‘উজান সাহিত্য গোষ্ঠী’ পালন করল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস; উন্মোচিত হলো নীলদীপ চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থ
প্রতিবারের
মতো এবারেও ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, বৃহস্পতিবার তিনসুকিয়ার উজান সাহিত্য গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
দিবসটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানসূচীর মধ্যদিয়ে শ্রদ্ধার
সঙ্গে পালন করল।
এবারের
কর্মসূচী শুরু হয় সপ্তাহ দুই আগেই। ৩রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, রবিবার সকাল ৯টা
৩০মিনিটে দুর্গাবাড়ি শিশু বিদ্যালয়ে এবং
২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ৯টা ৩০ মিনিট থেকে দুর্গাবাড়ি প্রাঙ্গণে রেখায়-লেখায়
‘আঁকা এবং লেখা’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ৩ তারিখের প্রতিযোগিতা চারটি বিভাগে
বিভক্ত ছিল। তাতে ‘বর্ণপরিচয়’, ‘হাসিখুশি’, কুঁহিপাঠ’, ‘সহজপাঠ’, ‘আবোলতাবোল’ থেকে
কিছু বিখ্যাত ছড়া, কবিতা পঙক্তি ছবিসহ দিয়ে দেওয়া হয়। সেগুলো দেখে প্রতিযোগীদের
সেই পঙক্তি বা কথাগুলো লিখে সেই আদলে ছবি আঁকতে বলা হয়। মাতৃভাষা-মাধ্যমের শিক্ষার
পরম্পরার সঙ্গে শিশু কিশোরদের পরিচয় করিয়ে দেবার স্বার্থেই এমন ভাবনা ভেবেছিল
‘উজান’। এদিনে
প্রতিযোগীদের সঙ্গে আসা অভিভাবকদের ব্যস্ত রাখবার জন্যে তাৎক্ষণিক ভাবে আয়োজন করা
হয়েছিল ‘টপ্পাবল’ খেলার প্রতিযোগিতা। ২১শের সকালে প্রতিযোগিতা সবার জন্যে উন্মুক্ত
ছিল। সেদিনও প্রতিযোগিতা বিষয় হিসেবে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
দিবসের সংগ্রাম এবং ঐতিহ্য’, অথবা ‘মাতৃভাষার মান’। অথবা কবি হীরেন ভট্টাচার্য, বিজয়
ভট্টাচার্য এবং রবীন্দ্রনাথের চারটি কবিতার কিছু পঙক্তি তুলে দিয়ে সেগুলো অনুসরণ
করে চিত্রপটে ছবি আঁকতে বলা হয়েছিল।
দুদিনেই তিনসুকিয়া-ডিব্রুগড় জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রচুর প্রতিযোগী
উৎসাহের সঙ্গে এসে যোগ দেন।
২১শের
মূল অনুষ্ঠান তথা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিকেল ২টা ৩০ মিনিটে দুর্গাবাড়ি পূজা
মণ্ডপে বিজয়ীদের পুরস্কার বিতরণ করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে গান কবিতা সহ
বিচিত্রানুষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিবারের মতো এবারেও আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছিল দুই বিশেষ
বক্তা, যারা বেঁধে দেওয়া বিষয়ে বক্তৃতা করে শ্রোতাদের সমৃদ্ধ করেন। কবি, লেখক
অনুবাদক অতুল চন্দ্র শর্মা বলেন ‘অনুবাদ সাহিত্য আরু মোর অভিজ্ঞতা’ নিয়ে, আর
সমালোচক, প্রাবন্ধিক বাসব রায়ের বলবার বিষয় ছিল
‘ভাষা এবং জীবিকা’
২১শের সকাল ১০টায় বাসব রায় শহীদবেদীতে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা
করেন। সঙ্গে উজানের শিল্পীরা গেয়ে উঠেন একুশের গান ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে
ফেব্রুয়ারি’। এর পরে উজান সাহিত্য গোষ্ঠীর সভাপতি সুজয় রায় সংগঠনের পতাকা
উন্মোচন করেন। উজানের শিল্পীরা তখন গান করেন ‘শুভ কর্মপথে’ গেয়ে উঠেন। এর পরেই
শুরু হয় আঁকার প্রতিযোগিতা। গোটা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ‘উজান’ সম্পাদক ভানু ভূষণ
দাস।
বিকেল
তিনটায় একুশের মূল অনুষ্ঠানও শুরু হয় একুশের গান ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে
ফেব্রুয়ারি’ এবং ‘চির চেনেহি মোর ভাষা জননী’ দিয়ে। দুটি গানই করেন জীবন সরকারের
নেতৃত্বে উজানের শিল্পীরা। বাকি শিল্পীরা ছিলেন শিলা দে সরকার, বর্ণালি সেনগুপ্ত,
বিনায়ক সেনগুপ্ত, মুনমুন চৌধুরী এবং মিতালি মালাকার। উপস্থিত অতিথিরা তখন শহীদ
বেদিতে ফুল ছড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাতে থাকেন।
এর পরে দুই অতিথি অতুল চন্দ্র শর্মা এবং বাসব রায়কে উত্তরীয়, একটি করে
স্মারক এবং উপহার দিয়ে বরণ করেন যথাক্রমে সবিতা দেবনাথ এবং শিলা দে সরকার। দুই
বিচারক রাজেন খাউণ্ড এবং অজয় ভট্টাচার্যকেও উত্তরীয় এবং স্মারক দিয়ে সম্মান জানান
উজান সম্পাদক ভানু ভূষণ দাস। এরপরে আবারও
উজানের শিল্পীরা পরিবেশন করেন সমবেত সঙ্গীত ‘মোদের গরব মোদের আশা আহ মরি বাংলা
ভাষা’। সভাপতি
সুজয় রায় সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে জীবন সরকার, ইন্দ্রাণী বরপূজারী,
বর্ণালি সেনগুপ্ত, শিলা দেব সরকার প্রত্যেকেই আলাদা করেও এক একটি গান শুনিয়ে
স্রোতাদের মুগ্ধ করেন। আবৃত্তি করে শোনান রুদ্র নারায়ণ চৌধুরী এবং মুনমুন চৌধুরী।
এছাড়াও বিভিন্ন ভাষাতে নিজেদের লেখা কবিতা পড়ে শোনান নীপদীপ চক্রবর্তী, রাজেন
খাউন্ড,ইন্দু বরকটকী, মঞ্জরি বরুয়া, মরমী বরবরা, বানু বরদলৈ, সান্ত্বনা
বুঢ়াগোঁহাঞি,গৌতম বরঠাকুর, মায়া চৌবে, ববিতা প্রসাদ, নিহারিকা দেবী প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে নীলদীপ চক্রবর্তীর নতুন
কবিতা সংকলন ‘পোয়েটিক জানালায়
কবিতার মেঘ’ উন্মোচন করেন বাসব রায়। অতুল চন্দ্র শর্মা তাঁর বক্তব্যে নিজের
অনুবাদের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। জানান সম্প্রতি তিনি অসমিয়া কবি পুণ্য শইকীয়ার
একখানা কবিতা বই বাংলাতে অনুবাদ করবার সাহস করেছেন। তিনি বললেন,
অসমিয়া তাঁর মাতৃভাষা, বাংলা তাঁর ধাত্রীভাষা
৷ তিনি আহ্বান জানালেন বাঙালিরা উৎকৃষ্ট অসমিয়া সাহিত্যের অনুবাদ করুন! তাতে দুই
ভাষাই সমৃদ্ধ হবে। বাসব রায় তাঁর বক্তব্যে জানান আজকের সময়ে মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা
করবার কোনো কারণই নেই। জীবীকার জন্যে ইংরেজিটা জানতে হবেই এই কথারও কোনো মানে নেই।
কেবল মাতৃভাষা জানলেই কীভাবে ছায়াছবি, দূরদর্শনের স্ক্রিপ্ট লিখে রোজগার করা যেতে
পারে তিনি সেই সব তথ্যের উল্লেখ করেন। বিজ্ঞাপন বা সরকারি বেসরকারি পুস্তিকার
জন্যে যে আজকাল কী ব্যাপক ভারতীয় ভাষার অনুবাদকের দরকার পড়ে এবং মেলে খুবই নগণ্য
সংখ্যক সেই সব তথ্য দিয়ে বলেন, কেবল বাংলা বা অসমিয়া জেনেই যে কেউ মাসে প্রচুর
অর্থ উপার্জন করতে পারেন। অনুবাদ করতে গিয়ে ভাষার কিছু প্রাসঙ্গিক সমস্যার কথাও
তিনি তুলে ধরেন। দুজনের বক্তৃতাই শ্রোতাদের বেশ উদ্বুদ্ধ করেছেন দেখা গেছে। প্রায় শখানেক
দর্শকে দুর্গাবাড়ি প্রাঙ্গণ শেষ অব্দি ভরে ছিল।
শেষ পর্বে ৩ তারিখের বিভিন্ন প্রতিযোগিতাতে
বিজয়ীদের একটি করে প্রমাণ পত্র এবং ফলক দিয়ে সম্মান জানান অতুল চন্দ্র শর্মা।
এদিনের বিজয়ীরা ছিল ক-বিভাগে প্রথম শিষ্টাচার প্রিয়দর্শনী কোঁঅর, দ্বিতীয় স্বস্তিকা দে, তৃতীয়
বৃষ্টি শইকীয়া; খ-শাখাতে প্রথম জ্ঞানম গৌরব, দ্বিতীয় শ্রেয়া মজুমদার, তৃতীয় সুজিতা
রায়; গ-শাখাতে প্রথম দৃষ্টি লস্কর, দ্বিতীয় স্নেহা রায় তৃতীয় অনুশা দৈমারি;
ঘ-শাখাতে প্রথম রুবি কর্মকার, দ্বিতীয় রুসালি রায়, তৃতীয় অবন্তিকা দাস। তিনি ৩
ফেব্রুয়ারি সকালে অভিভাবকদের নিয়ে আয়োজিত টপ্পাবল প্রতিযোগিতাতে বিজয়ীদের হাতেও
পুরস্কার তুলে দেন। প্রথম হয়েছিলেন রাণু পাল, দ্বিতীয় গৌরি দত্ত ভৌমিক এবং তৃতীয়
সুমিত দাস। ২১শের সকালের চিত্রপটে ছবি
আঁকার প্রতিযোগীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন বাসব রায়। বিজয়ীরা ছিলেন প্রথম বিশ্বজিত দাস, দ্বিতীয় কঙ্কণ দাস, তৃতীয় অঙ্কিতা দত্ত।
অনুষ্ঠান শেষে দিনের
পরিকল্পনা এবং প্রাপ্তি নিয়ে একটি ছোট বক্তব্য রাখেন এবং সবাইকে ধন্যবাদ জানান অধ্যাপক সুশান্ত কর। গোটা
অনুষ্ঠানের সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন বাচিক শিল্পী ত্রিদিব দত্ত।
কোন মন্তব্য নেই