Header Ads

অসমে বাঙালিদের অস্তিত্ব ও অবদান এবং সাম্প্ৰতিক এন আর সি সংকট (৩)

ইতিহাসের আলোকে অসমীয়া বাঙালি সম্পৰ্ক

প্ৰদ্যোৎ গোস্বামীঃ বাসুগাঁও
ভাষার স্বাতন্ত্ৰ বজায় রাখলেও বাঙালিরা এরাজ্যে কখনই প্ৰভূত্ব বিস্তার করতে চায়নি। যদি চাইতো তবে রাজ্যের পরিস্থিতি আজ অন্যরকম হতে পারতো। মনে রাখতে হবে পিতা যদি ‘স্বৰ্গ' হয় তবে মাতাও কিন্তু স্বৰ্গাদপী গরিয়সী। আর যে বৰ্ণমালার সঙ্গে ‘মা' নামক বৰ্ণমালার সরাসরি যোগাযোগ, তাকে নিয়ে একটু গৰ্ব বা অধিকারবোধ থাকাটাই তো স্বাভাবিক। বাড়িতে বা পরিজনদের সাথে মাতৃভাষায় কথা বলা, স্বীয় ভাষার ঈশ্বরতুল্য কবি সাহিতি্যক বা মনিষীদের নিয়ে আলোচনা বা তাঁদের জন্য স্মরণানুষ্ঠানের সামান্য আয়োজন কি অপরাধ? দেশের সংবিধান কি আমাদের সে অধিকার দেয়নি/ বহিৰ্ভারতে বা দেশের অন্যান্য প্ৰান্তে বসবাসকারী প্ৰবাসী অসমীয়ারা যখন সেখানে পালনাম বা বিহুর আয়োজন করেন, তখন একজন অসমবাসী হিসাবে গৰ্বে আমাদের বুকটাও কি ফুলে উঠেনা। ঐ তো সেদিন অসমের বাংলাভাষী সন্তান সায়ন পাল জী-বাংলা সা রে গা মা পা'এর মঞ্চে পরম্পরাগত অসমীয়া পোষাক পরে, ঢোল-পেপা বাজিয়ে বিহুর সুরে সকলকে মাতোয়ারা করলেন। এসবের মধ্য দিয়ে তার অসমপ্ৰীতিই কি ফুটে উঠেনি? কলকাতার বুকে লোক-সংগীতের সৰ্ববৃহৎ উৎসব ‘সহজ পরবে' লোক-সঙ্গীতের অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব প্ৰায়াত কালিকা প্ৰসাদ ও সৌমেন ভারতীয়া জনপ্ৰিয় কণ্ঠশিল্পী সীমান্ত শেখরকে নিয়ে গিয়ে সেখানে অসমের বিহুকে বিশেষ মৰ্যাদার সঙ্গে জায়গা করে দিলেন, একি তাদের অসম প্ৰেম নয়। আমরা অসম মাতৃর সন্তান। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা হলেও অসমীয়া কিন্তু আমাদের ধাতৃভাষা। বাংলা যদি দৈবকী হয় তবে অসমীয়া ভাষা হল যশোদা। দুইয়ের প্ৰতিই আমাদের সমান শ্ৰদ্ধা।
ভাষাতো বহমান নদীর মতো। দুকুলের হাসি কান্না আনন্দ বিষাদ গল্প গাঁথা নিয়ে নিরলস তার বয়ে চলা। নদী বয়ে চলে তার শাখানদী উপনদীকে সঙ্গে নিয়ে, স্বাধীন ও নিরন্তর গতিতে। তবু যে দায়বদ্ধ। মোহনায় তাকে পৌঁছতেই হবে। তবে কেন আমরা ভাষানদী গুলোর গতিপথ দ্ধ করতে চাই। আমরা ভুলে যাই যে নদীর গতিপথ দ্ধ করা যায়না, আর করতে গেলে প্ৰলয় অবসম্ভাবী (কথাটা উভয় পক্ষের সমান প্ৰযোয্য)। প্ৰত্যেক গোষ্ঠী ও সম্প্ৰদায় তার নিজের মতো করে বাঁচবে, সেই সঙ্গে অন্যদেরকে সসম্মানে বাঁচতে দেবে। এই সত্যটাকে মেনে নিলে স্বৰ্গের খোঁজে আমাদের হয়তো আর ভিন লোক পাড়ি দিতে হবে না। এই পৃথিবীটাই হয়ে উঠবে স্বৰ্গসম।
এই ভাষার সংকট ও সংরক্ষণ প্ৰসঙ্গে যে বিষয়টিকে আমার সৰ্বাধিক গুত্বপূৰ্ণ বলে মনে হয় অথচ কোথাও কোন আলোচনাতেই সেটাকে তেমনভাবে উত্থাপিত হতে দেখিনা সেটাও একটু বলি। যে মাতৃভাষাকে নিয়ে আমরা এমন ভাবে লড়ে যাচ্ছে, একে অপরের সঙ্গে, প্ৰাণাহুতি দিতেও পিছপা থাকছিনা, সেই প্ৰাণের মাতৃভাষা উত্তরাধিকার সূত্ৰে আমরা যাদের কাছে দিয়ে যাব অৰ্থাৎ আমাদের পরবৰ্তী প্ৰজন্মের কাছে, সেটা তাদের কাছে সুরক্ষিত থাকবে তো? আজকের প্ৰজন্ম, (ভবিষ্যৎকে না হয় বাদই দিলাম) মানে অন্ততঃ দশ থেকে কুড়ির ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে তারা কিন্তু স্বীয় মাতৃভাষার চেয়ে হিন্দী বা ইংরাজী ভাষাতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। কিছু অতীব অনগ্ৰসর গ্ৰামকে বাদ দিলে শহর, অৰ্ধশহর এমনকি গ্ৰাম গঞ্জের ছেলে মেয়েরাও এখন কেবল টিভি ও ইংরাজী মাধ্যমের দৌলতে নিজেদের মধ্যেও মাতৃভাষার পরিবৰ্তে হিন্দী বা ইংরাজীতেই কথা বলছে বেশী। এক্ষেত্ৰে ইংরাজীর চেয়ে হিন্দীর আধিপত্যই যে বেশী তা অবশ্য বলাই বাহুল্য। মাতৃভাষাটা যারা ভালোকরে শিখলই না, যে ভাষাটার প্ৰতি মনে তৈরী হলনা কোন আবেগ, ভবিষ্যতে সেই ভাষাটার প্ৰতি তারা কতটা সংবেদনশীল এবংদায়িত্বশীল থাকবে। সেই প্ৰশ্নটা একটা শ্ৰেণীর ভাষাপ্ৰেমীকে আজ প্ৰবলভাবে ভাবাচ্ছে। আমার মনে হয় প্ৰকৃত সংকটটা বোধহয় এইখানেই। হিন্দী যা কিনা শুধুমাত্ৰ সিনেমা হল, পাড়ার পুজো প্যাণ্ডেল বা কিছু অন্যান্য অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, আজ তা আমাদের মুখে মুখে, ঘরে ঘরে। সবচেয়ে বেশী প্ৰভাবিত আজকের যুব প্ৰজন্ম। অনেক ভাষাবিদরা আশংকা করেছেন যে হিন্দীর এই প্ৰবল আগ্ৰাসনে গোটা পূৰ্ব ও উত্তর ভারতের অনেক রাজ্য ও ভাষার উপর নেমে আসতে চলেছে এক ভয়ঙ্কর অস্তিত্ব সংকট। আমরা যদি সতি্যই আমাদের মাতৃভাষাকে ভালবাসি, তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই তবে এর বিদ্ধে একটু সম্মিলিত প্ৰতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। কিছু বিহু কমিটির তরফ থেকে এ বিষয়ে একটা সদৰ্থক পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে থাকলেও আজকাল অনেক নামী দামী শিল্পীরা এসবের তোয়াক্কা করেন না। বাংলা ভাষা বা বাঙালিকে যারা প্ৰধান বা একমাত্ৰ সংকট বা শত্ৰু বলে ভাবছেন, তারা এ বিষয়টিকে নিয়েও ভাবছেন তো?
এখন সময় পরস্পর আরোপ প্ৰত্যারোপের নয়, আত্ম বিশ্লেষণের। বছরের পর বছর শুধু একে অপরের প্ৰতি দোষ চাপানোর এই শাপ লুডো খেলায় এই প্ৰদেশটার লোকসান বৈ লাভ কিছু হয়নি। যে কারণেই হোক, একাংশ অসমীয়াদের মনে যেমন বাঙালির প্ৰতি এক বিদ্বেষ ভাব রয়েছে, বাঙালিদের তারা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি, ঠিক তেমনি একাংশ বাঙালিও কিন্তু অসমের ভাষা সংস্কৃতির সঙ্গে মন থেকে একাত্ম হতে পারেনি। বলতে দ্বিধা নেই যে এমন অনেক বাঙালিই আছেন যারা অসমের খেয়ে পশ্চিমবাংলার গুণগান করেন। কথায় কথায় তারা শিলিগুড়ি কলকাতা আওড়ান। ‘নৰ্থ ইষ্ট ইউনাইটেডের' থেকে ‘এ্যাথলেটিকো ডি কলকাতা' তাদের বেশী আপন। বিষ্ণু-জ্যোতি এমন কি শংকরদেব সম্পৰ্কেও তাদের তেমন ধারণা বা আগ্ৰহ নেই। অসমের জাতীয় সংগীত কোনটি বা তার রচনাকার কে, এই প্ৰেশ্নও মূক থাকবেন তাদের অনেকেই। দোষ মোটেও একতরফা নয়। কমবেশী উভয়পক্ষেরই রয়েছে।
যে দেশটাতে আমরা জন্মেছি, খেয়ে পড়ে বেঁচে বৰ্তে আছি, সেই দেশ বা রাজ্যের প্ৰতি আনুগত্য প্ৰদৰ্শনে আমরা দায়বদ্ধ। রবীন্দ্ৰ নজল সুকান্তের মতই জ্যোতি রাভা লক্ষ্মীনাথকেও আমাদের মনে উপযুক্ত স্থান দিতে হবে। বিবেকানন্দ শ্ৰীচৈতন্যের মতোই শংকরদেবের প্ৰতিও আমাদের ততোটাই শ্ৰদ্ধাশীল হওয়া উচিৎ। একাংশ বাঙালির এসবের প্ৰতি অনাগ্ৰহ ও উদাসিনতাই কিন্তু সমগ্ৰ জাতিটাকে কাঠ গঢ়ায় দাঁড় করিয়ে দেবার অন্যতম কারণ।
একথা অনস্বীকাৰ্য এবং বার বার বলতেও দ্বিধা নেই অসমের মানুষ শান্তিপ্ৰিয় এবং অতিথি বৎসল। এদেশে বাঙালি অসমীয়ার সহাবস্থানের পরম্পরাও সুপ্ৰাচীন। আশির দশকে একাংশ অসমীয়া যেমন বিদেশীর নামে বাঙালি বিতাড়ণে ব্ৰতী হয়েছিলেন, আবার অনেকে সেই আন্দোলনের বিরোধিতা করে বাঙালির পাশে দাঁড়াতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি। এই দুই সম্প্ৰদায়ের দীৰ্ঘদিনের সম্পৰ্কটাকে এভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে তারা দিতে চাননি। বৈবাহিক বন্ধনের মাধ্যমে এই সম্পৰ্ককে সুদৃঢ় করে তুলবার যে প্ৰয়াস সে সময়ে সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবয়ারা শু করেছিলেন তা কিন্তু আজও অব্যাহত। বিদ্বেষ ও বিভাজনের কুটনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট দেখিয়ে ভাষা বৰ্ণ নিৰ্বিশেষে এই দেশ ও জাতীর উন্নতিকল্পে যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে এগিয়ে যেতে পারি, তবে সতি্য অৰ্থেই রাজ্যটা একদিন হয়ে উঠতে পারে ‘সোনর অসম'।
বিদ্বেষ ও বিভাজনের রাজনীতি আর নয়। রাজনীতি হোক অসমের উন্নয়নের প্ৰেশ্ন। রাজনীতি হোক অসমের বিশেষ রাজ্যের মৰ্যাদা ঘুরিয়ে আনার দাবীতে, পেপার মিল বা তৈলক্ষেত্ৰ বন্ধ ও বেসরকারী করণের বিদ্ধে। রাজনীতি  হোক সব জনগোষ্ঠীর সমধিকার ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্ৰতিষ্ঠার লক্ষ্যে। সৰ্বস্তরের সব মাধ্যমের বিদ্যালয়ে মাতৃভাষা এবং অসমীয়া ভাষা বাধ্যতামূলক করার প্ৰয়াসে।
মাত্ৰ বছর চল্লিশের (কমবেশী) ঘটনা পরিঘটনার জন্য শতাব্দী প্ৰাচীন মৈত্ৰীর ঐতিহ্যটাকে এভাবে নষ্ট হয়ে যেতে দেওয়া যায়না। তারচেয়ে আসুন, সমস্ত ভুল বোঝাবঝির অবসান ঘটিয়ে অসমীয়া-বাঙালি মৈত্ৰী অধিকতর মজবুত ও শক্তিশালী করে সম্মিলিত ভাবে আমরা অসমকে গড়ে তুলি শ্ৰেষ্ঠ রাজ্য হিসাবে। এই হোক আমাদের আজকে শপথ।
যে এন আর সি প্ৰসঙ্গ দিয়ে নিবন্ধের সূচনা করেছিলাম সেই প্ৰসঙ্গে ফিরে এসে পরিশেষে শুধু এটুকুই বলব যে, যারা প্ৰকৃতাৰ্থে বিদেশী, যারা অসমের শত্ৰু ও সংকট, স্বর+প তারা চি¿হ্নত হোক। প্ৰয়োজনে বিতারিত হোক। আশা শুধু এটুকুই যে এই চিহ্নিতকরণ প্ৰক্ৰিয়াটি যেন পক্ষপাত বিশিষ্ট এবং সম্পূৰ্ণভাবে যান্ত্ৰিক না হয়ে কিছুটা মানবিক হয়। নাহলে যে শুধুমাত্ৰ তথ্য প্ৰমাণের অভাবে একটা শ্ৰেণীর কিছু নিপীড়িত খেটে খাওয়া মানুষের জীবন একেবারে দুৰ্বিসহ হয়ে উঠবে। অধিকার আদায়ের লক্ষে সংগ্ৰামের পথ বেছে নিয়ে রাজ্যটাকে আরো কয়েকটা দশক পিছনের দিকে ঠেলে না দিয়ে ঐক্য শান্তি ও সমন্বয়ের আদৰ্শকে প্ৰতিষ্ঠা করে গড়ে উঠুক এক বৃহত্তর অসমীয়া জাতি, যেখানে সকলেই নিজ নিজ ঐতিহ্য ও পরম্পরা নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে। সমন্বয়ের মূৰ্ত প্ৰতীক আমাদের সকলের প্ৰাণের প্ৰিয় ভূপেনদার গানের দুটো কলি দিয়েই এই রচনাটির ইতি টানি --
‘‘মানুষ মানুষের জন্য
জীবন জীবনের জন্য
একটু সহানুভূতি কি
মানুষ পেতে পারে না .....' ও বন্ধু .......।''


লেখকঃ সম্পাদক সাগ্নিক, বাসুগাঁও

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.