Header Ads

‘নাগরিকত্বহীন’ মানুষের গাথা


‘ডি’ ভোটার : সমস্যার নিবারক না কারক?
মূল অসমিয়া : ত্রিদিব নীলিম দত্ত 
বাংলা অনুবাদ : সুশান্ত কর

প্ৰথম শ্রেণির ছাত্রী খুদেজা বিবি এখনো সমস্ত অসমিয়া বর্ণ চিনে উঠতে পারে নি। কিন্তু সেই খুদেজার তার ছ’বছর বয়সেই একটি ইংরেজি বর্ণ শিখে ফেলতে বাধ্য হয়েছে। খুদেজা মাত্র ছবছরের মায়া ধরানো শিশু। বাড়ি দরঙের খারুপেটিয়ার পাশের ওঝাগাঁও গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন বলোগঢ়া গ্রামে। নাজির আলির কন্যা এই খুদেজার নামে বিদেশী ন্যায়াধিকরণ থেকে ‘বিদেশী’ সন্দেহে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয় ২০১৮র ১৭ সেপ্টেম্বরে। নাজির আলির পরিবারের সবার নাম এন আর সি খসড়াতে যদিও বা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এই শিশু খুদেজার নামে এসেছে বিদেশী নোটিশ, সে জানেনা ‘ডি’ ভোটারের সংজ্ঞা কী!
অসমে বিদেশী নাগরিকের সমস্যা
গেল চারটা দশক ধরে অসমের সমাজ এবং রাজনীতির অঙ্গনকে গরম করে রাখবার প্রধান বিষয়টিই হলো অবৈধ বিদেশী নাগরিকের সমস্যা। কোনো সন্দেহ নাই, অসমে এখন অব্দি বিদেশীর সংখ্যাটি সম্পূর্ণ অনুমান ভিত্তিক এবং স্বঘোষিত। ‘অসমে একজনও বিদেশী’ নেই থেকে শুরু করে কোটির ঘরে বিদেশী রয়েছে বলে নানা পক্ষ নানা সময়ে সংখ্যাটি নিরূপণ করে এসেছেন।১৯৭৮এর ১২ ডিসেম্বরে সারা আসাম ছাত্র সংস্থা যে চৌদ্দটি দাবিতে আসাম বন্ধের ডাক দিয়েছিল তাতে বিদেশী সমস্যার বিষয়টির উল্লেখ মাত্র করেছিল। এর পরের কালে ১৯৭৯এ মঙ্গলদৈ লোকসভা কেন্দ্রের ভোটার তালিকাতে বিদেশীর নাম ঢুকে যাবার অভিযোগ তুলে বিষয়টিকে এরা একটি রাজনৈতিক চেহারা দিয়ে দেয়। অসম থেকে বিদেশী নাগরিক বহিষ্কারের দাবিতে ছবছর ধরে চলা আন্দোলনের শেষে ১৯৮৫র ১৫ আগস্টে অসম চুক্তিতে এসে শেষ হয়। অসম চুক্তি অনুসারে ১৯৭১এর ২৪ মার্চের আগেকার সবাইকে নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই সময় ভাবা হয়েছিল আন্দোলনের সময় এতোসব রক্তাক্ত গণহত্যা, হাজার কয়েকের মৃত্যু এবং জনজীবন ক্ষতবিক্ষত হবার পরে অন্তত বিদেশী নাগরিকের সমস্যার থেকে অসম মুক্ত হবে। কিন্তু ঐ আসাম চুক্তির ৩৩ বছর পরেও বিদেশী নাগরিকের সমস্যাটি শেষ হওয়া তো দূর, নতুন নতুন সমস্যা এসে একে আরো বেশি জটিল করে ফেলেছে।
ড্রেইফাস এফেয়ার এবং ‘ডি’ ভোটার
১৮৯৪-১৯০৬ এই বারো বছর ধরে পুরো ফ্রান্সের জনগণ দুই শিবিরে বিভাজিত হয়ে পড়েছিলেন। সামাজিক –রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। ড্রেইফাস এফেয়ার হিসেবে খ্যাত এই ঘটনার মূল কারণ ছিলেন আলফ্রেড ড্রেইফাস নামে এক ফরাসি সেনা। ড্রেইফাস ফরাসি সেনার কিছু গোপন তথ্য জার্মানির কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন বলে ১৮৯৪তে জেলে যান। কিন্তু পরে ধরা পড়ল কারবারটি করেছিলেন ফার্দিনা য়ালসিন নামে আরেক সেনা আধিকারিক। কিন্তু ফ্রান্সের লোকজন সে সময় ড্রেইফাসের পক্ষে বিপক্ষে বিভাজিত হয়ে পড়েছিলেন। শেষে গিয়ে ১৯০৬এ ড্রেইফাস নির্দোষী বলে কারাগার থেকে মুক্তি পান।
        বর্তমান অসমের সমাজও ‘ডি’ ভোটার (Dubious Voter বা Doubtful Voter) তথা সন্দেহজনক বিদেশীকে নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। সমাজের এক অংশ ভাবছেন ‘ডি’ ভোটার মানেই বিদেশী। আরেক অংশ ভাবছেন ‘ডি’ ভোটার ব্যবস্থা প্রকৃত নাগরিকদের অধিকারকে খর্ব করছে। ‘ডি’ ভোটার ব্যবস্থা শুরু হয় ১৯৯৭ তে। সে বছরে ১৭ জুলাই তারিখে নির্বাচন আয়োগ এক নির্দেশিকা যোগে ভোটার তালিকার থেকে বিদেশীর নাম কাটতে অসম সরকারকে নির্দেশ দেয়। এর পরে থেকেই বিদেশী নাগরিকের সন্ধান করতে গিয়ে অসমের বাড়ি বাড়িতে সমীক্ষা চালিয়ে যারাই নাগরিকত্বের সঠিক তথ্য যোগাতে পারেন নি তাদের নামের বিপরীতে ‘ডি’ চিহ্ন বসিয়ে দেয়া শুরু হয়।অসমকে বিদেশী সমস্যার থেকে মুক্ত করতে চেয়ে সন্দেহজনক মানুষের নাম ভোটার তালিকাতে রইল, কিন্তু সেরকম মানুষজনকে নিরীক্ষণের সুবিধে হবে ভেবে নামের আগে ‘ডি’ বসিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে নির্বাচন আয়োগ ৩,৭০, ০০০ জন মানুষকে ‘ডি’ চিহ্নিত করেন এবং এর মধ্যেকার ১, ৯৯, ৬৩১ জন মানুষের মামলা বিদেশী ন্যায়াধিকরণে পাঠায়। এর মধ্যে আবার মাত্র ৩৬৮৬ জনকে প্রাথমিক ভাবে বিদেশী বলে ঘোষণা করে ভোটার তালিকার থেকে তাদের নাম কেটে দেয়।
 কী করে হয় ‘ডি’ ভোটার, সন্দেহজনক নাগরিক
ক্রমে ১৯৬২, ১৯৬৪তে গঠিত সীমান্ত পুলিশ, বিদেশী ন্যায়াধিকরণ এবং নির্বাচন আয়োগের তত্ত্বাবধানে দুটি আইনগত ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিদেশী মামলা করা হয়। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সীমান্ত পুলিশের সন্দেহ দেখা দিলে প্রথমে অনুসন্ধানকারী পুলিশ আধিকারিক সেই ব্যক্তির বাড়ি গিয়ে সরজমিন তদন্ত করে তাঁকে নাগরিকত্বের দরকারি নথিপত্র নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরে দেখাতে বলতে পারেন। কিন্তু সেই সময়ের ভেতরে সেই ব্যক্তি নাগরিকত্বের নথিপত্র দেখাতে না পারলে, বা দেখানো নথিপত্রগুলো বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে না হলে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানকারী পুলিশ আধিকারিক চার্জশিট দাখিল করতে পারেন। তার আগে সেই আধিকারিককে দুটি প্রপত্র পূরণ করতে হয়। সেখানে এই সব তথ্য দিতে হয়---অভিযুক্তের নাম, বাবার নাম,বৈবাহিক সম্পর্ক, স্বামী বা স্ত্রীর বিবরণ, জন্ম দেশের ঠিকানা, ভারতে থাকার ঠিকানা, জীবিকা, ব্যক্তি নিজের দেশ ত্যাগ করবার কারণ, ভারতে কীভাবে প্রবেশ করলেন, ১৯৭১এর ২৪ মার্চের আগের কোনো ভোটার তালিকাতে ব্যক্তির নাম আছে কি নেই, ব্যক্তি নিজেকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে স্বীকার করেন কি না ইত্যাদি। এই প্রশ্নগুলোর সঠিক জবাব লিখে অনুসন্ধানকারী আধিকারিককে মামলাটি সীমান্ত পুলিশ অধীক্ষককে পাঠাতে হয়। অধীক্ষক যদি মনে করেন মামলাটি ঠিকঠাক রয়েছে তিনি তখন সেটি বিদেশী ন্যায়াধিকরণে পাঠান। এভাবে অনুসন্ধানকারী আধিকারিকের তদন্ত, ঊর্ধ্বতন আধিকারিকের মন্তব্য, সীমান্ত পুলিশ অধীক্ষকের সম্মতির পরেই শুধু কোনো এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিদেশী ন্যায়াধিকরণে মামলা করতে পারা যায়। এর পরে ন্যায়াধিকরণ অভিযুক্তকে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে নাগরিকত্ব প্রমাণের নির্দেশ প্রদান করেন। এমন ব্যবস্থাতে অভিযুক্তকে ‘নন-ডি’ বলা হয়। অভিযুক্ত মামলাতে হারলে বা তিনি আদালতে উপস্থিত না থাকলে তাঁকে বিদেশী হিসেবে ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাবার পথটিও খুলে যায়।
      কারো বিরুদ্ধে বিদেশী মামলা চলবার দ্বিতীয় ব্যবস্থাটি করে নির্বাচন আয়োগ। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করবার জন্যে নির্বাচন আয়োগ এল ভি ও (লোকাল ভেরিফিকেশন অফিসার)-দের নিয়োগ করে। তাঁরা বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কাউকে সন্দেহজনক বলে ঘোষণা করতে পারেন।এদের নিয়োগ হয়ে থাকে অস্থায়ীভাবে। এরা ই আর ও-কে (ইলেক্টরেল রেজিস্ট্রেশন অফিসার) যে প্রতিবেদন পাঠান তার ভিত্তিতে তিনি মামলাটি সীমান্ত পুলিশ অধীক্ষককে পাঠাতে পারেন। অধীক্ষক আবারও অনুসন্ধান করে মামলাটি বিদেশী ন্যায়াধিকরণে পাঠালে সন্দেহজনক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলাটি শুরু হয়। এই ব্যবস্থাতে অভিযুক্ত ব্যক্তির নামের বিপরীতে ভোটার তালিকাতে ‘ডি’ চিহ্ন দিয়ে রাখা হয়। এরকম ক্ষেত্রেও অভিযুক্ত মামলাতে হারলে বা তিনি আদালতে অনুপস্থিত থাকলে তাঁকে বিদেশী ঘোষণা করে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠাবার ব্যবস্থা রয়েছে।
        “পুরো বিষয়টি সঠিক প্রক্রিয়াতে যদি হতো ডি ভোটার এবং সন্দেহজনক বিদেশীর নামে একটি জটিল সমস্যার হয়তো সৃষ্টি হতো না। এল ভি ও-কে যদিও তথ্যের জন্যে বাড়ি বাড়ি যেতে হয় তাঁরা সেসব করেন না, অফিসে থেকেই সন্দেহজনক নাগরিকের প্রতিবেদন তৈরি করেন। ন্যায়াধিকরণে যে সব মামলা পাঠানো হয় আদালতও সেগুলোর সত্যাসত্য নিরূপণ করে দেখেন না বলে অভিযোগ উঠছে। নদী ধ্বসে পড়ে বা কাজের সন্ধানে অভিযুক্ত অন্য জায়গাতে গেলে মামলাটির সম্পর্কে কিছু না জেনে থাকলেও আদালত তাঁকে পলাতক বিদেশী বলে ঘোষণা করবার উদাহরণও মেলে। বহু ক্ষেত্রে অভিযুক্ত জানেনই না তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চলছে, বা কখনো কোনো বিজ্ঞপ্তিও পান না। বর্তমান অসমে প্রায় ১.২৫ লাখ ডি ভোটার এবং ২.৫০ লাখ নন-ডি ভোটার রয়েছেন। এই নন-ডি ভোটার বিষয়টি অতিশয় বিপজ্জনক হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে এবং এ সম্পূর্ণরূপে সীমান্ত পুলিশের ইচ্ছের উপরে নির্ভর করে আসছে।”--- কথাগুলো বললেন গুয়াহাটি উচ্চ ন্যায়ালয়ের অধিবক্তা এবং মানবাধিকার কর্মী হাফিজ রশিদ চৌধুরী।
         বিদেশী আইন, ১৯৪৬’-এর অধীনে স্থাপিত বিদেশী ন্যায়াধিকরণের সংখ্যা ৩৬ থেকে বাড়িয়ে ১৯১৫তে ১০০ করা হয়। ন্যায়াধিকরণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াতে এর সদস্যের অভাব দেখা দেয়। সরকার তখন সদস্য নিযুক্তির নিয়মনীতি বদল করে। আগে ন্যায়াধিকরণের সদস্য হতে হলে জেলা ন্যায়াধীশ নইলে অতিরিক্ত জেলা-ন্যায়াধীশ হওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু এখন ৫৫ বছর বয়সী এবং ১০ বছর আদালতে আইনের কাজ করবার অভিজ্ঞতা থাকলেই যে কোনো অধিবক্তাকে ন্যায়াধিকরণের সদস্য বলে নিযুক্ত হতে পারেন। যোরহাট, শিলচর, তেজপুর, ডিব্রুগড়, গোয়ালপাড়া এবং কোকড়াঝাড়ে একটি করে ডিটেনশন ক্যাম্প রয়েছে। অন্যদিকে ২০১৮র ১৩ ফেব্রুয়ারিতে অসম সরকারের হয়ে চন্দ্রমোহন পাটোয়ারি বিধান সভাতে একটি তথ্য দাখিল করেন। সেই অনুসারে নিষ্পত্তি না হওয়া বিদেশী মামলার সংখ্যা হলো ১,৭২,৭২৯ টি (ডি ভোটার সহ), ডি ভোটারের সংখ্যা হলো ১,২৫, ৩৩৩ জন।
শিশুও হয় সন্দেহজনক নাগরিক
     শিশুর প্রতি সংবেদনশীলতা এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল চরিত্র। শিশুর মানসিক বিকাশে রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব উল্লেখযোগ্য। কিন্তু অত্যন্ত উদ্বেগের কথা যে, বর্তমান আসামে মা-বাবা নাগরিক হলেও সন্তান নাগরিকত্বের পরিচয় দেবার জন্যে আদালত থেকে নোটিশ পায়। এই প্রতিবেদনের শুরুতেই যে খুদেজা বিবির কথা লিখলাম, শুধু সেই না -- হোজাইর দক্ষিণ দেবস্থানের আট বছরের শিশু মনোয়ার হুসেইনকেও নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্যে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র মানোয়ার হিটলারের নাম না শুনলেও কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বিষয়ে খুব ভালো জানে। একজন নাগরিক ভোট কেন দেন সেই নিয়ে কিছু না জানলেও ‘সন্দেহজনক’ নাগরিক, ডি ভোটারের বিষয়ে মানোয়ারের সম্যক জ্ঞান আছে। মানোয়ারের নানার নাম ১৯৫১র এন আর সি-তে তো আছেই, বাবাও স্বদেশী, তবু তাকে ২০১৮র ১৯ জুলাইতে শমন পাঠিয়ে নাগরিকত্ব প্রমাণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সন্দেহ হয়, ‘ডি’ ভোটার, নাগরিকত্ব প্রমাণের অন্ধকূপে বন্দি হয়ে খুদেজা বিবি, মনোয়ার হুসেইনের মতো এক একটি শিশুর জীবনের তাবৎ রঙ যদি ফুরিয়ে যায়। অক্ষরজ্ঞান না হতেই কি এই শিশুদের জন্যে লেখা হবে অন্ধকার এবং ভয়ঙ্কর ভবিষ্যলিপি?

যাদের মর্যাদা লুণ্ঠিত হলো...
“আপনি দেশের জন্যে জীবনের সমস্ত ত্যাগ করবার পরেও যখন আপনার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলা হবে, তখন আপনার খুব খারাপ লাগবেই।” মহিরুদ্দিন আহমেদ জানালেন। আহমেদ ১৯৮৬ থেকে ২০০৪ অব্দি সেনা বাহিনীতে কাজ করে অবসর নিয়েছেন। কর্মক্ষেত্রে কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করেছেন বরপেটার বাসিন্দা এই মহিরুদ্দিন আহমেদ। বরপেটার বিদেশী ন্যায়াধিকরণ থেকে ২০১৭তে তিনি নাগরিকত্ব প্রমাণের বিজ্ঞপ্তি পান। “আমার বিরুদ্ধে উঠা এই বিদেশী অভিযোগে আমি ভেঙ্গে পড়েছিলাম। আমার বড় দাদা সহকারী সেশন জাজ ছিলেন। এর পরেও এমন অদ্ভূৎ প্রশ্ন” (কারাভান ডেইলি, ৫ নভেম্বর, ২০১৮)
        ‘ডি’ ভোটার, বিদেশীর নোটিশ পেয়ে এমন বহু সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কর্মী, সরকারী শিক্ষক, পুলিশের কর্মীদের নাগরিকত্ব প্রমাণের কষ্টকর এবং ব্যয়বহুল পথে পা বাড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে। এমন অনিয়ম বহু নাগরিকের সম্মান ভূলুণ্ঠিত করছে বলে যে অভিযোগ উঠছে তাকে অস্বীকার করা যায় না। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়ালের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত অসম পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক শাহ আলম ভূঞা হলেন এমন আরেক নজির। আলমের বাবা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। এমন এক ব্যক্তির সন্তানকে এখন লড়তে হচ্ছে যাতে তিনি ভারত থেকে বহিষ্কৃত না হন। যদিও ১০ বছর ধরে চলা যুদ্ধের শেষে তিনি নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে পেরে উঠেছিলেন। কিন্তু সে বেশিদিনের জন্যে নয়। ৩৩ বছর অসম পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মী শাহের নামের সঙ্গে আবার বসেছে ‘ডি’ চিহ্ন।
         অসমকে পুব পাকিস্তানের সঙ্গে সামিল করবার প্রবণতার বিরুদ্ধে যারা লড়েছিলেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন মৌলবী মহম্মদ আমিরুদ্দিন। এই স্বাধীনতা সংগ্রামী ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৬ অব্দি অসম বিধান পরিষদের উপাধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁরই পুত্র, ভাইপো, নতিসহ পরিবারের ১৪ জন সদস্যকে নাগরিকত্বের প্রমাণ দেবার জন্যে বহুবছর আদালতের পথ মাড়াতে হয়েছে।
         বিশেষ কোনো অনুসন্ধান না করেই ‘ডি’ ভোটারের মামলা চাপিয়ে দিলে এক একটি পরিবারকে কতটা কঠোরভাবে ছুঁয়ে যায় তার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো রহার বামুনিজান গ্রামের বাসিন্দা একটি ছাত্র কৈলাস সিংহ। দিন হাজিরা করে পরিবারের ভরণপোষণ করেন ওর বাবা নীলকান্ত সিংহ। এভাবেই ছেলেকে পড়িয়েছিলেন। ২০১৮তে সে অসম অভিযান্ত্রিক মহাবিদ্যালয়ে পড়বার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু অসম বাসের স্থায়ী প্রমাণপত্র ( পি আর সি) জোটাতে পারল না বলে ভর্তি হতে পারল না। পারে নি , কেননা ওর বাবার বিরুদ্ধে ২০১১ থেকে ‘ডি’ ভোটারের মামলা চলেছে। এই কথা সে সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছিল। নীলকান্ত সিংহের বাবার নাম ১৯৫১র এন আর সি-তে রয়েছে। এবারের এন আর সি-তেও বাড়ির অন্য সবার নাম এসেছে।
কিন্তু তাঁর নামই কেন সন্দেহজনক নাগরিক বলে চিহ্নিত হয়ে রইল এই নিয়ে তিনি কিছু জানেন না। এভাবেই আইনের মারপ্যাঁচে পড়ে এক সম্ভাবনাময় ছাত্রের জীবন অনিশ্চিত হয়ে রইল।
 চারবার নাগরিকত্বের প্রমাণ দিলেন শামসুল হক
“আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমার উপর যে অত্যাচার হচ্ছে তার এখানেই শেষ হোক। পলিথিনের বেগ থেকে একটি কাগজের পোটলা বের করে বললেন শামসুল হক। ৬৫ বছর বয়সী হকের বাড়ি নগাঁও জেলার নিজ ধিঙে। তাঁর নাম এন আর সি-তে আসে নি। তাঁকে তিনবার নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হয়েছে এবং চতুর্থবারের মামলাটি চলছে। “আমার জন্ম অসমে, বাবার জন্ম অসমে। আমাকে বারে বারে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হচ্ছে। কেসের জন্যে সবই বিক্রি করলাম” শামসুল হক বললেন।
বিদেশী ন্যায়াধিকরণ থেকে প্রথম নোটিশ আসে ২০০২তে। ২০০৯এ তিনি সেই মামলা থেকে মুক্ত হন। এই মামলা চলাকালীন অবস্থাতেই ২০০৪ এবং ২০০৫এ আরো দুটি শমন আসে তাঁর কাছে। ২০১১তে সব কটি মামলার থেকে মুক্তি পাবার পরে আবার ২০১৫তে চতুর্থ শমনটি আসে । চারবারে নাগরিকত্বের অগ্নি পরীক্ষাতে ক্ষতবিক্ষত অবতীর্ণ শামসুল হক এখন নাগরিকত্বের সংজ্ঞাতে ক্ষত-বিক্ষত।
      “কেসের জন্যে নথি-পত্র জোগাড় করা, গাড়ি ভাড়া আর উকিলের ফিজ বাবদ লাখ টাকা খরচা হয়েই গেল। গেল আট বছর ধরে আমার স্ত্রীকে বিদেশী নন বলে প্রমাণ করতে গিয়ে পরিবারটি চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল। একবেলার আহার জোগাড়ই দায় হয়ে পড়েছে। এই অবস্থাতে কেস চালাতে টাকা পাই কই?” আহাদ আলি এভাবেই বর্ণনা করলেন নিজের পরিবারের দুর্দশা। আহাদ আলির বাড়ি গোয়ালপাড়ার ফফঙ্গা প্রথম খণ্ডে। একসময় রিক্সা চালাতেন। ভালোই চলছিল তাঁর পরিবারের। তাঁর স্ত্রী নবীরন খাতুন লোকের বাড়িতে বাসন ধুয়ে, বাঁশের ধারা তৈরি করে চাষের জমিও কিনেছিলেন। দারিদ্র্য অতিক্রম করে একটি সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু নবীরনের বিরুদ্ধে বিদেশী ন্যায়াধিকরণে তিন তিনবার নাগরিকত্ব প্রমাণের মামলা উঠে। তার ভারে পরিবারটি আজ ক্লান্ত। আট সন্তানের মা নবীরন ২০১০এর ৬ নভেম্বরে গোয়ালপাড়া বিদেশী ন্যায়াধিকরণ থেকে বিদেশী নোটিশ পান। তিনি বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার পাকুলা গ্রাম থেকে এসে ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন বলে সীমান্ত পুলিশ একটি মামলা করেছিল। নবীরণ খাতুনের নানা প্রয়াত ফায়েজুদ্দিনের নাম ১৯৫১র এন আর সি-তে আছে। এবং তাঁর মা-বাবার জন্ম বরপেটার বাঘবরে। এইসব নথি যখন তিনি আদালতে জমা দিলেন আদালত তাঁকে ভারতীয় বলে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সুদে ধার করা টাকা শোধ করতে না করতেই নবীরনের বিরুদ্ধে আবার বিদেশী ন্যায়াধিকরণের নোটিশ আসে। এবারে অভিযোগ করা হয় তিনি বাংলাদেশের ঢাকার সিরাজগঞ্জ গ্রামের বাসিন্দা। নবীরন আবার আদালতে প্রমাণ দিয়ে দোষমুক্ত হন। কিন্তু কী পরিহাস! নবীরনের বিরুদ্ধে তৃতীয় মামলাতে (মামলা নম্বর---৭৪৯৬/জি/ ২০১৬) তাঁকে আবার ময়মনসিংহের পাকুলা গ্রামের বলে উল্লেখ করা হয়। এভাবেই সীমান্ত পুলিশের তিনটা ভুয়া মামলার ফাঁদে জড়িয়ে রইলেন এই পরিবার।
        যদিও বা এটা বাধ্যতামূলক যে সীমান্ত পুলিশের অনুসন্ধানকারী আধিকারিককে কারো নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে বাড়ি গিয়ে তদন্ত করতে হবে, প্রায়ই এটা করা হয় না। তিন চারবার করে বিদেশী বিজ্ঞপ্তি পাবার পরেও শামসুল হক, নবীরন খাতুনরা কোনোদিনই অনুসন্ধানকারী আধিকারিকদের চোখের দেখাটি দেখেন নি। সীমান্ত পুলিশের দায়িত্বহীন কাজকারবারের জন্যে আজ এমন যে কত নাগরিক রয়েছেন যারা জানেন না ঠিক কতবার নাগরিকত্বের প্রমাণ দিলে তারা ভারতীয় হতে পারবেন।
বিদেশী ন্যায়াধিকরণে অনিয়মের অভিযোগ
অধিক হারে বিদেশী ঘোষণা করতে সক্ষম হলে বিদেশী ন্যায়াধিকরণের সদস্যদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয়---এমন তথ্য খোদ সরকারি শপথনামাতেই সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে। শপথনামাতে উল্লেখ করা হয়েছিল,এদের পারদর্শিতা ছিল না। তার মানে এরা বেশি বেশি করে বিদেশী ঘোষণা করতে পারেন নি। ন্যায়াধিকরণের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এমন ১৯ জন সদস্য গুয়াহাটি উচ্চ ন্যায়ালয়ে দাখিল করা একটি মামলাতে (৪৮৬৮/১৭)। সরকারের শপথনামাতে বিদেশী ন্যায়াধিকরণের সদস্যদের পারদর্শিতা তিনটি পর্যায়ের রাখার কথা ঘোষণা করা হয়। শপথনামার এই পর্যায় তিনটি হলো---যারাই কম সংখ্যাতে বিদেশী ঘোষণা করবেন তাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে, যাদের বিদেশী ঘোষণার সংখ্যা মাঝারি তাদের সতর্ক করা হবে, আর বেশি বেশি বিদেশী ঘোষণা করবেন যারা তাদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হবে। শপথনামাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ধুবড়ি জেলার তৃতীয় ন্যায়াধিকরণের সদস্য কার্তিক চন্দ্র রায় তাঁর কার্যকালে ৩৮০টি মামলার মধ্যে মাত্র ১.৩২ শতাংশ মানুষকে বিদেশী ঘোষণা করেছেন বলে তাঁর প্রদর্শনে অসন্তুষ্ট হয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে। অন্যদিকে গোয়ালপাড়ার বিদেশী ন্যায়াধিকরণের সদস্য দিলীপ কুমার বর্মণ, ভবকান্ত হাজরিকা, কুলেন্দ্র তালুকদারেরা তাঁদের কার্যকালে ৪.৩২ শতাংশ, ২.৪৩ শতাংশ, এবং ৭.৬৭ শতাংশ মানুষকে বিদেশী ঘোষণা করাতে তাঁদের কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি (May be terminated) দেওয়া হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একই রকম বরপেটা বিদেশী ন্যায়াধিকরণের সদস্য অনুরূপা দে, ধুবড়ি জেলা ন্যায়াধিকরণের সদস্য হেমন্ত মহন্ত, গোয়ালপাড়া ন্যায়াধিকরণের সদস্য বিভাস বর্মণেরা ক্রমে ১১.৫৫ শতাংশ, ৮. ২৩ শতাংশ এবং ১০.২৬ শতাংশ মানুষকে বিদেশী ঘোষণা করাতে তাদের পারদর্শিতা উন্নত করা দরকার বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। অন্যদিকে ধুবড়ি জেলার বিদেশী ন্যায়াধিকরণের সদস্য অভিজিৎ দাস, নব কুমার বরুয়া, জোনমণি বরুয়ারা তাঁদের মোট মামলার ক্রমে ৩৯.০৫ শতাংশ, ৭৪.৭৭ শতাংশ, ৪১.১৬ শতাংশ মানুষজনকে বিদেশী ঘোষণা করবার ফলে তাঁদের পারদর্শিতা ‘সুন্দর’ বলে চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয় বলে উল্লেখ করা হয়। বিদেশী ন্যায়াধিকরণের সদস্যদের পারদর্শিতার মূল্যায়ন করে রাজ্যের গৃহ-বিভাগ। সেই অনুসারে ২০১৭র ২২ জুনে কার্যকর একটি নির্দেশে বিদেশী ন্যায়াধিকরণের ৩৪ জন সদস্যের পারদর্শিতা উন্নত নয় বলে উল্লেখ করা হয়। তারই ১৯ জনের চাকরির মেয়াদ সমাপ্ত করবার সঙ্গে সঙ্গে ১৫ জনকে পারদর্শিতা উন্নত করতে সতর্ক করে দেওয়া হয়। একটি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদপত্রে এসেছিল, সীমান্ত পুলিশের করা মামলাতে অভিযুক্তদের ‘স্বদেশী’ বলে ঘোষণা করাতে ন্যায়াধিকরণের একাংশ সদস্যদের প্রতি সরকার অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিল। (Assam Discontinues 19 Tribunal members; telegraphindia.com, 22-06-2017)
বিদেশী মামলা একটি ‘লাভজনক উদ্যোগ’
মরিগাওঁ জেলার বিদেশী ন্যায়াধিকরণের সদস্য গৌতম সুরেন ২০১৮র ২৭ আগস্টে একটি নির্দেশে বিদেশী শনাক্তকরণ এবং ‘ডি’ ভোটার শনাক্তের ব্যবস্থা নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্থাপন করেছিলেন। ব্যবস্থাটিকে তিনি ‘Unfair practice (অন্যায় কর্ম), ‘ধন সংগ্রহের উপায়’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। (NRC—Tribunal questions process of identifying foreingners, The Hindu, 18 September, 2018)
        মরিগাঁওয়ের মিকিরভিটা পুলিশ থানার অন্তর্গত কালিকাজারি গ্রামের আমিনা খাতুন, মোস্তান আলি,আলিমা খাতুন, নারিজিয়া বেগমের বিরুদ্ধে করা মামলা খারিজ করে বলা হয় যে সীমান্ত পুলিশের ভুলের জন্যে আমিনা খাতুনকে ‘Ex-parte (আদালতের একপক্ষীয় রায়) করা হয়েছিল। অভিযুক্ত আমিনা খাতুন ন্যায়ালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন বলেই তাঁকে ‘Ex-parte’ করাকে ভর্ৎসনা করে গৌতম সুরেন যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাতে উল্লেখ করা হয়েছিল, আমিনা খাতুনের বাড়ি চিনতে না পেরে বলা হয়েছিল বিদ্যুতের খুটাতে বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ গ্রামটিতে আজ অব্দি বিদ্যুতের কোনো ব্যবস্থাই নেই। সুতরাং বিদ্যুতের খুটা থাকবার প্রশ্নই উঠে না। বিদেশী মামলাতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জারি করা বিজ্ঞপ্তিগুলো হাতে হাতে দেবার বদলে এই যে বিশ্রাম স্থানে, গাছে বা বিদ্যুতের খুটাতে লাগিয়ে দেবার কথা বলা হয়ে থাকে এভাবে মামলাগুলো এক একটি ‘লাভজনক উদ্যোগে’ পরিণত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে অভিযুক্তরা আদালতের বিজ্ঞপ্তি পাননি বলেই আদালতে উপস্থিত থাকতে পারেন নি।আর ফলে তাদের ‘Ex-parte’ করে বিদেশী ঘোষণা করা হয়েছিল। গৌতম সুরেনের বক্তব্যের গভীরে বিদেশীর নামে যে ‘লাভজনক উদ্যোগ’টি চলছে তার ফলে একাংশ মানুষের হাহাকার এবং ‘দেশবিহীন’ হবার করুণ গাথা অনুরণিত হয়েছিল ।
 কে কী বলেন
গকুল বর্মণ (সাধারণ সম্পাদক, আক্রাসু)
 বিদেশী নাগরিকের সমস্যা সমাধানের নামে কোচ-রাজবংশীদের হেনস্তা করা হচ্ছে।নাগরিকের সমস্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অন্নবালা রায়কে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল। এই মহিলা উকিলকে মাত্র ১৫০০ টাকা ফিজ দিতে পারেন নি বলে ‘ডি’ ভোটার মামলাতে হারলেন এবং বিদেশী বলে ঘোষিত হলেন। এহেন কাজ সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আগে থেকে কোনো বিজ্ঞপ্তি না দিয়েই এন আর সি হালনাগাদ করবার সময়েই বিদেশী নাগরিক বা ‘ডি’ ভোটারের মামলার কথা জানানো হয়েছে। অধিকাংশ মানুষই তাদের নিয়ে চলা মামলার সম্পর্কে কিচ্ছু জানেন না। কোচ-রাজবংশীদের আন্দোলনকে নিঃশেষ করবার একটি চক্রান্তের একে আমি অংশ বলে মনে করছি। প্রকৃত বিদেশী নাগরিককে ধরে বহিষ্কার করুক। কিন্তু ভারতীয় নাগরিকদের যেভাবে খুশি ধরে ‘ডি’ ভোটার করা বন্ধ করতে হবে।
দীপক দে (সভাপতি, সারা আসাম বাঙালি যুবছাত্র ফেডারেশন)
     ‘ডি’ ভোটার প্রক্রিয়াটি একটি ভুল প্রক্রিয়া, কেননা এরকম মামলাতে ৯৪ শতাংশ মানুষই ভারতীয় বলে ন্যায় লাভ করেন।কারো উপাধি নতুবা ধর্ম দেখে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বিদেশী নাগরিকের নোটিশ নইলে ‘ডি’ ভোটার করা হয়। বহু মানুষ কোনো বিজ্ঞপ্তি বা নোটিশ পানও না বা তাঁদের দেওয়া হয় না। বিদেশী নাগরিক শনাক্ত করা হোক, কিন্তু সেই করতে গিয়ে কোনো নির্দোষী বা প্রকৃত নাগরিকে শাস্তি না পান সেটিও নিশ্চিত করা দরকার। আমি নিশ্চিত যে ডিটেনশন ক্যাম্পের ৯০ % মানুষই ভারতীয়। এই পুরো ব্যবস্থাতে টাকাপয়সারও লেনদেন হয়ে থাকে। ইতিমধ্যে ‘ডি’ ভোটারে মামলাতে আতঙ্কিত হয়ে দশজনের বেশি বাঙালি হিন্দু আত্মহত্যা করেছেন।
আজিজুর রহমান (উপদেষ্টা,আমসু)
এই প্রসঙ্গে আমসুর উপদেষ্টা আজিজুর রহমান বলেন, কে কত বিদেশী ঘোষণা করতে পারে সেই নিয়ে বিদেশী ন্যায়াধিকরণে পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। নিজের চাকরি বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে বিদেশী ন্যায়াধিকরণের সদস্যরা হাজার হাজার মানুষকে বিদেশী বলে ঘোষণা করছেন। এই সবে বিদেশী সমস্যা অধিক জটিল হয়ে পড়েছে। বিদেশী ন্যায়াধিকরণে নিয়ম অনুসারে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে পুনরীক্ষণের দায়িত্ব দিলে কেবল শুধু কে কজনকে বিদেশী বলে ঘোষণা করেছেন তাতেই সীমাবদ্ধ না থেকে সামগ্রিকভাবেই মামলা পুনরীক্ষণের জন্যে স্থায়ী নিযুক্তির ব্যবস্থা করা দরকার, তাতে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচিত করা দরকার। সেই সঙ্গে বিদেশী ন্যায়াধিকরণের প্রতি মানুষের মধ্যে যে একটা ভয়, শঙ্কা এবং নেতিবাচক ধারণা দেখা দিয়েছে তা দূর করবার ব্যবস্থা সরকারের করা দরকার।
 দুটি গ্রাম, একটিই গল্প
খুঁটামারি এবং কুমারীপাড়া দুটি গ্রামের নাম। এই গ্রাম দুটি নরনারায়ণ সেতুর পাশ দিয়ে গেলে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গোয়ালপাড়ার থেকে উত্তরে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে এই দুটি গ্রামে নরনারায়ণ সেতু চালু হবার এক বছর আগে, সেই ১৯৯৭ থেকে আজ অব্দি ‘ডি’ ভোটার চিহ্নিত করবার জোয়ার চলছে। “ এই গ্রাম দুটিতে এখন ১০৭ জন ‘ডি’ ভোটার আছেন। সীমান্ত পুলিশের দ্বারা ঠিক কজন বিদেশী নাগরিকের নোটিশ পেয়েছেন সে জানি না। গ্রামের ২৮ জন বাসিন্দা বিদেশী নাগরিকের মামলা হেরেছেন। তাদের যে কোনো সময় ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে হতে পারে। গ্রাম দুটির রেহন আলি, বালা আইনল হক, খবিরুন নেছা, সাফিন আলি এবং নূর মহম্মদকে গোয়ালপাড়া ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যদিও ইতিমধ্যে নূর মহম্মদকে বাদ দিয়ে বাকিরা সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ে মামলা লড়ে এখন মুক্ত জীবন যাপন করছেন।”, বললেন খুঁটামারি গ্রামের গাওঁবুড়া শয়েদ আলি।
        সবুজ পাহাড়, ব্রহ্মপুত্র আর বিলে এক সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘেরা এই দু’খানা গ্রাম। কিন্তু এতো সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশেও গ্রাম দুটির মানুষজনকে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। “১৯৯৭ থেকে আমি ‘ডি’ ভোটার হবার পরে ২০০৮এ মামলা হারলাম। আমাদের বাবা রমত আলি শেখ এবং নানা মহরসান শেখের নামে ১৯৫১র এন আর সি , ভোটার তালিকার তথ্য দাখিল করবার পরেও আমি আজ পলাতক বিদেশী নাগরিক। কেন আমি মামলা হারলাম জানি না, কেনই বা আমার পরিবারের বাকিরা দেশি আর আমি বিদেশী জানি না। আমার চাষের জমি নেই। কখনো বা ২০০ টাকাতে হাজিরা করি। যদি কখনো যদি ধরে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যায় সেই ভয়ে রাতে আমার ঘুম আসে না। পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে এই ভয়ে বাজারে যেতে পারি না। অচেনা মানুষজন দেখলেই আমি আতঙ্কে কেঁপে উঠি। গ্রামে যদি অন্যকোনো কাজেও পুলিশ আসে আমি আড়ালে চলে যাই।” জানালেন একুশ বছর ধরে ন্যায়িক যুদ্ধে ক্লান্ত আলেখ উদ্দিন শেখ।
 অনিয়মের কি অবসান ঘটবে?
        অনিয়ম, অবহেলা,পক্ষপাতিত্ব এবং আইনের অপব্যবহারে ‘ডি’ ভোটার এবং অবৈধ বিদেশী শনাক্তকরণ ব্যবস্থাটিকে প্রহসনে পরিণত করেছে। কিন্তু যেসব লোকের হঠকারিতার জন্যে এই বিদেশী নাগরিক শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াটি বহু মানুষের জন্যে আতঙ্ক , হতাশা আর সম্মান হানির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। উদাহরণস্বরূপ বিদেশী ন্যায়াধিকরণ থেকে ‘ডি’ ভোটার মামলার থেকে মুক্ত হবার পরেও ভোটার তালিকার থেকে বহু মানুষের নামের সঙ্গে থাকা ‘ডি’ চিহ্ন সরিয়ে দেওয়া হয় নি, যার ফলে এন আর সি-র খসড়া থেকে এই সব ‘ডি’ ভোটারের মামলা মুক্ত মানুষ এবং তাঁদের পরিজনের নাম বাদ পড়ল।
২০১৬ র অক্টোবর অব্দি ৬,২১, ৬৮৮ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ‘ডি’ ভোটার এবং বিদেশী নাগরিকের মামলা নথিবদ্ধ হয়েছিল। ২০১৭র ফেব্রুয়ারি মাসে অসম সরকার বিধান সভাতে দেওয়া একটি তথ্য অনুসারে ৪,৪৪, ১৮৯ জন ব্যক্তির মামলা ন্যায়াধিকরণের কাছে পাঠানো হয়। তার মধ্যে ‘ডি’ ভোটার এবং বিদেশী নাগরিকের মোট ২,০১,৯২৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয় নি। এই তথ্যে আরো যা প্রকাশ পায়, নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর ৯২ শতাংশই নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণে সক্ষম হয়েছিলেন। (The Struggle of Doubtful Voters has intensified in BJP’s Assam, Abdul Kalam Azad, The Wire, 12 July) তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিদেশী নাগরিক বলে ঘোষিত অধিকাংশই ছিল ‘Ex-Parte’ (একপাক্ষিক)নোটিশ না পেয়ে বা অন্যকারণে অভিযুক্ত আদালতে উপস্থিত না থাকলে ‘Ex-Parte’ করে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে ফেলা হয়। আদালতের রায়ের ধরণ ভালো করে দেখলে দেখলে দেখা যাবে যে বিদেশী নাগরিক বলে ঘোষিত অধিকাংশই হয় মামলাতে প্রত্যাহ্বান জানান নি বা তাদের দাখিল করা নাগরিকত্বের নথিপত্র ভালো করে পরীক্ষা করে দেখা হয় নি। উদাহরণ স্বরূপ করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলাতে ঘোষিত বিদেশী নাগরিকের রায়ে ‘Ex-Parte’ এবং প্রত্যাহ্বান জানানো মামলার অনুপাত ছিল ক্রমে ৯৩৮ : ৯ এবং ১২৭ :
একটি অঞ্চলে প্রবেশ করা জনাকয় অপরাধীকে শনাক্ত করবার জন্যে অঞ্চলের প্রতিটি মানুষকে বছরের পর বছর ধরে সন্দেহজনক অপরাধীর তালিকাতে অন্তর্ভুক্ত করে হেনস্তা করাটা যেমন অযৌক্তিকর, সেভাবেই কিছু লোককে বিদেশী বলে শনাক্ত করতে লাখ লাখ মানুষের থেকে নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়াটাও অগণতান্ত্রিক। অসমে এখন এভাবেই একটি মাত্র ইংরেজি বর্ণ (D) লক্ষাধিক মানুষের থেকে তিলতিল করে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে সুখের সমস্ত বর্ণমালা, নিঃশেষ করে ফেলা হয়েছে জীবনের মর্যাদা এবং অধিকার। এইসব হতভাগা নাগরিকদের সঙ্গে সমস্ত গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের একটাই প্রশ্ন---এমন অবিবেচক এবং অমানবিক কাণ্ডের শেষ কবে হচ্ছে? ·

(অসমিয়া পাক্ষিক ‘প্রান্তিকে’ লেখাটি প্রকাশিত হয় ১৬ নভেম্বর, ২০১৬ সংখ্যাতে পৃ: ১৬ থেকে ২১শে।তার থেকে বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে।
             লেখকের ঠিকানা: দৈনিক জনমভূমি, রাধা গোবিন্দ বরুয়া পথ, গুয়াহাটি—৭৮১০০৫, ফোন: ৯৮৫৪৬৭৫৯৭২)


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.