ত হতে চেয়েছিল। তাদের এই নিরাপত্তাহীনতার জন্ম অনেক আগেই বাঙালি খেদাও অভিযান দিয়ে শুরু হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার দাবিতে একটি স্বাধীন দেশের মানুষকে ১৯ মে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। অসমীয়াভাষী সমস্ত রাজনৈতিক দল এনআরসি চেয়েছিল বলেই কংগ্রেস শাসিত সরকার এনআরসি প্রস্তাবে সায় দিতে দেরি করেনি। বেশ কিছু বিরোধিতার মুখেই সুপ্রিম কোর্টও এনআরসি’র ব্যাপারে সরকারকে পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেয়।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা আর অসমের সমস্যা এক নয়। পশ্চিমবঙ্গে ভাষাভিত্তিক আধিপত্যবাদের ব্যাপার নেই। পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা শুধুমাত্র অনুপ্রবেশের সমস্যা। বাংলাদেশী হিন্দু ও মুসলিম অনুপ্রবেশের চাপে পশ্চিমবঙ্গ যথেষ্ট বিব্রত বোধ করে আসছে অনেক দিন ধরেই। তবু পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সরকার চাইলেও খুব সহজে এনআরসি চাপিয়ে দিতে পারবে না। অসমে এনআরসি বিতর্ক তুঙ্গে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি ঘোষণা করেছিল একজনও বাঙালি হিন্দুকে অনাগরিক বানানো হবে না। বিপুলসংখ্যক শরণার্থী বাঙালি হিন্দু বিজেপি’র প্রতিশ্রুতিতে ভরসা পেয়ে তাদের ঢেলে ভোট দিয়েছে--কিন্তু বিজেপি তাদের প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি অগপ সহ অসমীয়া প্রাদেশিকতায় বিশ্বাসী নেতাদের চাপে। ফলে বিস্ময়করভাবেই এনআরসি’র পর বাঙালি হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ অনাগরিক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল। পরবর্তী নির্বাচনে এদের যদি ভোটাধিকার থাকে তাহলে বিজেপি উচিত শিক্ষা পাবে বলেই অসমের বাঙালি হিন্দুরা মনে করছেন। 
পশ্চিমবঙ্গেও অনুপ্রবেশকারী বাঙালি হিন্দুদের সংখ্যা মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের চেয়ে অনেক বেশি এবং এদের বেশিরভাগই এবারে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। কিন্তু অসমে বাঙালি হিন্দুদের দুর্দশা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এনআরসি হলে এই রাজ্যের বাঙালি হিন্দুদের কপালেও চরম দুর্দশা নেমে আসতে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’র পক্ষ থেকে এনআরসি’র দাবি যত তীব্র হবে তাদের পরিস্থিতি রাজ্যে তত খারাপ হতে থাকবে। সেটা কিন্তু ইতিমধ্যেই ক্রমশঃ স্পষ্ট হচ্ছে। 
যদিও অসম এবং বাংলার মানুষ জানে এ দেশ থেকে তাদের অন্য দেশে (বাংলাদেশে) পাঠানোর ক্ষমতা রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারের নেই।  কোটি কোটি টাকা খরচ করে খুব বেশি হলে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে না পারা অনুপ্রবেশকারীদের জন্য আশ্রয় শিবির বানিয়ে সেখানে রাখতে হবে। কিন্তু কত কাল তাদের সেভাবে রাখা যাবে? তাদের খাওয়া-দাওয়া-প্রজনন ইত্যাদি যাবতীয় জৈবিক প্রয়োজন আটকে রাখা যাবে? তাদের সংখ্যা রোহিঙ্গাদের মতোই হু-হু করে বাড়তে থাকবে। 
কারণ, এনআরসি’র মতো একটা অত্যন্ত সংবেদনশীল পদক্ষেপ গ্রহণের আগে কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশ-মায়ানমার-পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের দেশ থেকে অবৈধভাবে এ দেশে ঢুকে পড়াদের ফিরিয়ে নেওয়া সংক্রান্ত কোন চুক্তিই করা হয়নি। বাংলাদেশ-মায়ানমার-পাকিস্তান ফেরৎ নেওয়ার আগে প্রত্যেকের কাছে তাদের দেশের নাগরিকত্বের নথিপত্র দেখতে চাইবে--ভারতসরকার প্রমাণ করতে পারবে তারা বাংলাদেশ-মায়ানমার-পাকিস্তান থেকে ৭১ সালের পরে এ দেশে ঢুকেছে? না, তা প্রমাণ করা যাবে না--তাহলে তাদের তাড়ানো হবে কোথায়? প্রশান্ত মহাসাগরে না আলাস্কা পর্বতে? প্রত্যেককেই এদেশে রাখতে হবে--কয়েক হাজার আশ্রয় শিবির বানিয়ে তার মধ্যে হলেও। কিন্তু ঐসব আশ্রয় শিবিরে যারা জন্ম নেবে জন্মসূত্রে তারা কোন দেশের নাগরিক হবে? বাপ-ঠাকুরদার নাগরিবকত্বের পরিচয় দিতে না পারা লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্ম হয়েছে এ দেশে তাদের পরিচয় কি হবে? আসলে এত বড় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার আগে-পরের কোন ভাবনাই কাজ করেনি কর্তাদের মধ্যে। 
বিজেপি যদি সত্যি বাংলাদেশী মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার ব্যাপারেই তৎপর হত তাহলে অসমে একজন বাঙালি হিন্দুকে অনাগরিক তালিকাভুক্ত না করে মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করত। কিন্তু তারা সেটা পারেনি অসমের অসমীয়াভাষী প্রাদেশিকতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী  কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপি-অগপ নেতাদের চাপেই। পশ্চিমবঙ্গে যদিও এই প্রাদেশিকতার বিষাক্ত রাজনৈতিক বাতবরণ সেভাবে নেই--তবুও এ রাজ্যেও অসংখ্য বাঙালি হিন্দু চরম দুর্দশার শিকার হবেই এবং সেটা বিজেপি’র এনআরসি-আগ্রহে স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে। 
এর ফলে পশ্চিমবঙ্গে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল বেশ কিছুটা সুবিধা নিশ্চিতভাবেই পাবে। বিরাট সংখ্যক বাঙালি হিন্দু বিশেষ ভরসা করবে না বিজেপিকে। প্রাণের দায়ে না চাইলেও তৃণমূলকেই সমর্থনের কথা ভাববে তারা। কারণ তৃণমূল রাজ্যে ফের ক্ষমতায় ফিরলে এ রাজ্যে এনআরসি হবে না। হিন্দু শরণার্থীদের স্বার্থের দাবি করলেও বিজেপি অসমেও যেমন হিন্দু বাঙালিদের স্বার্থ দেখেনি--এ রাজ্যেও দেখবে না--এটা আর অস্পষ্ট নেই এখন।
এনআরসি’র আগে কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত ছিল বাংলাদেশ-মায়ানমার-পাকিস্তানের সঙ্গে এমন একটা চুক্তি সম্পন্ন করা যার মাধ্যমে অনুপ্রবেশকারীরাদের তারা ফিরিয়ে নিতে সম্মত থাকবে। কিন্তু সরকার তা করেনি। সুপ্রিম কোর্টও এরকম একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারকে নির্দেশ দেয়নি। ফলে লক্ষ লক্ষ অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত হলেও সরকার তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়ঙ্কর রকমের ল্যাজেগোবরে হবেই। সংশ্লিষ্ট এলাকা জুড়ে অরাজকতা এবং নৈরাজ্য মাথা চাড়া দেবে। ভোটের রাজনীতির কথা ভেবে এতবড় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভয়ঙ্কর নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হবে বিজেপিকেই।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.