Header Ads

রাষ্ট্ৰীয় নাগরিকপঞ্জিতে তালিকাছুটদের ভবিষ্যৎ কী হবে, তার সঠিক উত্তর নেই কারোর কাছে

 রিংকি মজুমদার

হায় বাঙালি তোর দেশ কোথায়? ওপার থেকে ধৰ্মীয় অত্যাচারের শিকার হয়ে এপারে এলি। বেশিরভাগ মানুষই সমস্ত কিছু খুইয়ে এপারে এসে তাদের আবার শূন্য থেকে নতুন করে সংসার শুরু হয়। এরপর দুই পুরুষ, তিন পুরুষ ধরে বসবাস করার পরও বাঙালিকে নাগরিকত্বের প্ৰমাণ দিতে হচ্ছে। গোটা ব্যাপারটিকে বাঙালি জাতির দুৰ্ভাগ্য ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে?  এখন প্ৰশ্ন হচ্ছে আইনগতভাবে আপাতত রাষ্ট্ৰহীন এই ১৯ লক্ষ ০৬, ৬৫৭ জন মানুষের ভবিষ্যত কী হবে? জানা গিয়েছে তালিকা ছুটদের বেশিরভাই নাকি বাঙালি হিন্দু। বাংলাদেশ তো আগেই বলে দিয়েছে এনআরসি সমস্যা ভারতের আভ্যন্তরীণ সমস্যা। সুতরাং শেষ তালিকা ছুটদের সে দেশ তো ফেরত নেবে না। তাহলে কী হবে রাষ্ট্ৰহীনদের। 

 ছবি, সৌঃ ইন্টারনেট
এদিকে এনআরসি-র আতঙ্ক ছড়িয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গেও। নাগরিকত্বের প্ৰমাণ পোক্ত করার জন্য বাংলায় ডিজিটেল রেশন কাৰ্ড তৈরি করতে গিয়ে লম্বা লাইনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন সাধারণ মানুষেরা। জানা গিয়েছে উত্তরবঙ্গে ডিজিটেল রেশন কাৰ্ড করতে গিয়ে অন্নদা রায় সহ আরেক জন মারা গেছেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্ৰী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার কেন্দ্ৰীয় স্বরাষ্ট্ৰমন্ত্ৰী অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করে বলেছেন- বাংলায় এনআরসি-র প্ৰয়োজন নেই। এক্ষেত্ৰে তিনি জানিয়েছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্ৰী নীতিশ কুমারেরও একই স্থিতি।

 রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এনআরসি নিয়ে নিজেদের মতামত পোষণ করে বলছেন- এনআরসি একটা প্ৰহসনে পরিণত হয়েছে। তালিকায় বাদ পড়েছে বহু নামিদামি ব্যক্তিত্বের। প্ৰচুর বাঙালি হিন্দু তো বটেই, নাম বাদ পড়েছে ‘খিলঞ্জিয়া’ভূমিপুত্ৰ অসমিয়ারও। কোচ-রাজবংশী, গোৰ্খা, রাভাদের মতো বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষের নাম বাদ পড়েছে। নাম বাদ পড়েছে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড০ চন্দন কুমার গোস্বামীর পরিবারের। নাম বাদ পড়েছে আইনজীবীর পরিবারের সদস্যেরও। 

দুঃখের বিষয়, তালিকা ছুটদের একটা অংশ সমাজের খুবই নিম্ন শ্ৰেণির। মানুষের বাড়িতে কাজ করে দুটো পয়সা উপাৰ্জন করে, কিংবা রিস্কা চালিয়ে, ঠেলা চালিয়ে এদের দৈনন্দিন জীবন  সংগ্ৰাম চলে। এবারে এরা নাগরিকত্ব প্ৰমাণের জন্য উপাৰ্জন করবে না দিনের পর দিন নথিপত্ৰ নিয়ে ফরেনাৰ্স ট্ৰাইব্যুনালের চক্কর কাটবে তা নিয়ে উঠেছে প্ৰশ্ন। এরা তো বেঁচে থাকতেই প্ৰাণহীন শরীরে পরিণত হয়েছে। এদের ভবিষ্যৎ কী হবে না কেন্দ্ৰ সরকার না রাজ্য সরকার, তা কারোরই জানা নেই। হয়তো এই এফটিগুলোতে শুনানি হবে। আইনের প্যাচে তালিকাছুটদের হয়তো আরও আট দশ বছর এভাবেই কেটে যাবে। আইন আদালতের পেছনে ছুটতে ছুটতে একটা প্ৰজন্ম এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে। কিছু করার নেই। সরকারী ঘোষণা মতে- শেষ তালিকা বেড়নোর ১২০ দিনের মধ্যে শেষ তালিকা ছুট ১৯ লক্ষেরও বেশি মানুষ ৩০০ টি ফরেনাৰ্স ট্ৰাইব্যুনানের মাধ্যমে ফের একবার আবেদন করতে পারবেন। তার জন্য আইনজীবীর পরামৰ্শ মতে ডিসি অফিস থেকে ‘সাৰ্টিফায়েড কপি অফ রিজেকশন অৰ্ডার’ জোগাড় করতে হবে। ফের জমা দিতে হবে প্ৰয়োজনীয় সমস্ত কাগজপত্ৰ। ১০ মাসের মধ্যে ট্ৰাইব্যুনাল তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে।

তাই তো অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলেছেন গুয়াহাটি হাইকোৰ্টের আইনজীবী এ এস তপাদার - এই এনআরসি যখন বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ্য করতে পারল না, আর কখনও কোনওদিনও বাঙালিরা এক হতে পারবে না। ওরা বাঙালি নয়, প্ৰথমে হিন্দু বাঙালি অথবা মুসলিম বাঙালি। খানিকটা অভিযোগের সুরেই তিনি এও বলেন- সাংবাদিকদের সংবাদ পরিবেশনের নমুনাও ওই একই। অমুক জায়গায় এতো সংখ্যক হিন্দু বাঙালি, এতো সংখ্যক মুসলিম বাঙালি তালিকা ছুট হয়েছে। এই সংকটের মূহুৰ্তেও আমরা আগে বাঙালি না হয়ে, আগে হিন্দু নয়তো মুসলিম।

কিছুদিন আগেও কেন্দ্ৰীয় স্বরাষ্ট্ৰমন্ত্ৰী অসমে এসে ঘোষণা করে গেছেন একজন বিদেশিরও ঠাঁই হবে না ভারতে। এনআরসি ছুট মানুষগুলো এখন দু চোখে সৰ্ষের ফুল দেখছেন। প্ৰতিনিয়ত ভয়ে ভয়ে কাটাচ্ছেন সময় তাদের চোখে একটাই ভয় তাদের কি তাহলে ভবিষ্যতে গোয়ালপাড়া জেলার ডিটেনশন ক্যাম্পগুলিতে থাকতে হবে।  গোয়ালপাড়ার মাটিয়ায় প্ৰায় ২০ হাজার একর জমির ওপর ৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্ৰতিদিন সাড়ে চারশ থেকে পাঁচশো কৰ্মী কাজ করে চলেছেন ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরির। জানা গিয়েছে এই ক্যাম্পগুলি নাকি তৈরি করছেন খোদ তালিকা ছুটরাই।

গত ৩১ আগস্ট এনআরসি-র শেষ তালিকা প্ৰকাশ হয়। তারপরও কত বাঙালি এতো অপমান জ্বালা যন্ত্ৰণার জীবন থেকে রক্ষা পেতে আত্মহত্যার পথকেই বেছে নিয়েছেন। হোজাই জেলার উদালি কাছাড়ি গ্ৰাম পঞ্চায়েতের গরীব কৃষক রহিমউদ্দিন কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্মা করেছেন। বঙাইগাঁও জেলার নাসোনগুড়ি গ্ৰামে আহিমন খাতুন নামের ৭০ বছর বয়সের বৃদ্ধা পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্মা করেছেন। এনআরসিতে মোট ৯ বার শুনানিতে হাজিরা দেওয়ার পরও তাঁর নাম রিজেক্টেড লিস্টে। কলিয়াবরের বরঘুলিয়া গ্ৰামে ৩৬ বছর বয়সের রহিমা বেগম গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। বরাকের হাইলাকান্দির সাবিত্ৰী রায় নামের এক মহিলা গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এনআরসি-র জ্বালা যন্ত্ৰণায় গত কয়েক বছরে প্ৰায় অৰ্ধশতাধিক মানুষ নিজের প্ৰাণাহুতি দিয়েছেন। একের পর এক মৃত্যু মিছিল হয়ে চলেছে, বিষ্ময়ের কথা এখনও নাকি কেন্দ্ৰীয় সরকারের কানে গিয়েই পৌঁছয়নি। এনআরসি-র আগুনে আগামী দিনে আরও যে কত মানুষের প্ৰাণ যাবে সেই উত্তর কারও জানা নেই। এনআরসি ছুটরা যেখানে ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকবে তারপর তাদের পরবৰ্তী প্ৰজন্মকে কেন্দ্ৰীয় সরকার সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ দিতে পারবে কি না তার উত্তরও কারও কাছে নেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে শাসক দল বিজেপি এনআরসি-র আগুনে হাত তো দিয়েছে। এবারে রাজনৈতিক টোনাপোরনই হোক কিংবা বিরোধী দলগুলির চাপ, শাসক দল নিজেদের স্থিতি থেকে না এগোতে পারছে, না পিছোতে পারছে। এর শেষ যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সময়ই বলবে।



কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.