Header Ads

দাদ্রী থেকে বিশ্বনাথ – কিছু যাতনা, কিছু চেতনা


আজমল হুসেন, কোলকাতা  

রেড মিট বলতে এক সময় শুধু খাসির মাংসই আসতো আমাদের বাড়িতে। দাদ্রীর ঘটনার পর থেকে আর আনা হয়না, তবে তা কোনো নিরাপত্তাহীনতা থেকে নয়। আমি কোলকাতার এমন একটি এলাকায় থাকি, যেখানকার মানুষ সুশিক্ষিত। নিজেদেরকে বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবেই মনে করেন এবং সেভাবেই জীবন যাপন করেন। তেমন একটি জায়গায় বসবাস করলে তো নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্নই ওঠেনা। আমাদের বাড়িতে খাদ্যাভ্যাসে এই পরিবর্তন আসে দীর্ঘদিনের চেপে থাকা অভিমান থেকে- নিজের উপরই এই অভিমান।
যে পরিচয় নিয়ে আমার জন্ম হয়েছিল, তাতে তো আমার হাত নেই। তাহলে সেটা আমার প্রকৃত পরিচয় কি করে হয়? শৈশব থেকেই তাড়া করতো এই প্রশ্নটি। কাউকে জিজ্ঞাসা করলেও সন্তোষজনক উত্তর পেতাম না, তাই সেই পরিচয়কে গুরুত্ব দিতে পারিনি। বোধোদয়ের পর থেকেই নিজেকে মানুষ হিসেবে চেনার চেষ্টা করে গেছি। যতই চেষ্টা করেছি, মানবধর্মের ওপর আস্থা ততই দৃঢ় হয়েছে। মানুষ হিসেবে নিজের কাছে আমার পরিচয় এভাবেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর অন্য কোনো পরিচয় আমার মনের মধ্যে দাগ কাটতে পারেনি। বারবার যখন ক্ষমতাশালী অত্যাচারী মানুষের হাতে নিরীহ অসহায় মানুষের নিগ্রহ-নির্যাতন-দমন-দলন-নিধন দেখতাম, তখন আমার মানুষ হয়ে বাঁচার জন্য বেছে নেওয়া পথ – মানবধর্ম - যারপরনাই আহত হতো। কিন্তু নিজে কিছু করে উঠতে পারতাম না, তাই নিজের ওপর নিজের অভিমান জমতে থাকতো। এভাবে অভিমান জমতে জমতেই দাদ্রী অব্দি পৌঁছয়, এরপরও আরো অনেক জমেছে, আজও জমছে। যখন না খাওয়াটা অভ্যেস হয়ে গেল, মনের মধ্যে এর স্বপক্ষে যুক্তি দানা বাঁধতে শুরু করল, হয়তো এমনটা অনেকেরই হয়। আমরা যে কাজই করে থাকি বা যেটা করা থেকে বিরত থাকি, একটা সময় তার স্বপক্ষে যুক্তি খাঁড়া করবার প্রবনতা আমাদের মধ্যে আসে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় আরও কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে থাকে, সমসাময়িক বন্ধুদের আচরণেও কিছু তফাৎ চোখে পড়ে, যুক্তিগুলোও আস্তে আস্তে পাকাপোক্ত বলে মনে হতে থাকে। যদিও আমার কর্মজীবনের সিংহভাগই বাংলায় কেটেছে, কর্মসূত্রে দেশের অনেক জায়গায় অনেক সময় ঘুরে বেড়াতে হয়েছে, অনেক জায়গায় থাকতে হয়েছে। একবার মনে হল এই পাল্টে যাওয়া অভ্যেসের জন্য বাংলার বাইরে দেশের অন্য কোথাও আবার থাকতে গেলে জীবনের ঝুঁকিটা একটু হলেও কম থাকবে। তাছাড়া, কোনও কিছুকেই চিরস্থায়ী বলে ধরে নেওয়াতেও তো ঝুঁকি থাকতে পারে। আজ তো এই এলাকার সুশিক্ষিত, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সংস্কৃতিবান মানুষ পরপস্পরের ওপর ভরসা রাখেন, সুখে-দুঃখে সবাই সবার পাশে থাকেন, কিন্তু কাল কি হবে তা কেই বা জানে। পরিস্থিতি পাল্টে গেলে দেশের অন্য অনেক জায়গার মতো যখন-তখন গুজবের শিকার হয়ে যেতে পারি। মব লিঞ্চিং হয়ে যেতে পারে। আমার মৃত্যু হয়ে গেলেও মাংসটা কিসের ছিলো তা নিয়ে রাজনৈতিক চাপান-উতোর চলতে থাকবে। এক একটি পরীক্ষাগার এক একটি দলের হয়ে রিপোর্ট দেবে। কিন্তু অঘোরে হারানো প্রাণটি আর ফিরে আসবে না। মৃত্যুকে যদিও ভয় পেয়ে লাভ নেই - অমর হয়ে যখন জন্মাইনি, একদিন তো সে আসবেই - কিন্তু জেনেশুনে এমন মৃত্যু তো চাইতে পারিনা যা বেঁচে থাকা আপনজন-প্রিয়জনদের বাকী জীবন অভিশপ্ত করে দেয়। এভাবে আগে কখনও ভাবিনি, কিন্তু দাদ্রীর ঘটনাটি আমাকে অদ্ভূতভাবে ভাবিয়েছিল। নতুন করে বুঝতে হয়েছিল - সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস যখন তখন মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। ঠিক যেমন এক্ষেত্রে হয়েছিল। দাদ্রীতে যিনি গ্রামবাসীদের হাতে প্রাণ হারালেন, তিনিও তো নিশ্চয় বিশ্বাস করেছিলেন সবাইকে। সেই উন্মত্তদের ভিড়ে ওনার চেনা প্রতিবেশীরাও ছিলেন, হয়তো তাঁদের মধ্যেও পারস্পরিক বিশ্বাস ছিল। বিশ্বাস ছাড়া তিনি ওখানে এতো বছর থাকলেন কি করে? হয়তো ভালও বেসেছিলেন প্রতিবেশীদেরকে। সেই ভালোবাসাও হয়তো পারস্পরিক ছিল। এমনও হতে পারে যে তিনি তাঁর কোনও ভালোবাসার মানুষের হাতেই প্রাণ হারিয়েছেন। এমনও হতে পারে যে প্রথম আঘাত হেনেছিল সেও একদিন ভালোবেসেছিল ওনাকে। সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে এসব আবেগ বা বিশ্বাস সবই মূল্যহীন হয়ে যায়। যদিও সবাইকে বোঝাতে পারিনি নিজের ওপর এই ক্ষোভ বা অভিমানের কথা, যাঁদের সাথে সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ, তাঁদের কেউ কেউ আমার পরিবারের খাদ্যাভ্যাসের এই পরিবর্তনের কারণটা জানেন এবং বুঝতেও চান। আমার স্ত্রী বা আমি কিন্তু আমাদের ছেলেকে তা এখনও বলতে পারিনা। ওকে অন্যভাবে বুঝিয়ে রাখতে হয়েছে। রেড মিট থেকে শরীরের উপকারের চেয়ে অপকারই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, এরকম একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়ায় চেষ্টা করেছি। বাকিটা আশাকরি সঠিক বয়সে ও বুঝতে পারবে, আর মা-বাবাকে এই গোঁজামিলের জন্য ক্ষমাও করে দিতে পারবে। তাছাড়া সকল মানুষ যদি প্রকৃত অর্থে একদিন মানবধর্মী হয়ে যায়, তখন এসবের তো কোনো প্রয়োজনই থাকবেনা।
কর্মসূত্রে যখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় থেকেছি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমার নাম শুনেই মানুষ আমাকে একটি বিশেষ পরিচয়ে দেগে দিতেন। যদিও সবার কাছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক, আমি খুব আহত বোধ করতাম, কেননা আমার আত্মায় এই পরিচিতি কখনো স্বীকৃতি পায়নি। তবুও সইয়ে নিতে হতো, কারণ এছাড়া উপায় ছিলনা। তবে পরিচয়ের গভীরতা বাড়লে এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আমাকে সত্যি সত্যি ভালোও বাসতেন, আমিও তাঁদেরকে ভালোবেসে ফেলতাম, তখন অন্য সব যাতনা গৌণ হয়ে যেতো। ভালোবাসাটাই মুখ্য হয়ে রয়ে যেতো, এভাবেই মানবধর্মের প্রতি বিশ্বাসও অটুট থেকে যেতো। পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা এই বাংলায়, যেখানে প্রায়ই দেখেছি মানুষের কাছে শুধু আমার মানবিক পরিচয়ই প্রাধান্য পায়। এখানে এসে অন্য জায়গার চেয়ে অনেক বেশি করে দেখলাম মানুষের কাছে আমি মূলত মানুষই, আর বাংলায় কথা বলি তাই আমি বাঙালি মানুষ হিসেবেই পরিচিত। ভাষার প্রতি আবেগটা আমারও অটুট রয়ে গেছে, আর সেটা আজীবন থেকেও যাবে। বাংলায় এসে প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলাম আমার দেশে এখনও অন্তত একটি এমন জায়গা রয়েছে, যেখানে মানুষের কাছে আমার প্রকৃত পরিচয়ের মর্যাদা আছে। বলাই বাহুল্য, যারপরনাই ভালোবেসে ফেলি এই জায়গাটিকে, এখানকার মানুষকে। থেকে যাই এখানেই, আমারই ভাবনার সাথে মানানসই একজন আদ্যোপান্ত বাঙালি মানুষ হয়ে।
কিন্তু আজকাল পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। যাঁদের ভালোবাসা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল, বা যাঁদেরকে ভালোবেসে আমি এসে থেকে গেছিলাম, তাঁদের অনেকেরই মানবিক মূল্যবোধ অনেকটাই এখন বিভেদের, উগ্রতার ও বিদ্বেষের রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত। কর্পোরেট মিডিয়ার মায়াজালে পড়ে কিছু প্রতারক শক্তির প্রতি সহসা তাঁদের কারুর কারুর অভাবনীয় আনুগত্য দেখা যাচ্ছে। এই পরিবর্তনও আশংকার একটি কারণ, বিশেষ করে অনেক সন্মানীয় ও শিক্ষিত মানুষ যখন এই শক্তির মধ্যেই স্থানীয় নেতৃত্বের যাবতীয় অরাজকতা ও অপারগতার বিকল্প দেখতে চাইছেন। অথচ এদের মদদপুষ্ট সাম্প্রদায়িক উস্কানি এবং ধ্বংসলীলার ইতিহাস তাঁদেরও জানা। একসময় আমাদের মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনাও হতো। আজকাল কিন্তু তাঁদের কেউ কেউ আমাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন, আমার সাথে যোগাযোগও কমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমি তো এঁদেরকে এড়িয়ে চলতে পারিনা, এঁদের ভালোবাসা যে অনেক আগেই আমাকে ঋণী করে রেখেছে। আমিও যে তাঁদের সবাইকে ভালোবেসে ফেলেছি। আশংকা হয়, যে পুণ্যভূমিকে ভালোবেসে আমি এখানেই রয়ে গেছি, সেই পুণ্যভূমিকে কোনও অশুভ শক্তি এসে বধ্যভূমি বানিয়ে দেবে না তো ? কথায় তো আছেই – “ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়।” এমন বধ্যভূমিই তো আমি আসামে দেখে এসেছি। দেখেছি সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে এক মুহূর্তেই মানুষকে পরস্পরের পরম বন্ধু থেকে জাতশত্রু হয়ে যেতে। দেখেছি নির্বিচারে নিরীহ মানুষের ওপর প্রাণঘাতি হামলা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জাত-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষকে স্বজনহারা হতে দেখেছি, সর্বহারা হয়ে কারুর না কারুর আশ্রয়ে দিনের পর দিন পড়ে থাকতে দেখেছি।
ইদানিং আমার জন্মভুমি আবার উগ্র জাতিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার কবলে। ঘৃণার উৎসবে আবার মেতে উঠছে আসাম। অসহায় নিরীহ মানুষ নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন, নিগৃহীত হচ্ছেন। জোর করে একজন ধর্মপ্রাণ মানুষকে শুয়োরের মাংস খাওয়ানো হচ্ছে (বিশ্বনাথ চারি-আলির সাম্প্রতিক ঘটনা), যেটাকে কিনা তিনি সারাজীবন নিষিদ্ধ বলে মেনে এসেছেন । এইসব ঘটনা দেখেও আশংকা বাড়ছে।
আমি তো এখানকার সবাইকে মানুষ হিসেবেই ভালোবেসেছি। পাড়ার ছেলেরা পুজো বা অন্য যে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময় প্রায়ই সবার আগে আমার কাছে আসে। তাদের ধারণা - তাদের এই কাকু কখনও বলবেনা 'পরে এসো', আর প্রয়োজনে এই কাকুর কাছে বাড়তি আবদার ও করা যায়। আমার উপর ওদের এই ভরসা আমার কাছে এক অনন্য প্রাপ্তি। পাড়ার বয়োজৈষ্ঠ্যরাও আমাকে খুব স্নেহ করেন – কারুর কাছে আমি অনুজপ্রতিম, আবার কারুর কাছে পুত্রসম - এও এক অসামান্য প্রাপ্তি, যাতে রয়েছে এক ঐশ্বরিক অনুভূতি। এইসব প্রাপ্তি নিয়েই থাকতে চাই যতদিনই বাঁচি। পারবো তো? এইসব প্রশ্নও যে আমাকে একদিন তাড়া করতে পারে তা আগে কখনো ভাবিনি। কিন্তু আজকাল উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং পক্ষপাতদুষ্ট কর্পোরেট মিডিয়ার ওপর মানুষের অগাধ আস্থা এবং হয়তো কিছুটা তারই ফলস্বরূপ আমার একান্তই প্রিয় কিছু মানুষের ব্যবহারে যে আমূল পরিবর্তন দেখছি, তা আমাদের সংস্কৃতির পরিপন্থী মনে হচ্ছে, তাই চিন্তা হচ্ছে। মন তবুও চাইছে ইতিবাচক থাকতে, কেননা এখনও অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে কাছে পাচ্ছি, পাশে পাচ্ছি। সমাজে এখনও বিভেদকামী, হিংসাপরায়ন ও বিদ্বেষবিলাসী মানুষের তুলনায় প্রকৃত অর্থে বিবেকবান, শান্তিকামী ও মানবদরদী ভালমানুষের সংখ্যা অনেক বেশি, এই বিশ্বাস নিয়েই থাকতে চাইছে মন। এখনও অনেকেই আছেন যাঁদের শুভবুদ্ধি মিডিয়ার মায়াজাল গ্রাস করতে পারেনি। তাঁরা এখনও গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যারই মানবিক সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন। ভাবার অভ্যেসটা এখনও আছে তাঁদের, তাই সুস্থ আলোচনার মাধ্যমেই যে কোনও বিষয়েরই গভীরে গিয়ে সত্যকে জানতে চান, জানাতেও চান এবং ইতিবাচক সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরা সবাই আজ একত্রিত নন, মনে হচ্ছে এই  সন্ধিক্ষণে তাঁদের একত্রিত হওয়াটা খুব দরকার। তাঁদের জন্যই ভাবতে ইচ্ছে করে – হয়তো শেষ পর্যন্ত মানবতাই জয়ী হবে, সংস্কৃতিবান বাঙালীর সদ্ভাবনা ও সম্প্রীতির প্রত্যয়ের কাছে হার মানবে বিভেদকামী ও বিদ্বেষবিলাসী অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তি, বেঁচে থাকবে মানবধর্ম। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.